ভবিষ্যতের স্মৃতি হয়ে থাকবে- এমন একটা আলোকচিত্রের জন্য সাত হাজার মাইল দূর থেকে চল্লিশ ঘণ্টার লাগাতার ভ্রমণ করে এসেছি মার্কিন মুলুকে। জাগরণে পোহায়েছে রাত, ক্লান্তিতে কেটেছে দিন।
শহরের রাস্তায় রাস্তায় তৃণলগ্ন হয়ে কালের সাক্ষী হয়েছিল প্রজন্মের পদচিহ্ন। ক্যাম্পাসের মাথিউ নাইট এরেনা হলের পনেরো হাজার অভিভাবকের মধ্যে আসন নেওয়ার প্রস্তুতিতে আমাদের আজকের সকালটি শুরু হয়েছিল ভোররাত থেকেই। কম্পিউটার বিজ্ঞান ও প্রকৌশলে সদ্য স্নাতকোত্তর পুত্র পল্লব মাহমুদের সমাবর্তন প্যারেড শুরু সকাল নয়টায়। পৌনে আটটায় দোরগোড়ায় গাড়ির হর্ন। তড়িঘড়ি জলি, মামণি শায়লা আর তুসুসহ বেরিয়ে গেলাম। পল্লব যাবে সতীর্থদের সঙ্গে।
আমাদের আজকের সকালটি বড় আবেগের। মধুবাগের মেরিটোরিয়াস নামে মায়ের স্কুলের ইউনিফর্মে খাকি প্যান্ট, নীলজামার ওপর ঘাড় থেকে কোমর পর্যন্ত লাল ব্যাজ পরার বিরক্তিতে যে ছেলে কান্না করতো, আজ সে দিব্যি সবুজ গাউন, টুপি আর স্নাতকোত্তর ডিগ্রির প্রতীক বহুরঙা ব্যাজ জড়ালো গলায়। বিশ্বের নানাপ্রান্ত থেকে আসা পনেরো হাজার বাবা-মায়ের সঙ্গে আমরা যখন ম্যাথিউ নাইটের ছয়তলার গ্যালারিতে আসন নিয়ে কফিতে চুমুক দিচ্ছি, কিছুক্ষণের মধ্যে শিক্ষার্থীদের আনন্দ-কোলহলমুখর পদযাত্রাটি হলে এসে শেষ হলো। আসনে বসা অভিভাবকরা জায়ান্ট স্ক্রিনে নিজ সন্তানকে দেখে ওই তো ওই তো বলে আনন্দধ্বনি করছে, তখন হাজারের মধ্যে আমরাও খুঁজে ফিরছি সন্তানের প্রিয়মুখ। মামণি চেঁচিয়ে উঠলো আকস্মিক- ওই তো, ওই তো পল্লব।
জাতীয় সঙ্গীত, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রেসিডেন্ট মাইকেল শিলের স্বাগত বক্তব্য আর তিন কৃতী শিক্ষার্থীর বক্তৃতার পর হলিউডের স্বনামখ্যাত পরিচালক কেন্ট অলটারম্যান চমৎকার সমাবর্তন বক্তৃতা করলেন। আশি সালে অল্টারম্যান বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা বিভাগের ছাত্র ছিলেন। জীবনের নানা উতরাই ও সংগ্রামের পর কীভাবে হলিউডে নাম লেখালেন, তুলে ধরলেন তার বিস্তারিত ফিরিস্তি। নতুন ডিগ্রিধারীদের প্রতি তার উপদেশ স্থৈর্য, মেধা, সৃজনশীলতা ও পরিশ্রম যদি তোমাদের করায়ত্ত থাকে, জীবনে সাফল্য অনিবার্য। এ সময় হলঘরে মুহুর্মুহু করতালি।
