ঢাকা, সোমবার, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

শিল্প-সাহিত্য

নাট্য পর্যালোচনা: টার্গেট প্লাটুন | মেহেদী তানজির

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৮০৯ ঘণ্টা, মার্চ ২৮, ২০১৬
নাট্য পর্যালোচনা: টার্গেট প্লাটুন | মেহেদী তানজির

‘টার্গেট প্লাটুন’ নাটকটি রচনা ও নির্দেশনা দিয়েছেন মামুনুর রশীদ। জাতীয় নাট্যশালা রেপার্টরি প্রযোজনা হিসেবে নাটকটি ২০১২ সালের ২৭ জুলাই জাতীয় নাট্যশালায় প্রথম মঞ্চায়িত হয়।

চলতি বছরের ২৬ মার্চ মহান স্বাধীনতা দিবসে নাটকটি পুনঃমঞ্চায়িত হয়েছে। নাটকটি দেখে পর্যালোচনা লিখেছেন নাট্য নির্দেশক ও গবেষক মেহেদী তানজির।

কাহিনি সংক্ষেপ
মুক্তিযুদ্ধ বাঙালির জীবনে এক মহাকাব্যিক ইতিহাস। এই ইতিহাসের সঙ্গে মিশে রয়েছে অসংখ্য আত্মত্যাগের স্মৃতি। এই কাব্যময় রক্তাক্ত স্মৃতির গীতিময় নাট্যপ্রকাশ ‘টার্গেট প্লাটুন’।

একজন বাবুর্চি, যিনি যুদ্ধের সময় রান্না করেছেন, প্রয়োজনে অস্ত্র ধরেছেন- কিন্তু তার আত্মত্যাগের ইতিহাস হয়তো কোথাও লেখা নেই।

বিদ্যুৎ বিভাগে কর্মরত একজন ইঞ্জিনিয়ার, যিনি পাকিস্তানি ক্যাম্পে বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ করে দিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন যুদ্ধে। তার জীবন বলিদানের গল্প নিছক কল্পনা নয়।

একজন মেডিকেল কলেজের ছাত্রী অথবা একজন কুমোর অথবা একজন মূক, একজন বধির, একজন আদিবাসী যুবক জীবন বাজি রেখে যুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়েছেন বাংলায় এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্তে। সেই জীবন উৎসর্গের গল্প হয়তো ইতিহাসে কোথাও লিপিবদ্ধ হয়নি- তাই বলে তা কোনোভাবেই ইতিহাসবিচ্ছিন্ন কোনো গল্প নয়। এমনি হাজারও শ্রেণি, পেশা, গোত্র, ধর্মের মানুষ অকাতরে জীবন বলি দিয়েছে বলেই আমরা এই মানচিত্রের মালিকানা লাভ করেছি।

যুদ্ধ মানে তো শুধু যুদ্ধ নয়। দেশে দেশে সব মুক্তির লড়াইয়ে শক্তি সঞ্চার করেছে, প্রেরণা জুগিয়েছে এমন অনেকে, যাদের কথা মহাকাল মনে রাখে না। সেইসব অজানা গল্প আর অচেনা মানুষের আত্মাহুতির কাহিনি খুঁজে বের করার প্রয়াস টার্গেট প্লাটুন। বাদল, কুসুম, ফারুক, পিয়ারু, কালাপাহাড় নামগুলো হয়ত নাও মিলতে পারে নাম জানা বীরের তালিকায়, কিন্তু তাদের আত্মোৎসর্গের গল্প সত্য বলেই মুক্তি সংগ্রামের বিজয়গাঁথা নিয়ে আজও আমরা গর্বিত।

