সানফ্রান্সিসকোয় আজ রোদ্র-ঝলমল দিন। বিমানবন্দরের প্রায়োরিটি লাউঞ্জের স্বচ্ছ কাঁচের ভেতর দিয়ে তাকালে, প্রশান্তি এনে দেয় সবুজপাহাড়ের ঢালে খয়েরি টালিছাওয়া দৃষ্টিনন্দন ঘরবাড়ি।
আমার স্ত্রী জলি ফেরদৌসী ঠিকই বলে, তার ভ্রমণভাগ্য ভালো। পৃথিবীর যেসব জায়গায় তার যাওয়া হয়েছে, ভ্রমণকালে সেখানকার আবহাওয়া ভ্রমণোপযোগী। জাপানের ফুজি মাউন্টেন বাদে প্রায় সর্বত্র জলি পেয়েছে চমৎকার আবহাওয়া। এমনকি যে গুয়াংঝুর আকাশ সারাবছর থাকে কুয়াশাময়, বৃষ্টিবিঘ্নিত আর ঘুর্ণিঝড়প্রবণ, বিমান ওঠানামা মাঝে মধ্যে বাতিল করে দিতে হয়- আমাদের যাত্রায় গুয়াংঝু ও উহানের আবহাওয়া ছিলো সূর্যময়। প্রায়োরিটি লাউঞ্জের বুফে লাঞ্চে বসে স্ট্রবেরি জুসে আয়েশ করে চুমুক দিতে দিতে আবহাওয়াবিষয়ক ফোনালাপ শুনে জলি বললো-
: বলেছিলাম না, আমার কথাই তো ঠিক হলো।
: কোনটা ঠিক হলো?- বললাম।
: ওই যে, আমার ভ্রমণের সময় আবহাওয়ার ব্যাপারটা। - জলি বললো।
চায়না সাউদার্ন এয়ারলাইন্সের ফ্লাইটে সকাল সাড়ে দশটায় সানফ্রান্সিসোকোয় অবতরণ করেছি। গুয়াংঝু থেকে দেড়ঘণ্টার উড়ালে উহান আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর। ইমিগ্রেশনের পাট চুকিয়ে প্রশান্ত মহাসগার রুটে টানা এগারো ঘণ্টা দিনরাত্রির উড়াল। বোয়িং সেভেন এইট সেভেন উড়োজাহাজে চল্লিশহাজার ফুট ওপর দিয়ে লাগাতার এই ওড়া। দীর্ঘ উড়ালের ধকলে জলি ও তুসু ক্লান্ত। এর আগে লন্ডন থেকে আট ঘণ্টা ওড়ার অভিজ্ঞতা থাকলেও দেড় ঘণ্টার পর এগারো ঘণ্টা মিলে সাড়ে বারো ঘণ্টা ওড়া এই প্রথম তাদের। রাজ্যের ক্লান্তি নিয়েও চেহারায় চনমনে ভাব ধরে রাখা আমার পুরনো অভ্যেস। পৃথিবীতে মানুষের গোটা জীবনটাই হয়তো ভ্রমণময়। এই দর্শনটিকে ধারণ করায় ভ্রমণক্লান্তি আমাকে কাবু করতে পারে না। যাই হোক, টাইমজোন ভেঙে উড়ে আসায় জলি, তুসু জেটল্যাগ আক্রান্ত। যাদের এসময় বিছানায় যাওয়ার কথা, বাক্সপেটরা বয়ে বয়ে তারা এখন ঘুরে ফিরছে দেশান্তরে। কিন্তু সানফ্রান্সিসকোর এই রৌদ্রকরোজ্জ্বল দিন চোখমুখের ভ্রমণক্লান্তি ঘুঁচিয়ে সবার মন ফুরফুরে করে দিয়েছে। এর ওপর এয়ারপোর্ট লাউঞ্জে সমস্ত ভ্রমণ স্ট্রেস ঝেড়ে ফেলার রকমারি ব্যবস্থা। বিমানবন্দরের লাউঞ্জগুলো সাধারণত এয়ারসাইড বা বিমান দাঁড়ানোর পাশেই থাকে। এখানে আয়েশ করে বসে দিব্যি ল্যান্ডিংসহ নানা কর্মকাণ্ড দেখা যায়। সানফ্রানসিসকো প্রায়োরিটি লাউঞ্জটি এয়ারসাইডের এমন জায়গায় যে এখান থেকে সানফ্রান্সিসকো বে, সানমাতিয়ো বে ব্রিজ, আর পাহাড়প্রান্ত অনায়াসে চোখে পড়ে। আমাদের কয়েকগজ দূরেই কাঁচের ওপাশে এমিরেটস