ইউনিভার্সিটির মূল অনুষ্ঠান শেষ হওয়ার পর শিক্ষার্থীরা ছুটলো নিজ নিজ বিভাগ চত্বরে আয়োজিত সনদগ্রহণ উৎসবে। আমরা ক্যাম্পাসের কম্পিউটার বিজ্ঞান ও প্রকৌশল বিভাগে গিয়ে সে উৎসবে অংশ নিলাম। আমাদের তিনজনের দলে জলিই একমাত্র, যে কালো ব্লাউজের ওপর লাল শাড়ি পরে অনুষ্ঠানের অভ্যাগতদের তাক লাগিয়েছে। পশ্চিমা দেশে শাড়ির প্রচলন নেই। আজ শিক্ষার্থীর বাবা-মায়ের জন্য এক ভিন্ন দিন। জাতিগত ও ঐতিহ্যিক পরিচয় ফুটিয়ে তোলার এক অবারিত সুযোগ এ দিন।
ব্যতিক্রমী পোশাকের জন্য আমরা ছিলাম আলোকচিত্রীদের আকর্ষণের কেন্দ্রে। উন্মুক্ত সবজ চত্বরে ঘণ্টাকালের অনুষ্ঠানের পর সনদ দেওয়া হলো। নাস্তার সময় বিভাগীয় শিক্ষকদের সঙ্গে হলো আলাপ পরিচয় হলো বিভাগের কৃতী গ্রাজুয়েট ফেলোর বাবা হিসেবে। পরে বের হলাম ক্যাম্পাস পর্যটনে।
সমাবর্তন উপলক্ষে ৬০ শতাংশ বৃক্ষশোভিত ক্যাম্পাস সাজানো হয়েছে মনোরম করে। চত্বরে চত্বরে উৎসবে মেতেছে নব্য গ্রাজুয়েট, মাস্টার্স ও পিএইচডি ডিগ্রিধারীরা। রাস্তায় মোতায়েন হয়েছে বিশেষ যান চলাচল ব্যবস্থা। বছরান্তের এই বড় আয়োজন ঘিরে যাতায়াতের পথে পথে বসানো হয়েছে তথ্য বুথ, স্যুভেনির শপ, সমাবর্তন ২০১৬’র প্ল্যাকার্ড। ক্যাম্পাসজুড়ে দিনমানের জন্য চলছে বিনামূল্যে শার্টেল কার। সবুজ গাউন আর টুপিতে সাজা শিক্ষার্থীদের সঙ্গে অভিভাবকদের এই মিলনমেলা ক্যাম্পাসজুড়ে তৈরি করেছে দারুণ উৎসবের আবহ। সবুজঘাস ও বৃক্ষময় বিশাল ক্যাম্পাসের মাঝে মাঝে খয়েরি রঙের বিভাগীয় ভবন। সনদ পাওয়া শিক্ষার্থীরা থেকে থেকেই সেখানে কলরব করে উঠছে। রাস্তায় রাস্তায় অভিভাবক-শিক্ষার্থীদের এ আনন্দ আয়োজনে ইউজিন নগরবাসীও যেন একাত্ম আজ।
অনুষ্ঠানে শামিল হতে শনিবার সকালে সানফ্রান্সিসকো পৌঁছেও আমরা শহর ভ্রমণে বের হইনি। বিমানবন্দরের লাউঞ্জে পাঁচঘণ্টা কাটিয়ে বিকেলেই চেপে বসেছি আলাস্কা এয়ারলাইন্সের পোর্টল্যান্ডমুখো ফ্লাইটে। ঘণ্টাকালের বিরতির পর মিনিট পঁচিশের ফ্লাইট। একই এয়ারলাইন্সের ছোট প্লেনে চেপে রাত দশটায় এসে অবতরণ করেছি ইউজিন বিমানবন্দরে। গেটমুখে মার্কিন শিক্ষার্থী জোনাথন ব্রোফি আর পুত্র পল্লব মাহমুদ আমাদের স্বাগত জানিয়ে শহরে নিয়ে এসেছে।
অরেগনের ইউজিন-স্প্রিংফিল্ডে মাত্র কয়েক লাখ লোকের বাস। আমেরিকার স্বনামখ্যাত উচ্চবিদ্যাপীঠ ইউনিভার্সিটি অব অরেগনকে কেন্দ্র করেই নদীতীরের এ দুটি শহর।
**আমেরিকায় বয়ে নেওয়া বাক্সভরা আবেগ
** চিকেন চাইতেই এলো সিগারেট!
** সাড়ে তিন ঘণ্টার উড়াল ও ম্যাদোনা
বাংলাদেশ সময়: ১২৩৩ ঘণ্টা, জুন ১৩, ২০১৬
এএ