এ যাত্রায় সাড়ে তিন ঘণ্টার উড়াল শেষে গুয়াংঝুর আকাশ থেকে পাহাড় ঘেঁষে গড়ে ওঠা নতুন শহরের স্কাইলাইন যখন চোখে পড়ে, তখন আপনা আপনি মনের কোণ থেকে বেরিয়ে আসে অস্ফূটধ্বনি ‘ওয়াও’। আকাশযানে ভূমিতল থেকে মানুষের সঙ্গে বিচ্ছিন্নতার কারণে মনে যে ভাবালুতা তৈরি হয়, আবার জনমানুষের সঙ্গে মিথস্ক্রিয়ার আনন্দে তা দ্রুতই তিরোহিত হয়ে মনটা চনমনিয়ে ওঠে।
বণিক জাতি চীনারা গুয়াংঝু বাইয়ুন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর খুব বেশিদিন হয় নির্মাণ করেনি। বাইয়ুন ঘিরে তাই ভার্টিক্যালের পাশাপাশি হরাইজন্টালি শহরের বিস্তৃতি চোখে পড়ার মতো। বিশালকায় বিমানবন্দর। স্তরে স্তরে সাজানো নানা অবকাঠামো। বিমানবন্দর থেকে সিটি সেন্টারে যাওয়ার জন্য বাস-ট্যাক্সি ছাড়াও দ্রুতগামী পাতাল রেলের ব্যবস্থা।
এ যাত্রায় কিশোরপুত্র তুসুসহ আমাদের দোঁহের শেষ গন্তব্য স্বপ্নের দেশে আমেরিকার সানফ্রান্সিসকো। সেখান থেকে অরেগন অঙ্গরাজ্যের পোর্টল্যান্ড হয়ে ইউজিন শহরে যাবো। যুক্তরাষ্ট্রে ঢোকার প্রাকভ্রমণ হিসেবে আমাদের এই গুয়াংঝু ভ্রমণ। অনেকটা রথ দেখা কলা বেচার মতো।
বিমানবন্দরের চীনা গাইড স্বভাবী রকমে ইংরেজি না জানায় হোটেল বাসের ওঠার দিকনিদের্শনা সম্বলিত একটা কাগজ ধরিয়ে দিয়েছে এয়ারলাইন্সের ট্রাভেল ডেস্ক থেকে। আরও যাত্রীকে ম্যানেজ করার জন্য সে ইমিগ্রেশন ডেস্ক থেকেই বিদায় নিলো।
নির্দেশিকামতো ২০ নম্বর গেটের কাছে আসতে বাইয়ুন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের পুরোটাই আমাদের একচক্কর পর্যটন হয়ে গেল। এসব ঘোরাঘুরিতে পরিবারের সদস্যরা অনেকটা গলদঘর্ম গেলেও আমি সবসময়ই অক্লান্ত। একটা হিন্দি ছবিতে নায়িকার একটা ডায়ালগের কথা মনে আছে- ‘নয়া নয়া প্লেসেস ঘুরনা, অ্যান্ড নয়া নয়া লোগুঁ সে দোস্তি করনা মেরা সখ হ্যায়’। আমারও তেমন। ভ্রমণে অপরিচিতের মতো খুঁজে খুঁজে প্রয়োজনীয় জায়গা বের করা ও আর মানুষকে খোঁজ করার মধ্যে মজা আলাদা।
বিশ নম্বর গেটমুখে আসতেই যুক্তরাষ্ট্রগামী যাত্রী দেখে বিনা বাক্যব্যয়ে ডেস্কসুন্দরী হুয়াদুর তারকা হোটেল সেঞ্চুরিতে আমাদের থাকার ব্যবস্থা করলো। হোটেলে শিশু-কিশোরদের জন্য বাবা-মায়ের সঙ্গে থাকার জন্য তিন বেডের রুম দেওয়া হয়।
আমাদের অফার করা হলো তিন তিনটে বড় রুম। বেইজিং-অভিজ্ঞতা থেকে জানি, চীনের তারকা হোটেলগুলো দেশটির মানচিত্র, রাস্তাঘাটের মতোই বিশালকায়। বড় রুমের পাশে আরেকটা সোফা সম্বলিত কক্ষ। অন্য দেশে একাধিক কক্ষবিশিষ্ট ইউনিটকে স্যুট হিসেবে ধরা হলেও চীনে একক রুম হিসাবেই গণ্য। দু’টো রুম দিলেই আমি খুশি বলে বললাম। সামান্য ইংরেজি জানা চীনা সুন্দরী আমাদের গায়ে ব্যাজ লাগিয়ে পাশের সোফায় বসতে বললো। দু’মিনিটের মধ্যেই হোটেল লোগো’র ঢাউস প্ল্যাকার্ড হাতে ইশারায় বাস অ্যারেঞ্জার আমাদের ইশারা করে তাকে অনুসরণ করতে বললো। আমরা শ’খানেক যাত্রী তাকে অনুসরণ করে বাসে উঠলাম। চীনের এই এক কেরামতি। চীন কোনকালে বৃটিশ উপনিবেশ ছিল না... কিংবা পশ্চিমা জীবনধারায় নিজেদের ভাসিয়ে তরক্কি করাও চীনের আরাধ্য নয় বলে ইংরজিকে তারা খুব তোয়াক্কা করছে বলে মনে হয় না। ট্যুর অপারেশন, এয়ারলাইন্স পরিচালনাসহ নানা কাজ চীনারা এই ব্যাজ বা চিহ্ন সিস্টেমেই চালিয়ে নিচ্ছে। এমনকি বাঘা ইংরজদের সঙ্গেও ওঠবসে তাদের হচ্ছে না।
