ঢাকা, সোমবার, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

শিল্প-সাহিত্য

হারুকি মুরাকামির গল্প—আয়না | অনুবাদ : ফারাহ্‌ মাহমুদ

অনুবাদ গল্প ~ শিল্প-সাহিত্য | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৩৩৭ ঘণ্টা, মার্চ ৯, ২০১৬
হারুকি মুরাকামির গল্প—আয়না | অনুবাদ : ফারাহ্‌ মাহমুদ

জ রাতে আপনারা যে গল্পগুলো শুনছেন তার সবগুলোকে দুইটা ক্যাটাগরিতে ভাগ করা যায়। একটা টাইপে এক দিকে জীবিতদের পৃথিবী আর অন্যদিকের পৃথিবীটা মৃতদের।

মাঝে এমন এক শক্তি যারা এক পৃথিবী থেকে অন্য পৃথিবীতে আসা-যাওয়া করার ক্ষমতা রাখে। ভূতেরাও এই ক্যাটাগরিতে পড়ে। দ্বিতীয় ক্যাটাগরিতে পড়ে যুক্তি দিয়ে ব্যাখ্যা করা সম্ভব না এমন সব আধিভৌতিক ব্যাপার কিংবা অশুভ কিছুর পূর্বাভাস পাওয়া ও ভবিষ্যৎ অনুমান করতে পারার মতো ক্ষমতা। আজকের সব গল্পই এই দুই ক্যাটাগরির যে কোনো একটায়  পড়ে।

সত্যি বলতে, আপনাদের সব অভিজ্ঞতাই হয় প্রথম ক্যাটাগরিতে পড়ে, নয় দ্বিতীয়টায়। আমি বলতে চাইছি—যে সব মানুষেরা ভূত দেখে, তারা কেবল ভূতই দেখে; এর পূর্বাভাস তারা পায় না। আর যারা পূর্বাভাস পায়, তারা ভূত দেখতে পায় না। জানি না কেন এরকম হয়, কিন্তু প্রত্যেকেরই যে কোনো এক ক্যাটাগরির প্রতি পক্ষপাতিত্ব থাকে। অন্তত সেরকম ধারণাই আমি পেয়েছি।



অক্টোবরের শুরুর দিকের এক ঝড়ো রাত। আবহাওয়া ছিল ভীষণ গরম ও আর্দ্র। বিকেলের দিকে এক ঝাঁক মশা বেশ জ্বালাতন শুরু করলে ওদের দূর করার জন্যে আমি কয়েকটা মশার কয়েল জ্বালাই। সজোরে বাতাস বইছিল। সুইমিং পুলে যাবার গেটটা ভাঙা হওয়ায় বাতাসের কারণে শব্দ করে খুলছে আর বন্ধ হচ্ছে। আমি ওটা ঠিক করার কথা ভেবেছি, কিন্তু বাইরে এত গাঢ় অন্ধকার যে তা অসম্ভব। তাই সারারাত ওটা ওভাবেই শব্দ করে যাচ্ছিল



কিছু মানুষ অবশ্য কোনো ক্যাটাগরিতেই পড়ে না। যেমন ধরুন আমি। আমার এই ত্রিশ বছরের জীবনে আমি কখনোই কোনো ভূত দেখি নাই, কখনো অশুভ কিছু ঘটবে এমন পূর্বাভাস পাই নাই কিংবা ভবিষ্যদ্বাণীপূর্ণ কোনো স্বপ্নও দেখি নাই। একবার কয়েকজন বন্ধুর সাথে আমি লিফটে চড়েছিলাম। ওরা শপথ করে বলল আমাদের সাথে এক ভূতও লিফটে চড়েছে কিন্তু আমি কিছুই দেখতে পেলাম না। ওরা বলছিল ধূসর রঙের পোশাক পরা এক মহিলা ঠিক আমার পাশেই নাকি দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু বিশ্বাস করুন আমাদের সাথে কোনো মহিলা ছিল না, অন্তত আমার নিজের তাই ধারণা। সেদিন লিফটে শুধু আমরা তিনজন ছিলাম। মজা করছি না। ইচ্ছে করে আমাকে নিয়ে এরকম মজা করবে—আমার দুই বন্ধুও ঠিক এরকম না। পুরো ব্যাপারটাই কেমন যেন অদ্ভুত। এতকিছুর পরও আমার কখনোই ভূত দেখা হয় নি।

