অামাদের ছোটবেলার কথা অামি বলতেই পারি, নিজে দেখেছি তো। খৃষ্টাব্দ অনুযায়ী বিশশতকের অাশির দশক কালপ্রবাহই অামার ও অামাদের বয়েসিদের স্কুল-কলেজ পেরুনো বয়স।
তো গতশতকের অাশির দশককেও এমন দেখেছি, যে ছাত্রটি মেধাবী, সাধারণভাবে তার একটি ক্যারেক্টর-মডেল ছিল সমাজে। যদিও ভালো ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে হয়তো একাধিক রকম অংশই থাকে। একটি অংশের যারা, তারা খালি পাঠ্যপুস্তক পড়ে পরীক্ষায় বেশি নম্বর পওয়াকেই জীবনের ধ্যান-জ্ঞান ভেবে যা করার করেছে। এদের প্রধান লক্ষ ছিল ভবিষ্যতে ভালো একটা চাকরি পেয়ে বিয়ে করে ভালো করে সংসারের অায়-উন্নতি করা। সংসারের অায়-উন্নতি বলতে ঘুষ-ঘাস খেয়ে দুর্নীতি করে দ্রুত টাকা কামিয়ে একটু 'বড় লোক' হওয়া। এই অংশ বেশিরভাগই ঢুকেছে মেডিকেলে, ডাক্তার হয়ে নিজের গরিবি দশা দূর করার অাশায়। এদেশের লোক যে স্বাস্থ্য সচেতন নয়, সবাই জানে। কিন্তু জীবনে সবাই বাঁচতে চায়। ঠিক এই সুযোগটাই নিতে চায় মেডিকেলে ঢোকা বাংলার মানুষের 'সেবা' করতে চাওয়া হবু ডাক্তারের দল। অন্যদিকে কেউ ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে ঢুকেছে, তার অাগে সে হয়তো ঢুকেছিল বুয়েটে, ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ে পাশ করার জন্যে। তারপরই তো ভালো ছাত্রের সংসারি জীবনের অায়-উন্নতি। তিনি তখন বিরাট প্রকৌশলী। তাছাড়া দেশের অবকাঠামো-উন্নয়নের কত কাজ, কত বাজেট... হতচ্ছাড়া সংসারে তখনই একটু 'বড় লোক' হওয়ার মওকা। অার ভালো ছাত্রছাত্রীদের অারো একটা অংশের ঝোঁক, অাইন পেশার দিকে। উকিল-ব্যারিস্টার ব্যাপারটা তো খুই নামী ব্যাপার। কারণ, এদেশের লোকের পেটে ভাত না জুটলেও একে-অন্যের সঙ্গে ফ্যাসাদে জড়াবেই। তো, সেই সুযোগটা সেদিনের ভালো ছাত্র বা অাজকের উকিল-ব্যারিস্টার নেবে না? তা না হলে অার ভালো ছাত্রত্বের মাজেজাটা কোথায়?
