ঢাকা, রবিবার, ৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ২২ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

শিল্প-সাহিত্য

গল্প

গন্তব্য | আহমেদ বাসার

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৯৫৫ ঘণ্টা, জুলাই ১১, ২০১৬
গন্তব্য | আহমেদ বাসার

গাড়িটি যখন শাহবাগ এসে থামল তখন ভেতরে তিলধারণের কোনো ঠাঁই নেই। পাঁচজন যাত্রী গাড়ি থেকে নামলো।

একজন তো নামার সময় আক্কাস আলীর বাম পা পিষে দিয়ে গেলো। চিৎকার করতে গিয়েও নীরবে হজম করেছে যন্ত্রণা। এরপর অপেক্ষমান শত শত যাত্রীর ধাক্কাধাক্কি করে ওঠা শুরু হলে আক্কাসের নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়। এ কেমন শহর? আর এতো মানুষইবা এখানে কীভাবে থাকে? কিছুতেই ভেবে পায় না সে। অবশ্য গতকাল তার ঢাকায় আসার কথা শুনে ছমির মুন্সির বাজারের মুদির দোকানদার গোফরান বলেছিল, ঢাকায় নাকি ‘ম্যালা’ মানুষ। রাস্তায় হাঁটার মতন অবস্থা নাই। আক্কাস বিশ্বাস করেনি। আর বিশ্বাস করেই বা কী হবে। ঢাকায় না এলে তাকে চাকরি দেবে কে? গ্রামের পরিচিত একজন তাকে টঙ্গী বাজারের ঠিকানা দিয়ে ঢাকায় আসতে বলেছে। এখানে গার্মেন্টসে কাজ করলে নাকি থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা হয়ে যায়। ঢাকায় না এলে গোফরান মিয়া কি তাকে দোকানে কাম দেবে? গ্রামে শত শত মানুষের হাতে-পায়ে ধরেও কোনো লাভ হয়নি। অবশেষে ঢাকায় আসতে হলো। এখন তো অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে গ্রামে ফিরে যাওয়াই ভালো। ডান পায়ে তীব্র ব্যথা অনুভূত হলে আক্কাস হঠাৎ দেখতে পায় তার পা আরেকটি বুটপরা পায়ের নিচে পিষ্ঠ হয়ে যাচ্ছে। কয়েকবার চেষ্টা করেও টেনে বের করা যাচ্ছে না। আক্কাসের ইচ্ছা হয় চিৎকার করে কাঁদতে। কিন্তু কেঁদে কী লাভ? কান্না শোনার অবসর তো কারও নেই। আক্কাস কিছুক্ষণ দমবন্ধ করে ধীরে ধীরে নিঃশ্বাস ফেলার চেষ্টা করে। কিন্তু শ্বাস-প্রশ্বাসে ছন্দপতন ঘটে গোলযোগ তৈরি হওয়ার উপক্রম হয়। তার ঘাড়ের ওপর ইয়া মোটা একটা লম্বা হাত ঝুলে আছে। ফলে তার পক্ষে সোজা হয়ে দাঁড়ানো কঠিন হয়ে পড়ে। পাশে সরতে গিয়ে দেখে ওখানে দুইজন আটার বস্তার মতো ঠাসাঠাসি করে দাঁড়ানো। আক্কাসের পক্ষে কোনোদিকেই নড়াচড়া করা সম্ভব হয় না। পায়ের ওপর সেই বুটের পা তখনও চেপে আছে। আক্কাস ঘাড়টা একটু ঝাঁকিয়ে গাড়ির সামনের দিকে তাকানোর চেষ্ট করে। একটু দূরেই একজন নারী করুণভাবে দাঁড়িয়ে আছে। তার চারপাশে পুরুষের হুড়োহুড়ি। নিজের শরীরটাকে কোনোরকমে আড়াল করার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হচ্ছে।