তবে, একদিনের একটা ঘটনা—শুধু একবারই ঘটেছিল—অভিজ্ঞতাটা এমন যে প্রচণ্ড ভয়ে আমি হতবুদ্ধি হয়ে গেছিলাম। ব্যাপারটা ঘটেছে দশ বছরের বেশি হবে। আমি এখনো কাউকে এটা জানাই নি। এই ব্যাপারে কথা বলতেও আমার ভয় লাগে। মনে হয় গল্পটা বলা মাত্র পুরো ঘটনাটা আবার ঘটতে শুরু করবে। আজকে আপনাদের সবার নিজের নিজের ভূতুড়ে অভিজ্ঞতার গল্প শোনার পর, আয়োজক হয়েও একান্তই নিজের একটা অভিজ্ঞতা বর্ণনা না করে এই অনুষ্ঠানটা ঠিকভাবে শেষ করা যাচ্ছে না। তাই আমি সেইদিনের গল্পটা বলার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।  



২.
১৯৬০ সালের শেষের দিকে ছাত্রদের আন্দোলন যখন পুরোদমে চলছে, ঠিক তখন আমি হাই স্কুল পাশ করি। প্রথাবিরোধী ও স্বাধীনচেতা হিপি জেনারেশনের অংশ ছিলাম বলে কলেজে যেতে চাইলাম না। এর বদলে শারীরিক পরিশ্রম লাগে এমন সব কাজ করতে করতে আমি পুরো জাপান ঘুরে বেড়ালাম। আমার কাছে ওটাই ছিল বেঁচে থাকার সবচেয়ে ভালো উপায়। ভীষণ আবেগপ্রবণ এক তরুণ—আপনারা হয়তো তখন এমনটাই ভাবতেন আমাকে। যদিও এখন পেছনে ফিরে তাকালে মনে হয় আমার সেই জীবনটা দারুণ মজায় কেটেছে। সিদ্ধান্তগুলো ঠিক ছিল নাকি ভুল জানি না, যদি আবার ফিরে যাওয়ার সুযোগ থাকত, আমি নির্দ্বিধায় তাই করতাম।

গোটা দেশ জুড়ে ঘুরে বেড়ানোর দ্বিতীয় বছরে আমি একটা জুনিয়র হাই স্কুলে রাতের প্রহরীর চাকরি পেলাম কয়েক মাসের জন্যে। স্কুলটা ছিল নিগাতা জেলার ছোট্ট এক শহরে। পুরো গ্রীষ্মে অনেক খেটে বেশ ক্লান্ত হয়ে পড়েছি বলে কিছুদিনের জন্যে আমি সহজ কিছু করতে চাইছিলাম। রাতের প্রহরীর কাজ রকেট সায়েন্স গোছের কিছু না। দিনের বেলা আমি কেয়ারটেকারের অফিসে ঘুমাই আর রাতে পুরো স্কুলে দুইবার রাউন্ড দিয়ে দেখি সব ঠিকঠাক আছে কিনা। বাকিটা সময় গানের রুমে রেকর্ড শুনে, লাইব্রেরিতে বই পড়ে কিংবা জিমে বাস্কেটবল খেলে কাটিয়ে দেই। সারারাত একা একা স্কুলে থাকাটা তেমন খারাপ কিছু না। আমি কি ভয় পেতাম? আসলে, না। উনিশ-কুড়ি বছর বয়সে কোনো কিছুই আপনাকে তেমন ভীত করতে পারে না।