এয়ারলাইন্সের ঢাউস এয়ারবাস এথ্রিএইটটি দাঁড় করিয়ে রাখা। আশেপাশে আরও কয়েকটি বিমান ল্যান্ড করে রাখা। সানমাতিয়ো ব্রিজের দিক থেকে মিনিটে মিনিটে বিমান ল্যান্ডিং করছে। এয়ারসাইডে বসে ভ্রমণক্লান্তি আনওয়াইন্ড করার এসব ব্যবস্থা রয়েছে বলেই মানুষ দীর্ঘ আকাশভ্রমণের পর আবার জীবনের নানা মিথস্ক্রিয়ার মাধ্যমে আবার এগিয়ে চলার গতি পায়। আমাদের যেতে হবে অরেগন অঙ্গরাজ্যের পোর্টল্যান্ড। তারপর আবার অরেগন ইউনিভার্সিটি সিটি ইউজিনের পঁচিশ মিনিটের বিমানযাত্রা।
জলি রুটিতে জেলি লাগিয়ে অরেঞ্জ জুস, ফ্রেশ সালাদ আর ডেজার্ট হিসাবে ফলমূল, কেক-পেস্ট্রি নিয়ে বসেছে। তুসু টার্কিশ চিকেনের স্যান্ডউইচ আর কোক নিয়ে মোবাইল ইন্টারেনেটে কিছু ঘাঁটাঘাঁটি করার চেষ্টা করছে। মোবাইলে চার্জটিও সেরে নিচ্ছে। আমি স্যুপ, সালাদ, স্যান্ডউইচ আর জুস নিয়ে একবার বেপ্রান্তের ধূসর দিগন্তে তাকাচ্ছি, আরেকবার সামনে খুলে রাখা কম্পিউটারের স্ক্রিনে ফিরে আসছি।
বলা ভালো, এসময় আমাদের রোজা থাকার কথা। ইসলাম ধর্মের অন্য ভিত্তিগুলোর চেয়ে রোজার প্রভাব আমাদের দেশসহ বিশ্বজুড়েই বেশি সক্রিয়। এ মাসে ফজিলতের কথা ইসলাম বলেছে এন্তার। তাই রোজার সময় ধার্মিকের সংখ্যা আলবত বাড়ে। আমাদের পরিবারে রোজার চল বেশ পাকাপাকি। তবে আমরা সফর আর রোগশোকের ছুতোয় রোজা ভাঙার সুযোগ নিয়েছি। এই সুযোগটি পবিত্র ক্বোরআন শরীফই দিয়েছে। সফরকালীন বেরোজাদারির কারণে লাউঞ্জের এতো খাবারদাবারে বর্ণনা আসছে।
যুক্তরাষ্ট্রভ্রমণ দেড় দশকের বেশি আগে সেই ২০০০ সাল থেকে শুরু করলেও ২০০৯ সালের পর আসিনি। ২০০৯ সালে জেএফকে বিমানবন্দর দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে ঢুকতে গিয়ে ঘণ্টাকালের অপেক্ষার বিড়ম্বনার তিক্ততা রয়েছে। সে প্রসঙ্গ ভিন্ন। গত আট বছরে বিশ্বের রাজনৈতিক মানচিত্রে বহু পানি গড়িয়েছে। বহুদিন পর পরিবার-পরিজনসহ সানফ্রান্সিসকোর ইমিগ্রেশন লাইনে দাঁড়িয়ে তাই নানা দোলাচল কাজ করছে মনে। এর ওপর তুসু ইমিগ্রেশন কাউন্টারের লাইন আর অফিসারদের ছবি তুলতে গিয়ে এক অফিসারের প্রবোধ শুনেছে। মোবাইল ক্যামেরায় ছবি তোলা দেখে তুসুকে উদ্দেশ্য করে উচ্চকণ্ঠে এক কর্মকর্তা বলেছেন- হেই ইউ, ডোন্ট টেক এ ফটো।