গাড়ি ফার্মগেট এলে ভেতরে কিছু জায়গা খালি হলো। আক্কাস যেনো হাঁফ ছেড়ে বাঁচে। কিন্তু তা মুহূর্তের জন্য। কারণ, এরপর যে জনস্রোত গাড়ির ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়ে তা আক্কাসের কল্পনাতীত। গাড়ি কানায় কানায় পূর্ণ হওয়ার পরও চার পাঁচজন গেট ধরে ঝুলে থাকে। এরপর আরেকজন যাত্রী লাফ দিয়ে ঝুলে থাকা একজনের কোমর জড়িয়ে ঝুলতে থাকে। লোকটি গালাগাল করতে করতে অপর যাত্রীকে নামতে বলে। কিন্তু সে কিছুতেই নামে না। তারপরও হেলপার টঙ্গী, আবদুল্লাপুর বলে চিৎকার করতে থাকে। গাড়ির ভেতর থেকে যাত্রীরা ড্রাইভারকে অকথ্য ভাষায় গালাগাল করতে থাকে। তাও গাড়ির নড়ার কোনো লক্ষণ দেখা যায় না। মিনিট দশেক পর গাড়ি ধীরে ধীরে চলতে শুরু করে। তখন আক্কাসের ঘাড়ের ওপর তিনজন উপুড় হয়ে আছে। দুই পায়ের ওপর চাপা দিয়ে আছে লোহার মতো শক্ত দু’টি পা। কিছুক্ষণ চলার পর গাড়ি আবার থেমে যায়। সামনে নাকি ব্যাপক যানজট। বিশ মিনিট অতিক্রান্ত হলেও গাড়ি নড়ার কোনো লক্ষণ নেই। আক্কাসের কাছে একেকটি সেকেন্ড একেকটি দিনের মতো মনে হতে থাকে। তার খুব পাশেই দাঁড়ানো উঠতি বয়সী একটি মেয়ে। দেখে মনে হয় ক্লাস টেনে পড়ে। আক্কাসের হঠাৎ মনে পড়ে যায় তার পঞ্চম শ্রেণি পড়ুয়া মেয়ে ফাতেমার কথা। বুকের ভেতরে হঠাৎ কেমন যেন হু-হু করে ওঠে। মেয়েটা আজ দুপুরে খেতে পেয়েছে কিনা কে জানে। গতকাল জব্বার মুন্সির কাছ থেকে ধার করে এককেজি চাল এনে দিয়েছিল বউকে। আর হকু মিয়ার দোকান থেকে অনেক অনুনয় বিনয় করে এককেজি আলু বাকিতে কিনেছিল। সে ঢাকায় যাচ্ছে। ভালো চাকরি করবে। এরকম নানা গল্প করে পাষাণহৃদয় হকু মিয়ার মন গলাতে হয়েছিল। আজ রাতে বউ ছেলে-মেয়ে কী খাবে আল্লায় জানে। ছোট ছেলে হোসেন ক্লাস টুতে পড়ে। না খেতে পেয়ে শরীরটা যদিও কঙ্কালসার, তবু পড়াশোনায় মতি ভালো।

