ঢাকা, শুক্রবার, ৬ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২২ নভেম্বর ২০২৪, ২০ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

শিল্প-সাহিত্য

মহাশ্বেতা দেবীর স্বাধীন অরণ্য | এনামুল রেজা

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১০১৭ ঘণ্টা, জুলাই ৩১, ২০১৬
মহাশ্বেতা দেবীর স্বাধীন অরণ্য | এনামুল রেজা

ছেলেবেলায় কী হতে চান এমন এক প্রশ্নের জবাবে বলেছিলেন, “কিছুই হতে চাই না”। তখন তিনি দাঁড়িয়ে আছেন ৮৪ বছর বয়সে, ঢাকায় এসেছেন বেড়াতে।

আরও চমকপ্রদ ব্যাপার ঘটে পরের কিছু প্রশ্নে, জানতে চাওয়া হলো, ঢাকা যেহেতু জন্মস্থান, এখানে এলে অনুভূতিটা কেমন হয়? উত্তর আসে, “ভালো লাগে। বিশেষ কোনো ভাবনা মাথায় আসে না। জীবনে এতসব জায়গায় ঘুরেছি যে কোনো স্থানের প্রতি আর নাড়ির টান অনুভব করি না”। এই এক উত্তরে তার সমগ্র জীবনের যে দীর্ঘ যাত্রা, অভিজ্ঞতা ও ঋদ্ধতায় পরিপূর্ণ, সেটি পরিষ্কার হয়ে ওঠে।  

মহাশ্বেতা দেবীকে নিয়ে লিখতে বসলে শুধু লেখক হিসেবে তার মূল্যয়ন করাটা অনুচিত হয়ে দাঁড়ায়। রাইটারের ক্র্যাফট, বৈশ্বিক চিন্তাভাবনা, গল্পের উত্তেজনা— শুধু এসমস্ত মিলিয়ে তাকে বোঝা যাবে না। তিনি অনেকগুলো উপন্যাস লিখেছেন, মানুষের আনন্দ-বেদনার দিনপঞ্জী হয়ে উঠেছে সেসব, কিন্তু শুধু কি লিখেছেন লেখকের অভিজ্ঞতায় ভর করেই? এমন মনে হয় না। মাঠ পর্যায়ে নিপীড়িত মানুষের সঙ্গে মিশেছেন স্বশরীরে, দেখে এসেছেন কাছ থেকে— তাদের অধিকার আদায়ের দাবিতেই মূলত সত্যিকার লেখক হিসেবে তার জার্নিটা শুরু হয়েছে। ঝাঁসির রাণী লক্ষ্মীবাইয়ের যে আত্মজীবনী তিনি লেখেন ১৯৫৬ সালে, তার প্রস্তুতি হিসেবে তিনি ঝাঁসিতে গিয়েছেন, সেখানকার লোকজনের সঙ্গে কথা বলেছেন, লোকগীতি থেকে আহরণ করেছেন রাণীর বৃটিশবিরোধী যে রিবেলিওন, সে সম্পর্কে বিস্তারিত— এমন তো না যে ওই “ঝাঁসির রাণী” নামক লোকগীতির সন্ধান পাওয়া পশ্চিমবঙ্গে বসে অসম্ভব ছিলো।  

তার জীবনের দীর্ঘ কালপর্ব কাটে আদিবাসীদের সঙ্গে। তাদের মধ্যে সাঁওতাল ছিলো, মুন্ডা ছিলো— যারা নানারূপেই স্বাধীনভারতে বঞ্চিত চিরকাল, স্থানীয় প্রশাসন ও সরকার যে তাদের অধিকার কেড়ে নিতে সদা তৎপর, এসমস্ত বেদনা মহাশ্বেতা বুঝতে পেরেছিলেন তাদের নিকটে গিয়েই। বৃটিশবিরোধী আন্দোলনেও সাঁওতাল ও মুন্ডাদের উজ্জ্বল বীরত্বব্যাঞ্জক ইতিহাস অতীত থেকে আমজনতার ড্রয়িংরূমে নিয়ে আসেন তিনিই। অরণ্যের অধিকার উপন্যাসে তিনি বিরসা মুন্ডার আন্দোলনের জান্তব চিত্র ডেপিক্ট করেন, জান্তব হয় এ কারণেই যে স্থানীয় মুন্ডাদের মুখে মুখে গাওয়া গান ও গল্প, তাদের নিত্যজীবনের একান্ত শ্বাসকে মহাশ্বেতা তার হৃদয়ে প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছিলেন— একইরূপে পাঠকের হৃদয়েও কি তা মিশে যায় না? 

