ঢাকা, শুক্রবার, ৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২২ নভেম্বর ২০২৪, ২০ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

শিল্প-সাহিত্য

ভ্রমণামৃত-৭

গড়াই থেকে উইলামেট।। নদী নির্জন বুনো পথ পরিভ্রমণ

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৯২০ ঘণ্টা, জুন ১৮, ২০১৬
গড়াই থেকে উইলামেট।। নদী নির্জন বুনো পথ পরিভ্রমণ

পদ্মা-গড়াই আমার শৈশব, কৈশোর জীবনের বাঁকে বাঁকে মিশে আছে। এ দুই নদী ছিল বাড়ন্ত সময়ের অন্যতম মায়াময় হাতছানি।

পদ্মা-গড়াইয়ের তীরে তীরে লুকিয়ে আছে জীবনের অমূল্য মজার কৈশোরিক স্মৃতিসম্ভার। গড়াইপারের কুমারখালীর ছাতিয়ান গ্রামে জন্ম আমার, নানা বাড়ি একই উপজেলার গড়াইতীর কোমরভোগে। কিশোর বয়সে নানা বাড়িতে ডিঙি নৌকায় তাজা ইলিশ ধরার মধুর অভিজ্ঞতা এখনও স্মৃতিতে উজ্জ্বল। ইউরোপ-আমেরিকা যেখানেই যাই, আশপাশের নদী আমার অন্যতম আকর্ষণের কেন্দ্র।  যুক্তরাষ্ট্রের ইউজিন শহরে আসার আগেই গুগলিং করে খোঁজ নিয়ে এসেছি নয়নকাড়া মায়াবতী পাহাড়ি নদী উইলামেট বিধৌত করে গেছে এই শহর।

দু’তীরে সবুজ বনানী আর স্ফটিক স্বচ্ছ পাহাড়ি জলধারা নিয়ে এ নদী উজানের পাহাড় থেকে বয়ে চলেছে শহরের মাঝ দিয়ে। এর স্রোতধারা না দেখে কীভাবে থাকি!

নদীর টানে সারা পরিবার পিঠে ব্যাগ বেঁধে বেরিয়ে পড়ি সকাল সকাল। অরেগন বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতর দিয়ে হেঁটে উত্তর পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া  উইলামেট তীরের দিকে হাঁটতে থাকি আমরা। অটজেন বাইক ব্রিজের কাছে পৌঁছার আগেই কানে ভেসে আসে নদী গর্জন। ব্রিজে পৌঁছে সবাই হুররে বলে আনন্দে চেঁচিয়ে উঠি! নিচে তাকিয়ে চোখ জুড়িয়ে যায়। নিচে নদী তো নয়, যেন আশ্চর্য এক জলপ্রপাত সোঁ সোঁ গর্জনে বিপুল জলরাশি উৎক্ষিপ্ত করে ছুটে যাচ্ছে নিরন্তর।

উৎক্ষিপ্ত জলরাশি থেকে তৈরি ফেনিল শুভ্রতা ঝলমল রোদের সঙ্গে মিলে তৈরি করেছে এক রঙিন আবহ; ঐশ্বরিক আবহ। এই ব্রিজের নিচে এসে পাহাড়ি স্রোত তলদেশের বড় পাথর-নুরিতে বাধা পেয়ে হয়ে উঠেছে আরও প্রমত্ত। ফুঁসে উঠে এক আশ্চর্য জল গর্জনে বিপুল বেগে ধেয়ে নামছে নিচে। আমরা ব্রিজে উঠে নদীর সেই গর্জন আর আশ্চর্য প্রাকৃতিক কলতানের সঙ্গে নিজেদের আনন্দ কোলাহল ভাসিয়ে দিলাম। দেখি দূর উজানে পাহাড়। ভাটিতে নদী তীরে নীবিড় ঘন বনানী। প্রকৃতি আমাদের প্রশান্তির বড় মেডিসিন বলে আকস্মিক আবিষ্কার করলাম। ভ্রামণিক দলের কনিষ্ঠ সদস্য তুসুর গোড়মা মুখ মূহুর্তে নদীতে এসে চনমনে হবে কেন? কেন বিষণ্ণতাময় নিরবতা থেকে আকস্মিক তার মন চনমনে।

আমাদের সঙ্গেই পাল্লা দিয়ে হুল্লোড়ে মেতেছে সে। নানা আনন্দ কোলাহলে যোগ দিয়েছে। এমনকি তার ব্যাকপ্যাক থেকে বের করছে গো প্রো ভিডিও ক্যামেরা, সেলফি স্ট্যান্ডসহ এ আনন্দ ছবি-ভিডিওতে ধরে রাখার নানা উপকরণ।

তার আনন্দ ধ্বনি ‘হে, আই এ্যাম প্রোভাইডিং ইউগাইজ অল দ্যটুলস’।

উইলামেট নদী উত্তর আমেরিকার উত্তর-পশ্চিম প্রশান্ত মহাসাগর অঞ্চলের উইলামেট ভ্যালির এক আশ্চর্য জলধারা। যা বয়ে পড়ছে প্রশান্ত দুহিতা কলাম্বিয়া রিভারে। উজানে নানা পাহাড় থেকে উৎপত্তি হয়েছে উইলামেটের। ইউজিন, সালেম, স্প্রিংফিল্ড, পোর্টল্যান্ড ও অরেগন শহরকে বিধৌত করে তা গিয়ে ধরা দিয়েছে কলাম্বিয়ায়। কলাম্বিয়ার ১৫ ভাগ পানির উৎস এই নদীর মূলস্রোতের দৈর্ঘ্য ৩০১ কিলোমিটার। এসব উইকিপিডিয়ার তথ্য। এই নদীপথে ইউলামেট জলপ্রপাতও রয়েছে।

