ঢাকা, সোমবার, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

শিল্প-সাহিত্য

“বাংলাদেশের নাটকটা ঠিক ‘প্লে’ হয়ে ওঠে না”

নাট্যকলা ~ শিল্প-সাহিত্য | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৮৩৬ ঘণ্টা, মার্চ ২৩, ২০১৬
“বাংলাদেশের নাটকটা ঠিক ‘প্লে’ হয়ে ওঠে না”

বাকার বকুলের জন্ম ফরিদপুরে। মঞ্চনাটকের সঙ্গে জড়িত ১৮ বছর ধরে।

একাধারে নাট্যকার, নির্দেশক ও অভিনেতা। বর্তমানে নাটকের দল ‘প্রাচ্যনাট’র সঙ্গে যুক্ত।
তার নির্দেশিত নাটক ৫টি। অভিনীত নাটক রয়েছে প্রচুর। বর্তমানে ৩টি রচিত নাটক ঢাকা, সিলেট ও চট্টগ্রামে নিয়মিত প্রদর্শনী চলছে। আর প্রদর্শনীর অপেক্ষায় রয়েছে আরও দু’টি।

গত ১৮ মার্চ বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি প্রযোজিত বাকার বকুলের রচনা ও নির্দেশিত নাটক ‘মল্লুক’ দেখার পরে কথা হয় তরুণ নাট্যব্যক্তিত্য বাকার বকুলের সঙ্গে। বাংলানিউজের পক্ষে কথোপকথনে অংশ নেন নাট্য নির্দেশক ও গবেষক মেহেদী তানজির। নানা বিষয়ভিত্তিক আলোচনার মধ্য থেকে কিছু গুরুত্বপূর্ণ অংশ বাংলানিউজের পাঠকদের জন্য উপস্থাপিত হলো।

বাংলানিউজ: নাটক কেন করেন?
বকুল: জটিল প্রশ্ন... থিয়েটার আমার ভালো লাগে, প্রথমত। দ্বিতীয়ত, ছোটবেলা থেকেই রাজনীতির প্রতি আগ্রহ ছিলো। এ জগতের সাথে যুক্ত হওয়ার পর মনে হয়েছে, গণমানুষের কাছে পৌঁছানোর জন্য থিয়েটার একটি আদর্শ ভাষা হতে পারে। বলতে পারেন, থিয়েটার আমার ভাষা।

বাংলানিউজ: বর্তমানে বাংলাদেশের নাটক সম্বন্ধে আপনার মতামত কি?
বকুল: বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও ভারতের বিভিন্ন প্রদেশে নাটক দেখার সুযোগ হয়েছে আমার। এছাড়া ঢাকায় বিভিন্ন দেশের পার্ফরম্যান্সও দেখেছি। যদিও স্বীকার করছি, আমাদের দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের থিয়েটার ডিপার্টমেন্ট ও গ্রুপ থিয়েটারের কিছু দল থেকে কিছু এক্সপেরিমেন্ট হয়েছে, তাও খুব বেশিদিন ধরে নয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রে আমাদের নাটক ‘ডেডলি’। এখানে শরীরের গুরুত্ব দেওয়া হয় না। মূলত শব্দনির্ভর নাটক। নাটকটা ঠিক ‘প্লে’ হয়ে ওঠে না। অর্থাৎ শরীরটা ঠিক কার্যকর হয়ে ওঠে না। আসলে এটি আমাদের ভারতীয় উপমহাদেশের নাটকের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা বলে মনে করি।

বাংলানিউজ: বাংলাদেশের এই নাট্যবাস্তবতায় কেন আপনার নির্দেশিত নাটক দর্শক দেখবে?
বকুল: আমি মূলত একটা ‘প্লে’ তৈরি করতে চাই। খেলার মতো। যেখানে সমগ্র শরীর ব্যবহৃত হবে। সংলাপ গুরুত্বপূর্ণ, স্বীকার করেই নাটকে শরীর ও মনের সংযোগ ঘটাতে চাই। আমাদের ‘নগর থিয়েটার’-এ শরীর ব্যবহারের দৈন্যতা দেখা যায়। যদিও আমাদের লোকনাট্য কিন্তু ভিন্ন জায়গায় শক্তভাবেই দাঁড়িয়ে আছে। আমি সেই দৈন্যতাকে ভেঙে দিতে চাই আমার নাটকে। থিয়েটার যেহেতু যৌগিক ক্রিয়া সেহেতু পৃথিবীর সব স্থানের সব সৃষ্টিকে প্রয়োজন অনুযায়ী আমার থিয়েটারে প্রয়োগ ঘটাতে চাই। আমি কোনো ‘ফর্মে’ বিশ্বাসী না, আমার ভাষা দর্শকের কাছে পৌঁছানোর জন্য যেকোনো শৈল্পিক মাধ্যম বেছে নিতে আমার বিন্দুমাত্র আপত্তি নেই। যদিও আমার ভেতরে মেয়ারহোল্ডের ‘বায়োমেকানিক্স’র প্রভাব আছে, এরপরও আমি কারও কাছে দাসত্ব চাই না। যখন যা ঠিক লাগবে তখন তাই। প্রতিনিয়ত পরিবর্তিত হতে চাই কাজের অভিজ্ঞতার মাধ্যমে।