আমার মনে হয় না আপনাদের মধ্যে কেউ কখনো রাতের প্রহরী হিসেবে কাজ করেছেন, তাই আমি আমার ডিউটি কী ছিল তা বুঝিয়ে বলছি। কাজটা হলো প্রতি রাতে আপনাকে দুটা রাউন্ড দিতে হবে—রাত নটায় এবং রাত তিনটায়। এই হলো শিডিউল। স্কুল ভবনটা ছিল আঠারো থেকে বিশটা ক্লাসরুম নিয়ে একেবারে নতুন একটা তিন তলা বিল্ডিং। স্কুলটা খুব বেশি বড় না। ক্লাসরুম ছাড়াও একটা করে মিউজিক রুম, স্কুল কর্তৃপক্ষের অফিসঘর, আর্ট স্টুডিও, স্টাফ অফিস, প্রিন্সিপালের অফিস আছে। সাথে আলাদা করে আছে ক্যাফেটেরিয়া, সুইমিং পুল, জিম আর অডিটোরিয়াম। আমার কাজ ছিল সবগুলোতে একবার করে ঢুঁ মেরে দেখা সব ঠিক আছে নাকি।

রাউন্ড দেয়ার সময় বিশ পয়েন্টের একটা চেকলিস্ট ফলো করতে হতো। চেক করা হয়ে গেলে পয়েন্টগুলোর পাশে একটা করে দাগ দিতে হতো—স্টাফ অফিস, চেক, সাইন্স ল্যাব, চেক...। আমার মনে হয় পায়ে হেঁটে পুরো স্কুল চক্কর না কেটে, কেয়ারটেকারের রুমের বিছানায় যেখানে আমি ঘুমাই সেখানে শুয়ে শুয়ে সবগুলো পয়েন্টের পাশে টিক চিহ্ন দিয়ে দিলেও কাজটা হয়ে যেত। কিন্তু মানুষ হিসেবে আমি এমন হযবরল না। ঘুমিয়ে আছি এমন সময় কেউ যদি চুরি করে ঢোকে, আমাকেই আক্রমণের শিকার হতে হবে।

যাই হোক, প্রতি রাত ন’টায় আর তিনটায় আমি গোটা স্কুল রাউন্ড দিতে বের হতাম বাঁ হাতে ফ্ল্যাশলাইট আর ডান হাতে কাঠের একটা ক্যান্ডো তলোয়ার নিয়ে। হাই স্কুলে থাকতে আমি ক্যান্ডো প্র্যাকটিস করতাম। হঠাৎ আক্রমণ থেকে নিজেকে রক্ষার ব্যাপারে আমি আত্নবিশ্বাসী ছিলাম। এমন যদি হয় যে আক্রমণকারী বেশ আনাড়ি, এমনকি যদি তার কাছে সত্যিকার তলোয়ারও থাকে, তাতেও আমি ভয় পেতাম না। কারণ আমি ছিলাম যুবক। এখন যদি ওরকম কিছু হয়, আমি শুধু প্রাণটা হাতে নিয়ে জোরে এক দৌড় লাগাব।

অক্টোবরের শুরুর দিকের এক ঝড়ো রাত। আবহাওয়া ছিল ভীষণ গরম ও আর্দ্র। বিকেলের দিকে এক ঝাঁক মশা বেশ জ্বালাতন শুরু করলে ওদের দূর করার জন্যে আমি কয়েকটা মশার কয়েল জ্বালাই। সজোরে বাতাস বইছিল। সুইমিং পুলে যাবার গেটটা ভাঙা হওয়ায় বাতাসের কারণে শব্দ করে খুলছে আর বন্ধ হচ্ছে। আমি ওটা ঠিক করার কথা ভেবেছি, কিন্তু বাইরে এত গাঢ় অন্ধকার যে তা অসম্ভব। তাই সারারাত ওটা ওভাবেই শব্দ করে যাচ্ছিল।

রাত ন’টার রাউন্ড বেশ ভালোভাবেই শেষ হলো, চেক লিস্টের বিশটা আইটেমই ঠিকঠাক আছে। সব দরোজা বন্ধ আর সবকিছুই ছিল জায়গা মতো। চোখে পড়ার মতো কিছুই ঘটে নি। আমি কেয়ারটেকারের রুমে ফিরে এলার্ম ঘড়িতে রাত তিনটার সময় সেট করে দ্রুত ঘুমিয়ে পড়ি।