ভালো ছাত্রদের ভিড়ে খারাপ ছাত্ররা বা 'পানিপথের যুদ্ধ' কবে কোথায় কি কারণে হয়েছিল--এসব মুখস্ত না করা ছাত্রছাত্রীরা হারিয়ে গেছে। তারা কোথায় গেছে? ভালো ছাত্র-বন্ধুরা তো ব্যস্ত কামাই করতে, 'খারাপ ছাত্রছাত্রীদের' পেশা কি হলো? তারাই তো সংখ্যায় বেশি। অাবার তথাকথিত পাঠ্যপুস্তকে মনোযোগ রেখেও অারেকদল, তারা পাঠ্যপুস্তকের সীমানা ডিঙিয়ে গেছে। অামাদের শৈশবে সেই অংশের ছাত্রছাত্রীদের খুব চেনা গোর্কির 'মা' 'পৃথিবীর পথে' পৃথিবীর পাঠশালায়' অস্ত্রভস্কির 'ইস্পাত' রবীন্দ্র-নজরুল-সুকান্ত-শরৎ বা 'ছোটদের অর্থনীতি' কতরকম বইয়ের ভেতর দিয়ে নিজেকে অাবিষ্কার করার সুযোগ পেয়েছে তারা! মানুষ হিসেবে নিজেকে অারেকটু সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার এক নেশা তো! পৃথিবীর কত কী ভিন্ন ভিন্ন মানুষের জীবন-বাস্তবতায় নিজেকে জড়িয়ে নিতে পারার এক অানন্দ। অামরা তখন 'হাজার চুরাশির মা' কে পড়ে ফেলি। চোটি মুন্ডার কথা পড়ি। ফলে, মহাশ্বেতা দেবীকেও অামরা চিনি, অামাদের শৈশব থেকেই। যেমন চিনি সোমেন চন্দকে। যেমন চিনি পাভেলকে, পাভেল করচাগিনকে। এসব চিনতে চিনতে অার অামার 'ভালো ছাত্র' ভালো লাগে না। কেন না, সেদিনের ভালো ছাত্রই পরবর্তীকালের ডাক্তার, উকিল-ব্যারিষ্টার বা ইঞ্জিনিয়ার। সেদিনের ভালোছাত্রই জাবরকাটা প্রশ্ন মুখস্থ করে পরবর্তীতে বুরোক্রেটিক ক্যাডার, যিনি পেশার খাতিরেই পরবর্তীতে ছাত্রজনতার উপরে পুলিশ লেলিয়ে দেবেন, অাইনের সেবাদাসে প্রমোশন পাবেন। এরকমই দেখলাম, কাজেই বইপত্র পড়ে অামি এসব বলছি না, একটি সমাজের মধ্যে থেকে, দেখে তারপরে বলছি। অর্থ দিয়েই যেখানে মানুষ মূল্যায়িত হয়ে, অার সব কিছু ঠুনকো যেখানে, শ্রেণি বিভাজনই সত্য যেখানে, এরকম একটি অাধিপত্যবাদী সমাজের মধ্যেও, যারা এরকম অন্যায় অাধিপত্যকে অস্বীকার করেছেন, অস্বীকার করতে প্রাণ সঞ্চারণ করেছেন, তাদেরই একজন লেখক মহাশ্বেতা দেবী। ৯০ বছর বয়সে তিনি কোলকাতায় প্রয়াত হলেন। তাকে শ্রদ্ধা জানাই। এই অভাগা দেশেই তিনি জন্মেছিলেন। বাংলা ভাষাতেই তিনি লড়েছেন, লড়াইয়ের জন্যে সাহস রেখে গেছেন। দুর্বৃত্তপীড়িত সমাজে মহাশ্বেতা দেবীর মতো লেখক বিরল। এ কারণেই তিনি বিশেষভাবে নমস্য থাকবেন, অামাদের কাছে, দুর্বৃত্তদের কাছেও।
২০০২ সালে কোলকাতার গলফ গ্রিনে, লেখক ও অ্যাক্টিভিস্ট মহাশ্বেতা দেবীর বাসায় তার সঙ্গে অামাদের দেখা হয়েছিল। অামি অার শাহনাজ মুন্নী তরুণ কবি বা লেখক হিসেবে অামন্ত্রিত হয়ে কোলকাতায় গিয়েছিলাম। সেই অামার প্রথম 'কলিকাতায় যাওয়া'। তো সাহিত্য অাকাদেমির পক্ষ থেকে অারুণি চক্রবর্তী যেমন সঙ্গে ছিলেন, অারেকজন অপরিচিত লোক ছিলেন ট্যাক্সিতে, যিনি অামাকে সিগারেট দিচ্ছিলেন অার অামাদের দেখা বাংলাদেশ নিয়ে প্রশ্ন করে যাচ্ছিলেন। ট্যাক্সি পৌঁছুল গলফ গ্রিনে, মহাশ্বেতা দেবীর বাসায়। কোলকাতায় পিএইচডি করতে যাওয়া নরসিংদীর শ্রীকান্ত চন্দ্রও সেদিন ছিলেন অামাদের সঙ্গে।
দোতলা বাড়ির নিচতলার খুবই শাদামাটা ড্রইংরুমে অামরা অপেক্ষা করছি। ট্যাক্সিতে অামাদের সঙ্গে থাকা মিডলঅাপ এজের লোকটা মহাশ্বেতা দেবীর ড্রইংরুমে বসেই নিজে সিগারেট ধরালেন, অামাকে সাধলেন। অামি বললাম, 'মহাশ্বেতা দেবী ঢুকবেন না এখন?'
