ঢাকা, সোমবার, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

শিল্প-সাহিত্য

বাঙালির অস্তিত্ব ও মননের কাজী নজরুল

সৈয়দ ইফতেখার আলম, নিউজরুম এডিটর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০০১৫ ঘণ্টা, মে ২৫, ২০১৬
বাঙালির অস্তিত্ব ও মননের কাজী নজরুল

ঢাকা: তার লেখা প্রেম-ভালোবাসা, আবেগ-মায়া-মমতা হৃদয় ছুঁয়ে বাংলা সাহিত্যকে দিয়েছে নতুন এক অস্তিত্ব। তার কলম এর চেয়েও বড় অস্তিত্বের শেকড় গেঁড়েছিলো অন্যায়ের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের মাধ্যমে।

যখন আর কেউ তা পারেনি, পেরেছিলেন কাজী নজরুল। সেসময়ই তিনি বাঙালির মননে জায়গা করে নেন আপন মহিমায়।

ঠিক যেন ‘অসংকোচ প্রকাশের দুরন্ত সাহস’ হয়েই লিখে গেছেন যতক্ষণ চলেছে দু’হাত। দেখেছেন সমাজে যত যা অসহ্য- উৎক্ষিপ্ত নয়নে দৃষ্টি দিতে সময়ক্ষেপণ করেননি। লিখে গেছেন; ‘চির-উন্নত মম শির’ প্রতিপাদ্যে।

বর্তমান সমাজে সাম্প্রদায়িকতার থাবা সুষ্ঠুভাবে এগিয়ে চলার অন্যতম প্রতিবন্ধকতা। রয়েছে নারী-পুরুষ বৈষম্য আর শ্রম অধিকারের ঘাটতি। ধর্ম নিয়েও চলছে আস্তিকতা এবং নাস্তিকতার দ্বন্দ্ব। এসবের ঊর্ধ্বে উঠে সেই উনিশ শতকের শুরুতেই কাজী নজরুল বলে গেছেন অসাম্প্রদায়িক চেতনার কথা, গেয়ে গেছেন সাম্যের সুর। বাদ যায়নি বাঙালি নারী-পুরুষের সমঅধিকারের প্রসঙ্গ, সেইসঙ্গে গরিব-মেহনতী শ্রমিকের অধিকারের কথাও। এমনকি ধর্মের পরম বাণীও ছুঁয়েছে নজরুলের কালি-কলম। শুধু জাতীয় কবি বলে নন, তিনি গেঁথে আছেন বাঙালির অস্তিত্ব ও মননের কবি হয়ে।

মহান এই ব্যক্তিত্বের ১১৭তম জন্মবার্ষিকীতে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ। কাজী নজরুল ইসলাম এমন এক প্রতিভার নাম যার স্থান প্রতিটি বাঙালির হৃদয়ে; প্রতিটি বাঙালির ঘরে-আঙিনায়।

‘মোরা এক বৃন্তে দু’টি কুসুম হিন্দু-মুসলমান/ মুসলিম তার নয়ন-মণি, হিন্দু তাহার প্রাণ/ এক সে আকাশ মায়ের কোলে/ যেন রবি শশী দোলে/ এক রক্ত বুকের তলে, এক সে নাড়ির টান’।

কিংবা- ‘গাহি সাম্যের গান-,/ যেখানে আসিয়া এক হয়ে গেছে সব বাধা-ব্যবধান,/ যেখানে মিশছে হিন্দু-বৌদ্ধ-মুস্লিম-ক্রীশ্চান’।

অসাম্প্রদায়িক নজরুলকে ব্যাখ্যা করতে এর বেশি কিছু প্রয়োজন পড়ে না।

এদিকে নারী-পুরুষের বৈষম্য বিলোপেও সমাধান ওই নজরুলই। তার কালজয়ী লেখা: ‘সাম্যের গান গাই-/ আমার চক্ষে পুরুষ-/ রমণী কোনো ভেদাভেদ নাই!/ বিশ্বের যা কিছু মহান/ সৃষ্টি চির কল্যাণকর/ অর্ধেক তার করিয়াছে নারী,/ অর্ধেক তার নর’।

