ঢাকা, সোমবার, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

শিল্প-সাহিত্য

শংকরভাগের চড়ক পূজা | সুরজিত সরকার

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৫০৪ ঘণ্টা, এপ্রিল ১০, ২০১৬
শংকরভাগের চড়ক পূজা | সুরজিত সরকার ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

চলছে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন। গরমের সঙ্গে পাল্লা দিয়েই চারপাশে চলছে ভোটের প্রচারণা।

তবে থেমে নেই নিয়ম-আচারের আয়োজন। নাটোর শহর থেকে প্রায় ছয় কিলোমিটার দূরে শংকরভাগ গ্রামে যখন ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা গিয়ে দাঁড়ালো তখন দুপুর ১২টা। রোদ তখন কড়া শাসন চালাচ্ছে, মনে করিয়ে দিচ্ছে এখন চৈত্রমাস।

শংকরভাগে এখন চৈত্রসংক্রান্তির প্রস্তুতি চলছে। প্রায় দুই আড়াইশো বছর ধরে এ এলাকায় অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে চড়ক পূজা। আগামী ১৩ এপ্রিল, ৩০ চৈত্র, বুধবার সকাল থেকে শুরু হবে পূজা। চড়ক উপলক্ষে বসবে মেলা।

আয়োজকদের কোথায় পাওয়া যাবে জানতে চাইলে এক বৃদ্ধ আঙ্গুল উঁচিয়ে দেখিয়ে দেন বাজারের ভেতরে হারা ঠাকুরের (হারান চন্দ্র গোস্বামী) মিষ্টির দোকান, সেখানে যান। আয়োজন সবাই মিলে করে। কিন্তু তিনি সব বলতে পারবেন।

মিষ্টির দোকানে তখন চড়ক পূজার আলোচনাই চলছিলো।

শংকরভাগে বাস করেন ১৪০ ঘর আদিবাসী। এছাড়াও আসে-পাশে মিলিয়ে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের সংখ্যা কম নয়। সবাই মিলেই চৈত্র মাসের শেষ দিনে এক হয়ে যায় উৎসব উদযাপনে।

দেখা মিললো হারা ঠাকুরের। পরিচয় পর্ব শেষে পূজার প্রস্তুতি সম্পর্কে জানতে চাইলে, উত্তরে আসে হারানের শুকনো মুখের হাসি।

একটু থেমে জানান, এবার আমারে চড়ক পূজা, মেলার আয়োজন কোরা কটিন হয়্যা গ্যাছে। গ্যালোবার গাছ ভ্যাংগে যাওয়াত এবার নুতন গাছের খুব দোরকার। টিএনও-ডিসি স্যারের কাচে আমরা একখান সোরকারি গাছ চাওয়া হছে। নতুন গাছ পাওয়া না গেলে-পুরাতন গাছ দিয়েই পূজা কোরা লাগবি।

গল্পের মাঝেই চলছে হারানের বিক্রিবাট্টা।

বলেন, আমারে ‍গাঁয়ে ১৪০ ঘর আদিবাসী আছে আর আমরা আছি ব্রাক্ষণ। সোবাই মিল্যা-মিশ্যা থাকিচ্চি। অন্য ধর্মের মানুষও পূজাত সাহায্য করে। আমারে এটি এডা কুনু নিদিষ্ট ধর্মের উৎসব না। সোবার উৎসব।

এবছর আয়োজনে কি কি থাকছে জানালেন হারান। তার প্রশ্ন ছাওয়ালের বিয়াত নিমনতন্ন না করলে কি কেউ আসে, নিজেই উত্তর দেন-আসে না। সেরোম চড়ক পূজার একদিন আগে রাইতে পুকুর পাড়ে যায়ে গাছেক নিমনতন্ন করে আসা লাগে। গাছের উদ্দেশে পূজাও দেওয়া লাগে।

একইসাতে শিববাড়ি মন্দিরে চলে হর-পার্বতীর পূজা। পরলোকে শিব ঠাকুর স্বর্গে যাওয়ার বর দিবেন বলেই তো সোবাই বিশ্বাস করে।

এবছরও চড়ক পূজা এবং চৈত্রসংক্রান্তি উপলক্ষে দু’দিনব্যাপী মেলা চলবে জানালেন তিনি। মেলায় পাওয়া যাবে চিনি-গুঁড়ের জিলাপী, মুড়ি-মুড়কি, কদমা, চিনির তৈরি হাতি-ঘোড়া, মিষ্টি, হাওয়াই মিঠাই, মহিষের দুধের ঘোল, গরম গরম ভেজে নামিয়ে দেওয়া হবে ফোসকার মতো ফোলা ফোলা পুরি, পেঁয়াজু, মেয়েদের জন্য থাকবে কাঁচের চুড়ি, মালা, ফিতা, টিপ, সিঁদুর, আজকাল অবশ্য আধুনিক গহনাও পাওয়া যায়। গৃহির জন্য থাকবে লোহার তৈরি জিনিসপত্র দা, বটি, ঘটি, বাটি, খুন্তি এবং কাঠের তৈরি নানা জিনিস। আরও থাকবে ভিউকার্ড, ঝিনুকের তৈরি শোপিস-গহনা, শাঁখ-শাঁখা-পলা আরও কতকি, যোগ করেন হারা ঠাকুর।