উনি বললেন, 'অসুবিধা নেই, ধরান। '
অামি সিগারেট ধরালাম এবং তক্ষুণি বাসার ভেতরের এক ঘর থেকে ড্রইংরুমে ঢুকতে ঢুকতে মহাশ্বেতা দেবী বললেন, 'কই, অামার বাংলাদেশের তরুণ লেখকরা কই?'
অারুণি দা অামাকে অার মুন্নীকে দেখিয়ে দিলেন--'এরা দুজন'। অার তক্ষুণি, মহাশ্বেতা দেবী অামার থুতনিতে হাত দিয়ে ধরে অাদর করে বললেন, 'তুমি তো অামার নাতির বয়েসি মনে হয়। '
অামার হাতে সিগারেট, অামি একটু বিব্রত হচ্ছি হয়তো, সেটা দেখে, মহাশ্বেতা দেবী বললেন, 'টানো, বাপ্পা তো অামার সামনেই খায়। এটা তো তোমার নেশা, অামার জন্যে অফ রাখার কি অাছে?'
তখন জানলাম, বাপ্পা বলতে ট্যাক্সিতে বা এই ড্রইংরুমে বসে অামাকে যিনি সিগারেট দিলেন, তিনিই এবং তিনি মহাশ্বেতা দেবীর একমাত্র ছেলে। মানে তিনি নবারুণ ভট্টাচার্য, 'নবান্ন'র বিজন ভট্টাচার্যের সন্তান। মৃত্যু উপত্যকাকে দেশ বলতে অস্বীকৃতি অাছে যার। 'ফ্যাতাড়ু'র সম্পাদক নবারুণ দা তো গতবছরই চলে গেলেন। অাজ, ৯০ বছর বয়সে চলে গেলেন তার মা, মনীশ ঘটকের মেয়ে বা ঋত্বিক ঘটকের ভাতিজি মহাশ্বেতা দেবী।
সেদিন, গলফ গ্রিনের সেই বৈঠকখানায় ঋত্বিকের কথা উঠেছিল, ঋত্বিকের যমজ প্রতীতি দেবীর কথা উঠেছিল। মহাশ্বেতা দি তার বাবা মনীশ ঘটকের জন্মশতবর্ষের অনেক জার্নাল, লিটল ম্যাগাজিন দিয়েছিলেন অামাদের।
ঢাকায়, সিদ্বেশ্বরীতে মেয়ের বাসায় থাকেন শহীদ রাজনীতিবিদ ধীরেন দত্তের পুত্রবধু, সন্দিপ দত্তের স্ত্রী প্রতীতি দেবী। প্রতীতি দি'র সঙ্গে গল্পে গল্পে মহাশ্বেতা দেবীর কথা শুনেছি--' ও খুকু? খুকু অার অামার-ঋত্বিকের বয়সের পার্থক্য মাত্র ৩ মাসের। খুকু অংক পারত না। '
খুকু হচ্ছেন মহাশ্বেতা দেবী। প্রতীতি দি ভবি, ঋত্বিক হচ্ছেন ভবা। ভবা-ভবি যমজ, কিন্তু '৪৭-এর দেশভাগের ফলে ভবা হয়ে গেলেন ইন্ডিয়ান, ভবি পূর্ব-পাকিস্তানি। তাই ঋত্বিকের চেয়ে দেশভাগের জ্বালা কে অার বেশি পেয়েছেন? ঋত্বিকের মতো দেশভাগ এত ভালো কে অার ধরেছেন?
১৯২৫ সালে ঋত্বিক-প্রতীতি ও ১৯২৬ সালে মহাশ্বেতা ঢাকায় জন্মগ্রহণ করেন। এই যমজের ভাইঝি প্রয়াত হলেন।
'হাজার চুরাশির মা', মহাশ্বেতা দেবী অমর রহে।
বাংলাদেশ সময়: ১৪০০ ঘণ্টা, জুলাই ২৯, ২০১৬
এসএনএস