নজরুল গবেষক অধ্যাপক রফিকুল ইসলামের ভাষায়, যে কথা সেসময় কেউ বলে ওঠার সাহস করেননি, তা করেছিলেন নজরুল। শত চোখ রাঙানিকে উপেক্ষা করেই তিনি মন খুলে মুক্তমনে লিখেছেন।

হে দারিদ্র্য, তুমি মোরে করেছ মহান। / তুমি মোরে দানিয়াছ খ্রীষ্টের সম্মান/ কণ্টক-মুকুট শোভা। -দিয়াছ, তাপস,/ অসংকোচ প্রকাশের দুরন্ত সাহস;/ উদ্ধত উলঙ্গ দৃষ্টি, বাণী ক্ষুরধার,/ বীণা মোর শাপে তব হলো তরবার!

তিনি নিজে সবসময় ছিলেন মেহনতী মানুষের সারিতে। ঠিক তেমনি কথাও বলতেন তাদের পক্ষে।

এছাড়া কবি এক হাতে হামদ-নাত ও শ্যামা সংগীত লিখে গেছেন। কৃপণতা কোনটিতেই ছিল না বিন্দুমাত্র। যা অনেক প্রভাবশালী লেখক-কবি-সাহিত্যিকও সেসময় লিখে দেখাতে সক্ষম হননি। এমনকি আজও এ সমাজ যা নিয়ে বিভক্ত- সেই বিভক্তিকে তুচ্ছজ্ঞান করে কাজী নজরুল পাড়ি জমিয়েছিলেন সুবিশাল এক পথে। যার উপলব্ধি বাঙালির হয়ত আজ হয়!

কবি ভাষণে বলেছেন, ‘বিশ্বাস করুন আমি কবি হতে আসিনি, আমি নেতা হতে আসিনি- আমি প্রেম দিতে এসেছিলাম, প্রেম পেতে এসেছিলাম- সে প্রেম পেলাম না বলে আমি এই প্রেমহীন নীরস পৃথিবী থেকে নীরব অভিমানে চিরদিনের জন্য বিদায় নিলাম...’।

‘...আমি ইন্দ্রানী-সূত হাতে চাঁদ ভালে সূর্য/ মম এক হাতে বাঁকা বাঁশের বাঁশরি আর হাতে রণ তূর্য...’ একদিকে প্রেম, একদিকে দ্রোহ- মূলত এই দুয়ে মিলেই নজরুলের জাগানিয়া সত্তা। আর কি নামে ডাকা যায় তাকে! তিনি একাধারে প্রেমের কবি, বিদ্রোহের কবি, সাম্যের কবি, অসাম্প্রদায়িকতার কবি, মানবতার কবি, জীবন বন্দনার কবি।

শিল্পী জীবনের সীমিত পরিসরে নজরুলের বহুমুখী প্রতিভার মূল্যায়ন সময়সাপেক্ষ, তা সন্দেহাতীত। তবে এ কথা বলা যায় প্রেম-দ্রোহ যার মনে-মননে এবং কবিতায় ফুটে উঠতে পারে একই হাতে- সে কবি মহাকবি না হয়ে কি পারেন!

কাজী নজরুল ইসলাম তার সময়কে ভেদ করে এগিয়েছেন। ব্যক্তি জীবনে যেটুকু কাব্য ও সাহিত্য চর্চার সময় তিনি পেয়েছেন; কাজ করে গেছেন মানুষের জন্য। তার মানবসত্তা এবং বিদ্রোহ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে কেউ কেউ কবিকে বহুবিধ বিশ্লেষণে ভূষিত করেছেন। যার মধ্যে বিদ্রোহী, সাম্য, মানবতার মুক্তিদূত এবং সর্বতোভাবে প্রেমের সারথি অন্যতম।

শুধু তাই নয় প্রেম প্রকাশের ক্ষেত্রে নজরুলের আরেক ধরনের বিদ্রোহ সামনে ভেসে আসে। যেখানে কখনও প্রেমিকসত্তা নিরঙ্কুশভাবে বিলীন প্রেমাস্পদের কাছে অথবা কখনও বা প্রেমবিদ্রোহ জাগরুক থাকে বিরহের যূপকাষ্ঠে নিজেকে বলি দিয়ে। প্রেমের ক্ষেত্রে নজরুলের এই যে দ্বিমুখী বিদ্রোহ সেটি তার বিদ্রোহী চেতনাকে প্রাণবন্ত করার আরেকটি দিকও হতে পারে!