“তাও মুনে করেন আড়াইশো বছর ধরে এটি চড়ক পূজা হচ্ছে। আগে নাকি আরও বড় করে আয়োজন হতো। তখন যারা চড়ক গাছে ঘুরতো তারেক আগের দিন রাতে মন্ত্র দিয়ে ছেড়ে দেওয়া হতো। তারা আগুনের ওপর দিয়ে খালি পায়ে হাঁটতো, ধারালো সশস্ত্রের ওপর খালি পায়ে দাঁড়াতো। কিন্তু কাটতো না, পুড়তোও না। এখনও অত নিয়ম পালন করা হয় না। শুধু যারা শরীরে বড়শি ফুটান তারা দু’দিন বাড়িত যাইতে পারে না। মন্দিরে থাইকে কটিন নিয়ম পালন করা লাগে”।

মেলা নিয়ে কথা বলতে এর মধ্যে আরও অনেকে চলে এসেছেন হারা ঠাকুরের দোকানে।

উৎসব শেষে পুকুরে ডুবিয়ে রাখা চড়ক গাছ চৈত্রসংক্রান্তির সকালে তুলে আনা হয়। পরিষ্কার করে পূজা শেষে চড়কের জন্য প্রস্তুত হয়। তিনটি বাঁশ একসঙ্গে বেঁধে লাল কাপড়ে জড়িয়ে নেওয়া হয়। ৪০-৫০ ফুট উঁচু গাছের মাথায় যে চড়ক লাগানো হয় পূজা শেষে দুধ ও জল দিয়ে স্নান করানো হয়।

যাদের পিঠে বান (এক ধরনের বড় বড়শি) ফোঁড়ানো হয়। তারা সারাদিন জল না খেয়ে উপবাস করেন।

এরপর দুপুরের পর থেকে শুরু হয় মূল আয়োজন। একে একে সন্ন্যাসীদের নেওয়া হয় শিববাড়ি মন্দিরে। সেখানে মন্ত্র এবং ওষুধি গাছের সাহায্যে সন্ন্যাসীদের আচ্ছন্ন করা হয়। কোমড়ে বেঁধে দেওয়া হয় লালসালু। যার ভেতরে থাকে মন্ত্রপুত কড়ি এবং ওষুধি গাছ। ফলে কোনো রকম সমস্যায় পড়তে হয় না তাদের।

পাশ থেকে কথা কেড়ে নিয়ে কয়েকজন বলেন, এর কারণে ব্যথাও লাগে না। মন্দিরের সামনে শোয়ানোর পরে পিঠে জোরে আঘাত করা যেন রক্ত সরে যায়। চামড়ার তিনটি স্তর থেকে বিশেষ কায়দায় দু’টি স্তর আলাদা করা হয়। বাকি যে পুরু স্তর সেখানো ফোঁড়া হয় বড়শি। এর সঙ্গে দড়ি বেঁধে চড়ক গাছের সঙ্গে ঘোরানো হয় সন্ন্যাসীদের।

এসময় মঙ্গল কামনায় সন্তানদের শূন্যে তুলে ধরেন অভিভাবকরা। সন্ন্যাসীরা ঘুরে ঘুরে সেসব শিশুদের মাথা স্পর্শ করেন। অনেক সময় কোলেও তুলে নেন। ছিটিয়ে দেন খাগরাই-বাতাসা।

চড়ক পূজা শেষে সন্ন্যাসীরা খাবার স্পর্শ করেন।

শ্যামল চন্দ্র গোস্বামী বহু বছর ধরে চড়ক গাছে উঠছেন। জানান তার অভিজ্ঞতার কথা। সামান্য ব্যথা হয়। তবে দুই দিনের মধ্যে সেরে যায়।

আগ্রহ নিয়ে এগিয়ে আসেন চড়ক পূজা কমিটির সভাপতি সত্য নারায়ণ। বলেন, চড়ক গাছ মাটিতে পোঁতার সময় পাশে চার-পাঁচ হাত গভীর গর্ত খোঁড়া হয়। ভেতর মাটি চাপা দেওয়া হয় এক জোড়া কবুতর। পরদিন গাছ তুলে পুকুরে নিয়ে যাওয়ার সময় জীবিত অবস্থায় ওই এক জোড়া কবুতর তুলে আনা হয়। আরেক গর্তে রাখা হয় ঘিয়ের প্রদ্বীপ।

চড়ক পূজা পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশের হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ লোকোৎসব। চৈত্রের শেষ দিনে এ পূজা অনুষ্ঠিত হয়। চড়ক পূজার উৎসব চলে বৈশাখের প্রথম দু-তিন দিনব্যাপী। জনশ্রুতি রয়েছে, ১৪৮৫ খ্রিষ্টাব্দে সুন্দরানন্দ ঠাকুর নামে এক রাজা এ পূজা প্রথম শুরু করেন।

বাংলাদেশ সময়: ১৩০২ ঘণ্টা, এপ্রিল ১০, ২০১৬
এটি/এসএইচ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।