নাটকটি উপস্থাপনার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের লোকসঙ্গীতের গীতল ধারাকে অবলম্বন করে এর সব সংলাপ সুরে সুরে উপস্থাপন করা হয়েছে। এক্ষেত্রে ফ্রাঞ্জ ফানোর জাতির ধারণা সম্বলিত আলোচনা বিশেষভাবে কার্যকারী। নাটকটি জাতীয়তাবোধকে আরও গভীরতর করার প্রয়াসেই উপস্থাপিত হয়েছে। কিন্তু গীতল ধারা আঁকড়ে ধরতে গিয়ে নাটকে যা করা হয়েছে তা ফ্রাঞ্জ ফানোর মতে, বুদ্ধিজীবীরা যে সংস্কৃতির দিকে ঝুঁকে পড়েন, তা প্রায়শই খোলস নিয়ে মাতামাতি বৈ কিছু নয়। তিনি নিজেকে জনগণের মাঝে সম্পৃক্ত করতে চান; কিন্তু তিনি আঁকড়ে থাকেন তাদের বহিরাবরণ। নিভৃতে বয়ে চলেছে যে জীবন। যে জীবন প্রাচুর্যময় আর সর্বদা গতিশীল, তারই ছায়া শুধু এই বহিরাবরণ। গণমানুষের এই চরম অবধারিত নিঃস্পৃহতা দেখে মনে হয়, এটাই তাদের চরিত্র; কিন্তু আসলে যে মৌলিক সারবস্তু তাদের প্রাণ, যা প্রতিনিয়ত বদলে চলেছে।

আমরা টার্গেট প্লাটুন নাটকেও সঙ্গীতের ব্যবহার দেখতে পাই। গীতল ধারার অন্য উপাদানের প্রতি কম গুরুত্ব দিয়ে সুরকে উপজীব্য করা হয়েছে। নাটকটিতে পৃথকভাবে কোনো চরিত্রকে বিশেষ প্রাধান্য দেওয়া হয়নি কারণ নাট্যকার নাটকটির মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধকে একটি গণজাগরণ হিসেবে উপস্থাপন করতে চেয়েছেন। সেক্ষেত্রে আমরা কার্ল মার্কসের ‘নতুন ক্ষমতা’ হিসেবে বিশ্লেষণ করতে পারি। জনগণের সমষ্টিতে ক্ষমতা তৈরি হয়। জনগণ একত্রিত হয়ে একে অন্যকে সাহায্য করে। লেনিন একে দ্বৈত ক্ষমতা হিসাবে আখ্যা দিয়েছেন। ক্ষমতা থাকে রাষ্ট্রের ও বিপ্লবীদের হাতে তবে কার্ল মার্কস মনে করতেন, কৃষক শ্রেণির রাজনৈতিক কোনো সচেতনতা নেই কিন্তু এই আন্দোলনে কৃষক শ্রেণিকে ভূমিকা রাখতে দেখা যায়। আন্তনিও গ্রামসি অবশ্য কার্ল মার্কসের মতো কৃষক শ্রেণিকে ‘আলুর বস্তা’ হিসাবে পরিগনিত করতে নারাজ ছিলেন। নাটকটিতেও সর্বশ্রেণির মানুষের অংশগ্রহণ দেখতে পাই যদিও চরিত্রায়নের ক্ষেত্রে ক্ষমতাকে এড়িয়ে যেতে দেখা যায়। সংলাপ ব্যতীত নাটকটিতে বোঝার উপায় নেই, কে কৃষক আর কে ছাত্র। অজয় মারাককে একজন আদিবাসী বলে কখনই মনে হয়নি ঠিক তেমনি আরজু, শেফালি, কুসুম, ফজল, সুমন, সুশীল সবাই তাদের যথাযথ চরিত্রায়নে ব্যর্থ হয়েছেন।