গল্প-কবিতা বাদেও নজরুল প্রেমের সংগীতে উপমহাদেশে একটি পথিকৃৎ নাম। কালজয়ী গান তিনি লিখেছেন: ‘প্রিয় এমন রাত যেন যায় না বৃথাই/ পরি চাঁপা ফুলের শাড়ি খয়েরী টিপ,/ জাগি বাতায়নে জ্বালি আঁখি প্রদীপ,/ মালা চন্দন দিয়ে মোর থালা সাজাই...’।

কিংবা ‘আলগা করো গো খোঁপার বাঁধন/ দিল ওহি মেরা ফাস গেয়ি/ বিনোদ বেনীর জরীণ ফিতায় আন্ধা ইশক মেরা কাস গেয়ি...’।

নজরুলের সাহিত্য রচনাকাল ১৯১৯ থেকে ১৯৪২ পর্যন্ত (বাংলা ১৩২৬ থেকে ১৩৪৯)। কাজী নজরুল ইসলাম ওরফে দুখু মিয়া জন্মগ্রহণ করেন মে ২৫-জ্যৈষ্ঠ ১১ ১৮৯৯ সালে। বেড়ে ওঠা চমর দরিদ্রতার মধ্যে। আর এতেই জীবন থেকে শিক্ষা তার। বিশ শতকের প্রথম চার দশকের মধ্যেই নজরুলের মানস গঠন ও বিকাশ। সাহিত্যে তাই প্রতিফলিত হয়েছে প্রথম মহাযুদ্ধের নানা দিক। যুদ্ধের উত্তেজনাকে তিনি অনুভব করেছিলেন ভীষণভাবে। স্বপ্ন দেখেছিলেন নবজাগরণের।

নজরুল নিয়ে গবেষণার কাজ করা ড. রিটা আশরাফ তার বইয়ে লিখেছেন, এ সময়ে নজরুলের দৃষ্টিপথে উদিত হয়েছে ১৯০৫ সালে আয়ারল্যান্ডের ‘সিনফিন’ আন্দোলন উদ্ভূত প্রবল গণ-উত্থান।

১৯১৯ সালের ১৩ এপ্রিল অমৃতসরের জালিয়ানওয়ালাবাগে সংঘটিত বর্বর হত্যাকাণ্ডকে স্মরণ করে তিনি লিখেছেন ‘ভায়ারের স্মৃতিস্তম্ভ’ প্রবন্ধ। ১৯২০ সালের খিলাফত-অসহযোগ আন্দোলন ও রুশ বলশেভিক সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের পটভূমিতে রচিত হয়েছে তার ‘মৃত্যুক্ষুধা’ (১৯৩০) উপন্যাস। নজরুল একই সঙ্গে আলোড়িত হন মোস্তফা কামাল পাশার দ্বারা। কেননা তুরস্কই প্রথম মুসলিমপ্রধান দেশ, যে দেশ থেকে রাজতন্ত্রের উচ্ছেদ, পর্দাপ্রথা বিলোপ ও মোল্লাতন্ত্র দূরীভূত হয়েছিল। তখনই তিনি তেমন এক বাঙালি রাষ্ট্রের স্বপ্ন দেখেই ছিলেন বলা চলে!