তখনও আমরা ইমিগ্রেশনের লাইনে। ভিসা নিয়ে বের হওয়ার সময় ইমিগ্রেশন পুলিশপ্রধান এসে তুসুর কাছে মোবাইলে তোলা ছবি দেখতে চাইলেন। মনে হলো, ছবি ডিলিট করে দিতে চান। ইতোমধ্যে প্রায় সব কাউন্টার ফাঁকা হয়েছে। অফিসারদের দৃষ্টি ও মনযোগ এখন তুসু আর আমাদের দিকে। তুসুর হাতে মোবাইল রেখে স্ক্রিনে চোখ রাখলেন অফিসার। তোলা ছবি অলরেডি ফেসবুকে পোস্ট করা দেখে আকস্মিক তার উদ্যতভাব রুপ নিলো রসিকতায়। হাসি দিয়ে বলে উঠলেন আরে! তুমি অলরেডি পোস্ট করে দিয়েছো ফেসবুকে, মজার তো! তার কথায় অন্য অফিসারদের মধ্যেও উঠলো হাসির রোল। আমেরিকানদের মতো ইংরেজি বলা এশিয়ান এক তামাটে কিশোরের কাণ্ডে ভৎর্সনার বদলে তারা বাহবাই দিতে থাকলেন। আমরা কাস্টমস হলের দিকে পা বাড়ালাম।
ডিক্লারেশন ফরমে আমি খাবার আছে বলে টিক দেওয়ায় নির্ধারিত কাস্টমস চ্যানেল দিয়ে যেতে হলো। টিক না দিয়ে উপায় ছিলো না। আমার লাগেজে রয়েছে- ইলিশ, রুই, কাতল, চিংড়ি, রুপচাঁদাসহ অন্তত বিশ কেজি হাফ কুকড মাছ আর মশলা। যুক্তরাষ্ট্রে মাছ নিয়ে যাওয়ার প্রক্রিয়াকরণের কথা আমাকে শিখিয়ে দিয়েছিলেন বন্ধু আতিয়ার রহমান লাবু। হাফফ্রাই করা মাছ প্লাস্টিকের এয়ারটাইট বক্সে ঢুকিয়ে ফ্রিজিং করেছি। ভ্রমণের দিন ভরেছি আলাদা লাগেজে। কাস্টমস কর্মকর্তা একটা ছবির লিফলেট দেখিয়ে বললেন, তুমি এসব ছবির জিনিসপত্র আনোনি তো? আমি তার কথার সরাসরি উত্তর না দিয়ে, বললাম, ‘আই অ্যাম অ্যাওয়ার অ্যাবাউট আমেরিকান বর্ডার রুলস। ’ একথা শোনামাত্র কর্মকর্তা কোনো লাগেজ না খুলেই ধন্যবাদ জানিয়ে বিদায় দিলেন।
আমাদের পরের ফ্লাইট আলাস্কা এয়ালাইন্সে অরেগনের পোর্টল্যান্ড। সে ফ্লাইট সন্ধ্যা ছয়টায়। আমরা আলাস্কা এয়ারলাইন্সের কাউন্টারে চেক ইন করে বাক্সপেটরা সব তাদের জিম্মায় গছিয়ে দিয়ে অনেকটাই নির্ভার। এখন আমাদের খানাপিনা আর বিশ্রাম দরকার। পকেটে রয়েছে দুনিয়াজুড়ে এয়ারপোর্ট লাউঞ্জ ব্যবহারের প্রায়োরিটি পাস। সানফ্রান্সিসকো এয়ারপোর্টে ছয় ঘণ্টা কাটাতে তাই আমরা লাউঞ্জের দিকে পা বাড়ালাম।
আমেরিকানরা নাকি বাংলাদেশ-ভারত থেকে আসা যাত্রীদের লাগেজে টন টন খাবার বহন করার ব্যাপারটা নিয়ে উদ্বিগ্ন বড়। বিশুদ্ধ মাছ, মাংস, ফলমূল আর মিল্কজাত খাদ্যের অভাব নেই এখানে। দামও কম। তারপরও এশীয়দের লাগেজে নিয়মিত কেন মাছ-মিষ্টি আসছে এটা তাদের মাথায় ঢুকছে না। তাদের উদ্বেগ নিজস্ব দৃষ্টিকোণ থেকে ঠিক আছে। তবে যন্ত্রচালিত আমেরিকানরা জানে না- টাঙ্গাইলের চমচম, মুক্তাগাছার মন্ডা, পদ্মার ইলিশ, গড়াইয়ের চিংড়ি, চট্টগ্রামের রুপচাঁদা আর লইট্যা শুঁটকি বোচকা ভরে এনে আমরা শুধু ওজনমাত্র বয়ে আনিনি, আত্মার আত্মীয়দের রসনায় নষ্টালজিক স্বাদ তুলে দিতে সাত হাজার মাইল দূর-দেশান্তর থেকে বাক্সপেটরা ভরে বয়ে এনেছি আমাদের প্রাণের আকুল আবেগ। সেই আবেগ আমেরিকান ডলারে মেলে না।
বাংলাদেশ সময়: ০৯৪৫ ঘণ্টা, জুন ১৩, ২০১৬
এসএনএস
** চিকেন চাইতেই এলো সিগারেট!
** সাড়ে তিন ঘণ্টার উড়াল ও ম্যাদোনা