হোটেলের লবিতে ঢুকেই আমাদের চক্ষু ছানাবড়া। তারকা হোটেলের সাধারণত যতো বড় লবি থাকে, সেঞ্চুরির লবি তার চেয়ে একটু বড়ই। লবির মধ্যভাগে পুরু ও তুলতুলে ওভালশেপের রঙিন কার্পেট। চারদিক সুসজ্জিত। ওপর থেকে নেমে এসেছে দামি ঝারবাতি। রিসেপশন ডেস্কটি আরও বড়। আমাদের জন্য বরাদ্দ করা হলো পঁচিশ তলার দুটো স্যুট। স্যুটে গিয়ে আমাদের আরও আশ্চর্য হওয়ার পালা। এতোবড় কক্ষ সচরাচর নন ভিআইপি স্যুটে দেখা যায় না।
রাতে স্থানীয় খাবারের হুয়াদুকান্ডে সবজি স্যুপে আমার উদরপূর্তি হলেও স্ত্রী-পুত্র তখনও অভুক্ত। তারা এখনও সেই বাঙালিদের দলে, যারা বিদেশে গিয়ে বাংলা খাবার বা নিদেনপক্ষে কেএফসি-ম্যাকডোনাল্ডস এর জন্য হন্যে হয়। এ রাতে হুয়াদু ফুড পাড়ায় ডাল ভাত পাওয়া যাবে না... সে ব্যাপারে আমি নিশ্চিত হয়ে ভাবলাম, তাহলে হোটেলের ‘ওয়েস্টার্ন রেস্তোরাঁ’তেই তারা খাক। যাক না গাঁট থেকে কিছু বেশি পয়সা... একটা রাতই তো! ফিরে দেখি ততোক্ষণে হোটেলের রেস্তোরাঁর ডিনার বন্ধ হয়ে গেছে। এতে অবস্থায় পরিবারের দু’জনকে অভুক্তই থাকার আশঙ্কা। একবার ফ্রাঙ্কফোর্টে এক রাত আমার এক বন্ধুসহ অভুক্ত ছিলাম। রাতে ম্যানিচেঞ্জরগুলো বন্ধু, আমাদের কাছে ইউরো না থাকায় হোটেলের কমপ্লেন্টারি পানি খেয়ে রাত কাবার করতে হয়েছে।
ফ্রন্টডেস্কের ইংরেজি জানা মহিলাকে জিজ্ঞেস করলাম, কেএফসি, ম্যাকডোনাল্ডস কোথায়? তিনি ইনিয়ে বিনিয়ে পথনির্দেশ করলেন। এতেও আমি আশ্বস্ত নই। কারণ রাস্তায় সাধারণত চীনাদের কিছু জিজ্ঞেস করলে হা করে তাকিয়ে থাকে। উত্তর দিতে পারে না। এমনকি ম্যাকডোনাল্ডস শব্দটিও তারা বোঝে না। তাই ইংরেজি জাননেওয়ালি রিসেপশনিস্টকে ম্যাকডোনাল্ডস শব্দটি লিখে দিতে বললাম। সে টুকটাক ইংরেজি বলতে পারে, লিখতে পারে না বলে এতে রাজি হলো না। মুখে বার বার মাদোনা শব্দটি উচ্চারণ করে পথনির্দেশ করলো।
রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে কয়েকজনকে ম্যাকডোনাল্ডস এর খোঁজ দিতে বলেও কাজ হলো না। পশ্চিমা ফ্রাঞ্চাইজের এই খাবারের দোকানটি নাকি এক সুপারমার্কেটে। সুপারমার্কেট কোথায় জিজ্ঞেস করেও কোনো সদুত্তর পাওয়া গেল না। আকস্মিক পশ্চিমে পড়াশুনা করে এমন এক চীনা ছাত্রী রাস্তায় স্বপ্রণোদিত হয়ে এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করলো, তোমরা কোথায় যাবে? ম্যাকডোনাল্ডস এর কথা বলতেই সে দেখিয়ে দিলো। মিনিট কয়েক হাঁটতেই আমরা হুয়াদু জেলার প্রধানসড়ক মোড়ে ভ্যানগার্ড নামে শপিং মল পেলাম। তার নিচেই পরিষ্কার ইংরেজিতে লেখা ‘ম্যাকডোনাল্ডস’। কিন্তু আমারা ভিসা কার্ডে ডিক্লাইন করলো খাবারের দাম দিতে গিয়ে। কাউন্টারকর্মী বললো, ইয়েন বের করো। আমার সফরসঙ্গীরা অপ্রস্তুত। মা-বেটার বিস্ময় বিস্ফারিত চোখ আমার দিকে। পার্সেলে খাবার নেওয়ার পর এখন বোধ হয় ফেঁসে যেতে হবে... তাদের এই ধারণা। স্মার্টলি ওয়ালেট খুলে ইয়েনে খাবারের দাম পরিশোধ করতে দেখে তাদের চোখে আরও বিস্ময়।
আমি ভ্রমণ-অভিজ্ঞ মানুষ। যুক্তরাষ্ট্রমুখী যাত্রা হলেও চীন হয়ে যাবো আর ঢাকা থেকে কিছু ইয়েন সঙ্গে নিয়ে যাবো না... এমন আনস্মার্ট ট্রাভেলার আমি নই।
** চিকেন চাইতেই এলো সিগারেট!
বাংলাদেশ সময়: ০৬১২ ঘণ্টা, জুন ১২, ২০১৬
এমজেএফ/