ফুকোর ইতিহাস সম্বন্ধে বিশ্লেষণ অনুযায়ী দেখতে পাই, কোনো আন্দোলন সরলরৈখিক ঘটনার মাধ্যমে হয় না। ইতিহাস বিচ্ছিন্নভাবে খণ্ড খণ্ড উপায়ে বিরাজ করে। কোনো একজন নেতার ডাকে বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধ সম্পূর্ণভাবে সংগঠিত হয়নি। সেখানে জনগণের সচেতনতাবোধ কাজ করেছে। একসময় দেশের সর্বস্তরের মানুষ রুখে দাঁড়িয়েছে। নেতৃত্বের গুরুত্ব থাকলেও আন্দোলনে জনগণই মূল। তাদের সমাজ ও জাতীর প্রতি এই নৃশংসতার বদলা নিতে তারা নিজেরাই উদ্বুদ্ধ হয়েছে। কিশোর বয়সেই সুশীল নিজের বুকে বোমা বেঁধে নিজেকে উৎসর্গ করেছে। নারী-পুরুষ জাত-পাত ভুলে নেমেছে যুদ্ধের ময়দানে। তারা বুঝেছে শুধুমাত্র সহিংসতার মাধ্যমেই জাতীর মুক্তি লাভ সম্ভব। ফ্রাঞ্জ ফানো যেমন মনে করেন, উপনিবেশ থেকে মুক্তির জন্য সহিংসতাই একমাত্র পথ। এই নাটকেও আমরা তার প্রভাব দেখতে পাই।



অবরাজনীতির প্রভাব দেখা যায় নাটকটিতে। ও. হেনলনের ব্যাখ্যা অনুযায়ী দেখতে পাই, ভিন্ন ধরনের প্রতিরোধ। আপাতদৃষ্টিতে মনে হতে পারে সাংস্কৃতিক পার্থক্য, যেমন পিয়ারু চরিত্রটি বাবুর্চি হিসাবে মিলিটারি ক্যাম্পে কাজ করে, সেখানে শেয়াল দেখিয়ে মিলিটারিদের ভয় দেখান ও তাদের কাছ থেকে মেয়েদের রক্ষার্থে কৌশলের আশ্রয় নেন। পিয়ারুর চরিত্রায়নে এই অবরাজনীতির প্রভাব নাটকটি প্রযোজনায় পরিষ্কার ভাবেই কার্যকর।

নাটকটি নিম্নবর্গের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা যেতে পারে, যেখানে একজন নেতা বা ঊর্ধ্বতন কোনো ব্যক্তির কারণে আন্দোলনের সূচনা হয়নি। নিম্নবর্গের মানুষের নিজস্ব রাজনৈতিক বোধ থেকেই তারা আন্দোলনে নেমে এসেছে, সেখানে কোনো একজন ব্যক্তি সব ক্ষমতা দখল করেনি। ফুকো ক্ষমতা সম্বন্ধে যে ব্যাখ্যা দিয়েছেন তা এখানে প্রযোজ্য। নাটকটিতেও ক্ষমতা স্তরায়িত অবস্থায় রয়েছে। কোনো একজনের দ্বারা সব ক্ষমতা প্রকাশের চিন্তা নেই। মূলত ক্ষমতা নেটওয়ার্কের মতো কাজ করছে। সবাই মিলে একটি দলে পরিণত হয়েছে। যেখানে একজন ইঞ্জিনিয়ার, ডাক্তারি পড়া ছাত্রী, কৃষক, আদিবাসী, বাবুর্চি, হিন্দু, মুসলিম সবার প্রয়াসে যুদ্ধ সংগঠিত হয়েছে। প্রত্যেকে নিজ ক্ষেত্র থেকে তাদের দক্ষতা প্রকাশ করেছে। একজনের উপরেই সবাই নির্ভরশীল নয় আবার অস্ত্র হাতে মিলিটারিরা ক্ষমতা প্রয়োগ করলেও রান্নার ক্ষেত্রে পিয়ারুর ক্ষমতা বেশী। তাই ক্ষমতা একজনের কাছে পুঞ্জীভূত নয়।