তিনটার এলার্ম বাজার সঙ্গে সঙ্গে ঘুম ভেঙে আমার বেশ অদ্ভুত অনুভূতি হতে লাগল। অনুভূতিটা আমি ঠিক ব্যাখ্যা করতে পারব না, কেমন যেন অন্যরকম লাগছিল। বিছানা ছেড়ে উঠতেই ইচ্ছে করছিল না—মনে হচ্ছিল কিছু একটা আমাকে বিছানা ছাড়তে বাধা দিচ্ছে। আলসেমি না করে গা ঝাড়া দিয়ে বিছানা ছেড়ে ওঠা আমার সবসময়ের অভ্যাস, তাই আমি এরকম লাগার কোনো মানে পাচ্ছিলাম না। রাউন্ড দেয়ার জন্যে অনেকটা জোর করেই নিজেকে বিছানা থেকে টেনে তুললাম। পুলের গেটটা আগের মতোই থেমে থেমে শব্দ করছে, তবে আগের চেয়ে কিছুটা ভিন্নভাবে। অদ্ভুত কিছু একটা হচ্ছে—অনিচ্ছা নিয়ে যেতে যেতে ভাবলাম। নিজের কাজটা ঠিকভাবে করব বলে মন বানিয়ে নিলাম। দায়িত্বে একবার অবহেলা হয়ে গেলে, ওটা বারবার হতেই থাকে। আমি ওই ট্র্যাপে পড়তে চাচ্ছিলাম না। তাই এক হাতে ফ্ল্যাশলাইট আর অন্য হাতে কাঠের তলোয়ার আঁকড়ে ধরে আমি বেরিয়ে পড়ি।

সবমিলিয়ে রাতটা ছিল বেশ অদ্ভুত। রাত বাড়ার সাথে সাথে, বাতাস আরও জোরে বইতে লাগল, সেইসাথে আরও আর্দ্র হতে থাকল। আমার শরীরে অস্বস্তি হতে থাকলে আমি আর মনোযোগ ধরে রাখতে পারি না। প্রথমে জিম, অডিটোরিয়াম ও সুইমিং পুলে রাউন্ড দেয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। সব কিছুই ঠিকঠাক ছিল। প্রচণ্ড বাতাসে সুইমিং পুলের গেটটা এক পাগল মানুষের মতো সমানে তার মাথা ঝাঁকিয়ে যাচ্ছে। এটা কোনো নিয়ম মেনে হচ্ছে না। প্রথমে কয়েকবার মাথা ঝাঁকানো—হ্যাঁ, হ্যাঁ—তারপর না, না, না ভঙ্গিতে। তুলনাটা বেশ আজব শোনালেও তখন এরকমই লাগছিল।

স্কুল বিল্ডিংয়ের ভেতরে পরিস্থিতি স্বাভাবিক। আমি চারিদিকে তাকিয়ে লিস্টের পয়েন্টগুলো একবার চেক করলাম। আমার সেই অদ্ভুত অনুভূতিটাকে গোনায় না ধরলে, অন্যদিনের চেয়ে আলাদা আর কিছুই ঘটে নাই। আশ্বস্ত হয়ে আমি কেয়ারটেকারের রুমের দিকে এগুলাম। বিল্ডিংয়ের পুব দিকে ক্যাফেটেরিয়ার ঠিক পাশে বয়লার রুমটা আমার চেক লিস্টের একেবারে লাস্ট পয়েন্ট। বয়লার রুমটা আবার কেয়ারটেকারের রুমের একেবারে উল্টা দিকে। তার মানে ফিরে আসার সময় আমাকে দোতলার লম্বা হলওয়ে ঘুরে আসতে হবে। জায়গাটা সম্পূর্ণ অন্ধকার। যেসব রাতে আকাশ জুড়ে চাঁদ থাকে, হলওয়েতেও ছায়া ছায়া আলো থাকে। কিন্তু যখন চাঁদের আলো থাকে না, কিচ্ছু দেখা যায় না। ফ্ল্যাশলাইটের আলো পথে ফেলে দেখে নিতে হচ্ছিল কোথায় যাচ্ছি। সেই রাতে টাইফুন ধেয়ে আসছিল, আর আকাশেও কোনো চাঁদ ছিল না। মাঝে মাঝে মেঘগুলো একটু দূরে সরে ঠিকই, কিন্তু পুরো সময়ই তা ডুবে ছিল গাঢ় অন্ধকারে।