বাংলানিউজ: এতো গেলো নির্দেশক হিসেবে আপনার অবস্থান। নাট্যকার হিসেবে নিজের অবস্থান দয়া করে ব্যাখ্যা করবেন।
বকুল: এখনও ‘ভাংচুর’র মধ্যে আছি। খুঁজে ফিরছি নিজেকে...।

বাংলানিউজ: নাট্যচর্চার ক্ষেত্রে এদেশে কোন কোন প্রতিবন্ধকতা তাড়া করে বলে মনে করেন?
বকুল: বাংলাদেশে থিয়েটারে বর্তমানের ‘জেনারেশন’টা ঠিক তৈরি হয়ে ওঠেনি। ধরি, বাংলাদেশের ক্রিকেট টিমটি কিন্তু একদিনে তৈরি হয়ে ওঠেনি। কিন্তু এখন যখন ওরা খেলে তখন কতোটা স্বাবলম্বী মনে হয়। ঠিক তেমনি বাংলাদেশের থিয়েটারের সময় গিয়েছে কিন্তু স্বাবলম্বী কোনো কর্মীবাহিনী তৈরি হয়নি। এরা না শারীরিক না মানসিক না রাজনৈতিক দর্শনে না মূল্যবোধে, কোথাও যেনো দাঁড়িয়ে নেই। আর পড়ার ক্ষেত্রে ঘাটতি তো রয়েছেই। শিল্পকলা একাডেমিতে নির্দেশনা দিতে গিয়ে ১১ জন দক্ষ অভিনেতা পর্যন্ত পাইনি।

বাংলানিউজ: কেন এমনটা হচ্ছে বলে মনে করেন?
বকুল: এ শহরে মন দিয়ে কিছু করার সময় কোথায় মানুষের! কোনো নাচ কিংবা গান শিখতে হলে ছোটবেলা থেকে প্রস্তুত হতে হয়। আর এদেশে অভিনেতা হতে হলে কোনো প্রস্তুতির প্রয়োজন পড়ে না। এটি এখনও ব্যক্তিগত পর্যায়ের নাটক হিসেবেই রয়ে গেছে। এদেশেরই ক্রিকেট টিমে ফর্ম ভালো না হলে যতো ভালো খেলোয়াড়ই হও সুযোগ পাবে না। আর থিয়েটারে কোনো পরিবর্তন নেই। যতো অদক্ষ নাট্যকর্মীই হও না কেন তোমার পতন নেই কারণ, তুমি যে সিনিয়র। সিনিয়ররা যেমন এদেশের থিয়েটারকে এগিয়ে নিয়েছে আবার কেউ কেউ আটকেও দিয়েছেন। ঠিক এ কারণেই ন্যাশনাল থিয়েটার তৈরি হওয়া সম্ভব নয়।

বাংলানিউজ: বাংলাদেশের থিয়েটারে যে প্রতিবন্ধকতা রয়েছে বলে মনে করছেন তা থেকে মুক্তির উপায় কী হতে পারে বলে মনে করেন?
বকুল: সময়... আর তরুণদের এগিয়ে আসা প্রয়োজন। কিছু এক্সপেরিমেন্ট হচ্ছে তবে আরও প্রয়োজন। এ অবস্থার পরিবর্তন হবে ও পরিবর্তন হতে বাধ্য। আমাদের গ্রুপ থিয়েটার যেভাবে ‘ফর্মেটেড’ সেখানে এ পরিবর্তন কষ্টসাধ্য। তবে ইতোমধ্যেই কিন্তু বিভিন্ন দলের নাট্যকর্মীরা একত্রিত হয়ে ‘রেপার্টরি’ হিসেবে কাজ করা শুরু হয়ে গেছে। অনেক সিনিয়রই হয়তো তাদের দল থেকে কেউ সরে গিয়ে নাটক করুক, মানতে পারছে না। কিংবা কোনো তরুণ নির্দেশক কোনো দলে গিয়ে কাজ করলে, যদি কোনো সিনিয়রের দর্শনের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ না হয় তবে তকে গ্রহণ করা হয় না। এই কূপমণ্ডূকতা থেকে দূরে সরে আসতেই হবে।

বাংলানিউজ: পাঁচ বছর পরে বাংলাদেশের থিয়েটারকে কোথায় দেখতে চান?
বকুল: বাংলাদেশের দর্শক হুমড়ি খেয়ে পড়বে থিয়েটার দেখার জন্য। শুধুমাত্র আনন্দের জন্য নয় দর্শনগত কারণে।

বাংলানিউজ: আর দশ বছর পরে বাংলাদেশের থিয়েটার?
বকুল: বাংলাদেশের ক্রিকেট যেমন এখন অনেকের ঈর্ষার পাত্র, থিয়েটারও সেখানে দাঁড়াবে। পুরো পৃথিবী ধরে অগুনতি ভক্ত থাকবে এদেশের থিয়েটারের। এটা কোনো স্বপ্ন নয়, পরিকল্পনা।

বাংলানিউজ: আপনাদের মতো তরুণদের পরিকল্পনা বাস্তবায়নের অপেক্ষায় রয়েছে দেশ। বাংলানিউজের পক্ষে আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।
বকুল: বাংলানিউজের সব পাঠকদেরও ধন্যবাদ এবং থিয়েটার দেখার আমন্ত্রণ জানাচ্ছি।

বাংলাদেশ সময়: ১৫৫৬ ঘণ্টা, মার্চ ২২, ২০১৬
এসএস

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।