‘হাত সরান গা থেকে হাত সরান’ হঠাৎ পাশের মেয়েটার ঝাঁঝালো গলার আওয়াজ শুনে আক্কাস বাস্ততবতায় ফিরে আসে। মেয়েটার বুকের কাছ থেকে ঝোঁকের  মতো একটি হাতকে আক্কাস আলগোছে সরে যেতে দেখে। প্রায় আধঘণ্টা পর জট ছাড়ালে গাড়ি চলতে শুরু করে। আক্কাসের চিন্তার জটও ধীরে ধীরে খুলতে থাকে। সে ভাবতে শুরু করে শামছু মিয়ার কথা। টঙ্গী বাজারে সে থাকে। অবশ্য তার কাছে ঠিকানা লেখা একটা ছেঁড়া কাগজও আছে। এটা লোকজনকে দেখিয়ে দেখিয়ে এ পর্যন্ত এসেছে। বাজারে নেমে কাউকে কাগজটা দেখালে নিশ্চয়ই বাসাটা দেখিয়ে দেবে। তবু রাত বেড়ে যাওয়াতে আক্কাসের ভেতরে এক ধরনের ভয় আর অনিশ্চয়তা কাজ করতে থাকে। ঢাকা শহরে তার এবারই প্রথম আসা। যদিও এই শহরের গল্প সে অনেক শুনেছে। গ্রাম থেকে ঢাকা শহরকে তার কাছে কল্পপুরী মনে হলেও এখন জলজ্যান্ত এক নরক বলেই মনে হচ্ছে। গতকাল পর্যন্ত তার কাছে ঢাকায় আসার গাড়ি ভাড়াও ছিলো না। কেরামত মুন্সি চড়া সুদে টাকা ধার দেয়। একশো টাকায় মাসে দশ টাকা সুদ। তার কাছ থেকে পাঁচশো টাকা গাড়িভাড়ার জন্য ধার নিয়েছে আক্কাস। যদিও টাকা নেওয়ার সময় তার ভীরু বুক দুরু দুরু করে কাঁপছিল। চিন্তা হচ্ছিল, শোধ করতে পারবো তো? কিন্তু না নিয়ে উপায় ছিলো না। অবশ্য ঢাকায় কোনোরকমে পৌঁছাতে পারলে তো টাকার অভাব হবে না; এরকম একটা সাহসও তার মনে ছিলো। ঢাকা শহরে নাকি টাকা ওড়ে। আক্কাসের পাশের বাড়ির রহমত মিয়া একদিন কথাটা বলেছিল। ঢাকায় তিনি তিতাস গ্যাস কোম্পানিতে পিয়নের কাজ করেন। কিন্তু বাড়িতে দুইতলা বিল্ডিং করেছেন। কয়েক বিঘা জমিও কিনেছেন। ফলে কথাটা আক্কাসের বিশ্বাস হয়েছিল। কিন্তু এখনতো মানুষ আর যানজট ছাড়া কিছুই দেখছে না সে। মহাখালী পার হয়ে চেয়ারম্যান বাড়ি এসে গাড়ি আবার তীব্র যানজটে পড়ে। আধঘণ্টা পার হয়ে গেলেও গাড়ি নড়ে না। এদিকে রাত প্রায় সাড়ে দশটা বেজে গেছে। আক্কাস এবার সত্যি সত্যি ভয় পেতে শুরু করে। অবশেষে অজগরের মতো ধীরে ধীরে গাড়ি সামনে এগোয়। কন্ডাক্টার এয়ারপোর্ট এয়ারপোর্ট বলে হাঁক ছাড়লে আক্কাস ভিড়ের মধ্যে ঘাড় বাঁকা করে একবার দেখার চেষ্টা করে। আলো ঝলমলে এয়ারপোর্টের কিছুটা অংশ চোখে পড়তেই তার বুকের ভেতরে আলোড়ন শুরু হয়। গত বছর মিন্দার মেজোভাই সৌদি আরব থেকে দেশে এলে তাকে এগিয়ে নেওয়ার জন্য আক্কাসকেও এয়ারপোর্টে আসতে অনুরোধ করেছিল মিন্দা। কিন্তু আক্কাসের বউ তাকে আসতে দেয়নি। মনে মনে বউকে এখন দুইটা থাপ্পড় লাগাতে ইচ্ছা করে আক্কাসের। কী এমন ক্ষতি হতো একবার আসতে দিলে? তখন তো আর ভাড়া তার নিজের দেওয়া লাগতো না। এতো সুন্দর এয়ারপোর্টটাও তার একবার ভালো করে দেখা হতো। হঠাৎ হেলপারের টঙ্গী বাজার, টঙ্গী বাজার ডাক শুনে আক্কাস হুশ ফিরে পায়। ‘আল্লার রহমতে চইলা আইছি তাইলে’ ভাবতে ভাবতে অন্য যাত্রীদের সঙ্গে আক্কাসও নেমে আসে। কিন্তু গাড়ি থেকে নেমে পকেটে হাত দিয়ে তার চক্ষু চড়কগাছ। পকেট থেকে অবশিষ্ট টাকা আর ঠিকানা- দু’টোই উধাও। বিস্ময়ে বিমূঢ় হয়ে রাত্রির অন্ধকারকে আরও গাঢ় করে দিয়ে আক্কাস আলী রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকে। কিছুদূর থেকে দূর গন্তব্যে ছুটে যাওয়া ট্রেনের ঝক ঝকাঝক ধ্বনি আক্কাসের চেতনাকে বধির করে দিয়ে ছুটে যায়।

বাংলাদেশ সময়: ০৯৪৪ ঘণ্টা, জুলাই ১১, ২০১৬
এসএনএস
 

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।