হলওয়ে দিয়ে অন্য সময়ের চেয়ে দ্রুত হেঁটে যাওয়ার সময় আমার বাস্কেটবল খেলার জুতো জোড়ার রাবারের সোল লিনোলিয়ামের মেঝেতে ঘষা খেয়ে জোরে শব্দ করছে। লিনোলিয়ামের মেঝেটা সবুজ রঙের। মসের তৈরি কুয়াশাচ্ছন্ন এক কার্পেটের মতো। চোখ বুজে এখনো আমি সেটার ছবি দেখতে পাই।

হলওয়ের ঠিক মাঝখানে স্কুলের প্রবেশপথের পাশ দিয়ে আসার সময় আমি চমকে উঠলাম—এটা কী! মনে হলো অন্ধকারে ভুলভাল কিছু দেখেছি। আমার সারা শরীর ঘেমে নেয়ে একাকার। কাঠের তলোয়ারটা আরও একটু শক্ত করে চেপে ধরে আমি সেই অস্পষ্ট জিনিসটার দিকে ঘুরলাম। জুতা রাখার আলমারির পাশের দেয়ালে ফ্ল্যাশলাইটের আলো জ্বলে উঠল।

সেখানে আমি নিজেকে দেখতে পেলাম! অন্যভাবে বলতে গেলে, একটা আয়না দেখলাম। আর সেই আয়নায় আমার প্রতিবিম্ব। গত রাতেও এখানে কোনো আয়না ছিল না। হতে পারে স্কুল কর্তৃপক্ষ আজকেই এটা এখানে রেখেছে। আমি তখনো হঠাৎ ভয়ে চমকে আছি। ওটা একটা পূর্ণ দৈর্ঘের লম্বা আয়না। আয়নার মধ্যে ওটা আসলে আমারই প্রতিবিম্ব বুঝতে পেরে কিছুটা আশ্বস্ত হলাম। এত চমকে ওঠার জন্যে নিজেকে আমার বেকুব মনে হচ্ছিল। এই তাহলে ঘটনা—যেন নিজের সাথে কথা বলছি আমি। অনেক বোকামি হয়েছে! ফ্ল্যাশলাইটটা নিচে রেখে পকেট থেকে সিগারেট বের করে ধরাই আমি। সিগারেটে টান দিতে দিতে আয়নার মাঝে নিজের দিকে তাকালাম। রাস্তা থেকে একটা অস্পষ্ট আলো জানলা দিয়ে এসে আয়নার ওপর পড়ছে। আমার পেছনে সুইমিং পুলের গেটটা এখনো আগের মতোই তালে তালে শব্দ করে যাচ্ছে।



সিগারেটে কয়েক টান দেয়ার পর হঠাৎ অদ্ভুত কিছু একটা খেয়াল করি। আয়নার ভেতরে আমার যে প্রতিবিম্ব সেটা আসলে আমার না। দেখতে পুরোপুরি আমার মতো মনে হলেও ওটা অবশ্যই আমি না। না, এখানেই শেষ নয়। ওটা আমি, তবে অন্য এক আমি। অন্য এক আমি যার কখনোই থাকার কথা না। আমি জানি না এটা কিভাবে বোঝাব। সেই অনুভূতিটা বোঝানো অনেক কঠিন।

এটুকু আমি বুঝতে পারলাম যে ওই অন্য এক আমি কোনো এক বিচিত্র কারণে আমাকে প্রচণ্ড ঘৃণা করে। গভীর অন্ধকার সাগরে ভাসমান বিশাল এক বরফ খণ্ডের মতো তীব্র ঘৃণা ওর ভেতরে। এত তীব্র সেই ঘৃণা যে কেউ চাইলেও তা দূর করতে পারবে না।