ব্রিটিশ আমনকে তিনি ঘৃণার চোখে দেখে- বলেছিলেন, চট্টগ্রামের অস্ত্রাগার লুণ্ঠন ছিল ব্রিটিশদের প্রতি বিপ্লবীদের প্রত্যক্ষ সংগ্রাম। লিখেছিলেন ‘কুহেলিকা’ (১৯৩১) উপন্যাস।

তার আগে নজরুল আরেকটি উপন্যাস লিখেছিলেন বাঁধন হারা (১৯২৭)।

শৈশবে নজরুলকে স্বপ্নময় কোনো পৃথিবী হাতছানি দিয়ে ডেকেছিল কিনা তা জানা যায় না। প্রকৃতির কোলে স্বাভাবিক নিয়মেই বেড়ে উঠেছিলেন দুখু মিয়া। সেখানে চাঁদ, সূর্য, আকাশ, বাতাস, মাটি, বৃক্ষ-লতাসহ অবারিত প্রকৃতিকে নিজের করে পেয়েছেন। বলা যায়, সরাসরি প্রকৃতির কাছ থেকেই জীবনের প্রথম পাঠ কাজী নজরুলের।

সৈনিক জীবন শেষে সাংবাদিকতার পাশাপাশি বেতারে কাজ করেছেন নজরুল। এ সময় তার সৃষ্টিকর্ম আরও বেশি বিস্তৃত হয়। তবে ১৯৪২ সালে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। হারিয়ে ফেলেন বাকশক্তি। তবে তার অসুস্থতার বিষয়ে সুস্পষ্টরূপে জানা যায় ১৯৪২ সালের জুলাই মাসে। এরপর তাকে মূলত হোমিওপ্যাথি এবং আয়ুর্বেদিক চিকিৎসা করানো হয়। কিন্তু এতে অবস্থার তেমন কোন উন্নতি হয়নি। ১৯৫২ সাল পর্যন্ত কবি নিভৃতে ছিলেন। ১৯৫২ সালে কবি ও কবিপত্নীকে রাঁচির এক মানসিক হাসপাতালে পাঠানো হয়। এই উদ্যোগে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিল নজরুলের আরোগ্যের জন্য গঠিত একটি সংগঠন যার নাম ছিল নজরুল চিকিৎসা কমিটি। এছাড়া তৎকালীন ভারতের বিখ্যাত রাজনীতিবিদ শ্যামা প্রসাদ মুখার্জি সহযোগিতা করেছিলেন। চার মাস রাঁচিতে ছিলেন কবি।

নজরুল নিভৃতে থাকলেও তার কবিতা ও গান বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতার যুদ্ধে তথা মুক্তি সংগ্রামে ছিল অত্যন্ত অনুপ্রেরণার। যার মধ্যে অন্যতম-

‘চল চল চল!/ ঊর্ধ্ব গগনে বাজে মাদল/ নিম্নে উতলা ধরণি তল,/ অরুণ প্রাতের তরুণ দল/ চল রে চল রে চল/ চল চল চল’।

১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে বাঙালিদের বিজয় লাভের পর ১৯৭২ সালের ২৪ মে ভারত সরকারের অনুমতিক্রমে কবিকে সপরিবারে বাংলাদেশে নিয়ে আসা হয়।

বাংলাদেশের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এক্ষেত্রে বিশেষ উদ্যোগ নিয়েছিলেন। কবির বাকি জীবন বাংলাদেশেই কাটে। বাংলা সাহিত্য এবং সংস্কৃতিতে তার বিশেষ অবদানের স্বীকৃতিস্বরুপ ১৯৭৪ সালের ৯ ডিসেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাবি) তাকে সম্মানসূচক ডি.লিট উপাধিতে ভূষিত করে। ১৯৭৬ সালের জানুয়ারি মাসে বাংলাদেশ সরকার কবিকে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব দেয়।

একই বছরের ২১ ফেব্রুয়ারিতে তাকে একুশে পদকে ভূষিত করা হয়। ওই বছরই ২৯ আগস্ট নজরুল চলে যান না ফেরার দেশে।

বাংলাদেশ সময়: ০০১২ ঘণ্টা, মে ২৫, ২০১৬
আইএ/এএ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।