নদীর উত্তর পারের ডান দিকে তীর দিয়ে ওপরের দিকে হুইলামুট ন্যাচারাল এরিয়া। বাম তীরের ঘন বনের পর অল্টন বেকার পার্ক। নদীর দু’পারেই হাঁটা ও বাইকপথ। নাম ‘রুথ বাস্কন রিভারব্যাঙ্ক পথ’। ইউজিনের কয়েকটি প্রতিষ্ঠান এই পথ তৈরি ও সংরক্ষণ করে থাকে। জঙ্গল, অভয়ারণ্য আর ঘনবন বেষ্টিত নদী তীর পথের প্রকৃতি ও বন্যপ্রাণী রক্ষায় নানা জায়গায় নির্দেশিকা। আমরা ভাটির দিকের তীর পথ ধরে অল্টন বেকার পার্কের দিকে হাঁটা শুরু করলাম। শুরুতে ঘনবন ঘেরা এই তীরপথ। মাঝে হালকা জঙ্গল।

হাঁটা পথে জলির পায়ের কাছ দিয়ে জঙ্গলের ভেতর ঢুকে গেলো ছোট বুনো সাপ। আমরা খুব সাবধানে পা চালাতে লাগলাম। সবার পিঠে ব্যাগ, হাতে ক্যামেরা, কেডস জুতো আর গায়ে জড়া নোহুডি। এ পথে পার্কসহ পুরো ‘বাস্কন রুথ রিভারব্যাঙ্ক পাথে’ সোলার সিস্টেম বা সৌর জগতকে তুলে ধরা হয়েছে। পৃথিবী থেকে প্লুটো পর্যন্ত নানা গ্রহজগতের তারকাগুলোর আদল ও এর বিবরণ বসানো আছে চলতি পথের নানা জায়গায়। পুরো পথটি সাইকেল বা হেঁটে ভ্রমণে সৌর জগত প্রদক্ষিণের সঙ্গে তুলনা করতে এই নভোমণ্ডলের তারকারাজির এই সমাহার। পার্ক ও নদী তীর পথে প্রকৃতি প্রেমী মানুষ একা, যুগোল বা গ্রুপে গ্রুপে বেরিয়েছে। কেউ হাঁটছে। কেউ চুপচাপ নদীর ধারে বসে তাকিয়ে আছে। কেউ পার্কের সবুজ ঘাসে শুয়ে। কেউ আবার নদীতে সখের মাছ ধরতে বসেছে। এই নদীকে ঘিরে যে ইউজিনবাসীর অর্থনৈতিক ও বিনোদন কর্মকাণ্ড পরিচালিত হচ্ছে তা স্পষ্ট বোঝা যায়।

আমরা অটজেন স্টেডিয়াম ডানে রেখে বুনো নদী পথ পেরিয়ে পার্কের শেষপ্রান্ত ডাকপন্ডের পাশে ফেরি স্টেশন ব্রিজের কাছে এসে দাঁড়ালাম। ডাকপন্ড কার্যত হাঁসের অভয়ারণ্য। উজানের কয়েকটি খাল, ক্রিক বেয়ে নেমে আসা জলধারা আটকে পার্কপ্রান্তে তৈরি করা হয়েছে এই বৃত্তাকার হংস অভয়ারণ্য। এ পুকুরে বুনো হাঁস খেলা করছে। জলনিমগ্ন কংক্রিটের দেয়াল উপচে একটি প্রপাত সৃষ্টি করে এ পানি গিয়ে পড়ছে কয়েকগজ দূরের নদীতে। স্রোতের উজানে নদী থেকে মাছ উঠে আসে পন্ডে। সে মাছ হাসের খাদ্য। এক মৎস্য শিকারিকে বড়শি ফেলে মিনিটে একটা করে মাছ ধরতে দেখে দাঁড়িয়ে গেলাম। শিকারি জানালো, ২৫ বছর ধরে সে এখানে মাছ ধরছে সখের বশে। আট ইঞ্চির চেয়ে ছোট মাছ বড়শিতে ধরা পড়লেও তা আবার নদীতে ছেড়ে দিতে হয়। শিকারিই তথ্য দিলো এই মাছের নাম ‘রেইনবো ফিস’।


আমরা পার্কপ্রান্ত দিয়ে বেরিয়ে সড়কের এসে দাঁড়ালাম। বাসে চেপে ভিআরসি নামে খ্যাত ভ্যালি রিভার সিটি মলের নেমে নাগরিক কোলাহলে মিশে গেলাম। মনে গেঁথে রইল নদী দেখাও নদী নির্জন বুনোপথ পরিভ্রমণের এক আশ্চর্য পেইন্টিংস।

**ইউজিন শহর। । দরজায় অচেনা আগন্তুক
**আলোকচিত্রের জন্য মার্কিন মুলুকে

**আমেরিকায় বয়ে নেওয়া বাক্সভরা আবেগ
** চিকেন চাইতেই এলো সিগারেট!
** সাড়ে তিন ঘণ্টার উড়াল ও ম্যাদোনা

বাংলাদেশ সময়: ০৯১৬ ঘণ্টা, জুন ১৮, ২০১৬
আইএ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।