নাটকটিতে ম্যাকাভিলির ‘স্যটুর’র ধারণা থেকে গ্রামসির শাসন প্রক্রিয়া ব্যাখ্যা করার সুযোগ রয়েছে। ‘স্যটুর’ এমন একটি কাল্পনিক প্রাণী যার উপরের অংশ মানুষের ও নিচের অংশ পশুর অর্থাৎ একই সঙ্গে মানবীয় ও একই সঙ্গে জান্তব। দুইভাবে শাসনকার্য পরিচালনা হতে পারে- এক, সম্মতি আদায়ের মাধ্যমে (মানবীয়) ও দুই, বল প্রয়োগ (জান্তব) করে। এখানে দেখা যায়, পাকিস্তানি বাহিনী বল প্রয়োগের মাধ্যমে শাসনের চেষ্টা করছে তার প্রভাব সরূপ রুখে দাঁড়াচ্ছে আপামর জনগণ, আবার এরই মধ্যে যখন মেয়েদের ধরে আনে মিলিটারিরা, তখন তাদের বশে আনার জন্য খাবার দেওয়ার মাধ্যমে সম্মতি আদায়ের প্রচেষ্টাও চলে।

কার্ল মার্ক্সের মতে, মানুষ খেতে পারলে তবেই চিন্তা করতে পারবে- এরূপ ব্যাখ্যা নাটকটিতে কার্যকর, তাই ভূগোলের জ্ঞান ও অস্ত্র নিয়ে আসার চেয়ে খাবারের গুরুত্ব ঢের বেশী। এই খাবারের উপলক্ষ ধরেই পিয়ারুর মিলিটারি ক্যাম্পে প্রবেশ ও তথ্য সংগ্রহ করা। পিয়ারু চরিত্রে নানা বৈচিত্র্য দেখা যায় নাটকে যা অভিনেতা অনেকাংশেই উপস্থাপন করেছেন।

বাংলাদেশের জাতীয়তাবোধের প্রতীকী এ নাটক। এখানে সব রাজাকার, মিলিটারিদের মন্দ হিসাবে দেখানো হয়েছে জাতীয়তাবাদী চেতনতাকে আরও সুসংগঠিত করার জন্য। আমরা চরিত্রায়নের ক্ষেত্রে রাজাকার ব্যতীত সব বাঙালিদের সৎ এবং নৈতিক হিসাবে দেখি। অন্যদিকে, সব পাকিস্তানি সৈনিকদের অমানবিক ও মদ্যপ হিসেবে রূপায়িত হতে দেখি যেনো সব আর্মিরা মানুষদের নির্বিচারে হত্যা করতে খুবই ভালবাসে। পাশাপাশি বাঙালিরা চরম নৈতিক একটি জাতি যারা সবার তরে সবাই, তাদের কোনো অপরাধ কখনও ছিলো না, কখনও তারা কোনো অপরাধ করতেও পারে না। নাটকটিতে তাই মুক্তিযোদ্ধা সব নারী পুরুষদের একই সঙ্গে অংশ নিতে দেখা যায়, তাদের মধ্যে কোনো বিরোধ নেই, অন্যদিকে শান্তি কমিটির সদস্য ও পাকিস্তানিদের অনৈতিক হিসেবে চরিত্রায়ন করতে দেখা গেছে। তাই অনেকাংশেই চরিত্রগুলোকে একরৈখিক মনে হয়েছে।

সব আলোচনা অতিবাহিত হলেও এ কথা বলাতে কোনো হীনমন্যতা নেই, নাটকটির দৃশ্য, আলোক, পোশাক পরিকল্পনা ও কার্যকরী রিদম নাটকটিকে বর্তমান সময়ে বাংলাদেশের মঞ্চে একটি সফল নাটক হিসেবেই আত্মপ্রকাশ করতে সক্ষম হয়েছে। একই সঙ্গে বাংলাদেশের মঞ্চে এমন বিশালাকৃতির পরিবেশনা আত্মবিশ্বাস জন্ম দিতে সহায়তা করবে, এটি স্বীকার করা ব্যক্তিগত ভাবে বাধ্যতামূলক মনে করি।  



বাংলাদেশ সময়: ১৬৪৯ ঘণ্টা, মার্চ ২৮, ২০১৬
এসএস

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।