আমি সেখানে কিচ্ছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলাম বেআক্কেল হয়ে। আঙুলের মাঝখান থেকে পিছলে মেঝেতে পড়ে গেল আমার সিগারেট। সেই সাথে পড়ে গেল আয়নার ভেতরের সিগারেটটাও। একে অপরের দিকে তাকিয়ে আমরা ওখানে দাঁড়িয়ে ছিলাম। নড়তে পারছিলাম না যেন জাদুটোনা করে আটকে দেয়া হয়েছে আমার হাত-পা।

শেষ পর্যন্ত তার হাত নড়ল, ডান হাতের আঙুলের ডগা তার চিবুক ছুঁয়ে ছোট্ট এক পোকার মতো খুব ধীরে তার মুখে উঠে যাচ্ছে। হঠাৎ খেয়াল করলাম আমিও তাই করছি। মনে হচ্ছিল আয়নার ভেতরের মানুষটার প্রতিবিম্ব আমি আর সে আমার নিয়ন্ত্রণ নেয়ার চেষ্টা করেই যাচ্ছে।

শরীরের শেষ শক্তিটুকু প্রয়োগ করে ভীষণ জোরে চিৎকার দিয়ে ওঠতেই, জাদুটোনা থেকে মুক্ত হলাম আমি। ক্যান্ডো তলোয়ারটা তুলে সর্বশক্তি দিয়ে আয়নার ওপর সজোরে আঘাত করে আমার রুমের দিকে দৌড় দিলাম। কাচ ভেঙে পড়ার শব্দ শুনতে পেলেও ঘুরে তাকাই নি। রুমে পৌঁছে তাড়াতাড়ি দরোজা আটকে কাঁথার নিচে ঢুকি। মেঝেতে আধখাওয়া সিগারেটের টুকরা ফেলে আসা নিয়ে আমার বেশ চিন্তা হলেও কিছুতেই ওদিকে ফিরে যাওয়ার কথা ভাবতে পারি না আমি। সশব্দে বাতাস বইতে থাকল, আর সুইমিং পুলের গেটটাও ভোর পর্যন্ত তার সাথে পাল্লা দিয়ে গেল। হ্যাঁ, হ্যাঁ, না, হ্যাঁ, না, না, না...

আমার ধারণা গল্পের শেষটা কী হবে সেটা আপনারা সবাই এরই মধ্যে বুঝে গেছেন। আসলে সেখানে কোনো আয়নাই ছিল না।

টাইফুনটা চলে যাওয়ার পর সূর্য উঠল। বাতাসের বেগ কমে গেছে, এখন একটা রোদেলা দিন। আমি প্রবেশপথের দিকে গেলাম। আধখাওয়া সিগারেটের টুকরা আর কাঠের তলোয়ারটা যেখানে থাকার সেখানেই পড়ে আছে। কিন্তু আয়না কেন আয়নার একটা ভাঙা টুকরাও নাই। সেখানে কোনো আয়নাই ছিল না।

আমি ভূত দেখি নি। যা দেখেছি সেটা ছিলাম আমি নিজে। সেই রাতে কী ভয়টাই না পেয়েছিলাম সেটা আমি কখনোই ভুলতে পারব না। সেই রাতের কথা মনে পড়লেই আমার মনে হয়—এই পৃথিবীতে আমাদের কাছে সবচেয়ে ভয়ঙ্কর ব্যাপার বোধয় আমরা নিজেরাই। আপনার কী মনে হয়?

আপনারা হয়তো খেয়াল করেছেন আমার ঘরে এক টুকরা আয়নাও নাই। বিশ্বাস করুন, আয়না ছাড়া শেভ করার অভ্যাস করাটা তেমন সোজা ছিল না।



বাংলাদেশ সময়: ১৩৩৮ ঘণ্টা, মার্চ ৯, ২০১৬
টিকে/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।