সবচেয়ে বিখ্যাত ও জনপ্রিয় উপন্যাস ‘হাজার চুরাশির মা’-ও বয়ান করে এক ব্যর্থ আন্দোলনে মহৎ ও বিপ্লবীর মৃত্যুর গল্প কিংবা তার মায়ের। ব্যর্থ আন্দোলন কেন হয় কোনো মহৎ দর্শন? কিংবা জগতের সব মহান দর্শনও তো ব্যর্থ হয়ে ওঠে একটা সময়ে, মানুষের লোভের কাছে পরাজিত হয়ে যায়— আর যারা স্বপ্ন দেখে এক উজ্জ্বল ও শোষণমুক্ত সমাজের, তারা নাম ও ব্যক্তির বদলে হয়ে দাঁড়ায় লাশ এবং সংখ্যা। উপন্যাসের মূল চরিত্র ব্রতী যে সমাজের ভোগবাদী আর সকলের চেয়ে আলাদা, ১৯৭১ সনের পশ্চিমবঙ্গের পুলিশী ম্যাসাকারের বলী এই যুবক মারা গেলে তারা কী অবলীলায় ভুলে যায় ব্রতীর সংগ্রাম, পিতা দিব্যনাথ সন্তানের নাম মুছে দিতে চেষ্টা করে- পরিবারের অন্যরা তাকে শত্রুভেবে নেয়! শুধু মা সুজাতা বুঝতে পারেন, আজন্ম তিনি যে স্বপ্ন লালন করেছেন, সে ওই ব্রতীই। এ উপন্যাসে একাধারে ফুটে ওঠে নকশাল আন্দোলনের বেদনাদায়ক দিক এবং এক মায়ের জীবন সংগ্রাম, নারীত্বের অবমাননা ও মুক্তির আকাঙ্ক্ষা।  

পশ্চিমবঙ্গের পুরুলিয়াতে স্বগঠিত আদিবাসী সংঘতার মানবাধিকার সচেতনতার চিহ্নই বহন করে। বস্তুত সমাজের রাজনৈতিক ও ঐতিহাসিক সঙ্কট থেকে বিচ্ছিন্ন মানুষ, চিন্তাবিদ ও লেখকদের তিনি মোটামুটি পরিহাস ও ক্ষোভের চোখে দেখতেন, এটা এক রকমের প্রতিবাদ ছিলো এ কথাশিল্পীর তরফ থেকে। নিপীড়িতদের নিয়ে কথা বলাটাকে জীবনের আপ্ত বাক্য মনে হতো যেহেতু, নারীদের বঞ্চনা ও অধিকার সচেতনতা নিয়েও তার কলম সচল হয়েছে বারবার, শুধু লিখে চলেননি— মাঠ পর্যায়ে বারবার নেমে এসেছেন আন্দোলনে। এসবের মধ্যে স্মরণ করা যায় পশ্চিমবঙ্গ সরকারের জমি অধিগ্রহণের প্রতিবাদে করা আন্দোলনের কথা।  

মহাশ্বেতার লেখালেখির শৈলী বিবেচনা করতে গেলে আমাদের অবাক হতে হয়; আপাত দৃষ্টিতে নিস্তরঙ্গ এবং জৌলুসহীন গল্পতৈরির কৌশলটি ধীরে ধীরে পাঠককে তার সঙ্গী করে তোলে, অতি সাধারণ ন্যারেশনেই জীবনের গহন রূপটি তিনি তুলে ধরেন প্রতিটি লেখায়, বিশেষত তার উপন্যাসের জটিল প্লটগুলোর জন্য এমন সহজ ও জীবন্ত ন্যারেশনই হয়তো জরুরি ছিলো, লেখক হিসেবে কারিকুরি দেখানোর চাইতে তিনি বরং অধিক আগ্রহী ছিলেন বক্তব্য পরিষ্কারে। একারণেই তার উপন্যাসের চরিত্রগুলোর মাঝে সংগ্রাম ভিন্ন আর কিছু আমরা কম দেখি— কেননা তার দেখা প্রান্তিক মানুষেরা আজন্ম কাটিয়ে দেয় স্বাধীনভাবে বাঁচার যুদ্ধেই। নিজে এ প্রসঙ্গে তাই হয়তো লিখেছিলেন, “আমি চিরদিন বিশ্বাস করেছি প্রকৃত ইতিহাস রচিত হয় আমজনতার হাতে.. সেসব মানুষই আমার লেখালেখির কারণ ও অনুপ্রেরণা যারা দলিত হয়েছে, শোষকের দ্বারা নির্যাতিত হয়েছে অথচ পরাজয় স্বীকার করেনি কখনও”।

মহাশ্বেতা দেবী জন্ম নেন ঢাকায়, ১৯২৬ সালের ১৪ জানুয়ারি। বেড়ে ওঠা, জীবনযাপন ছিলো পশিমবঙ্গেই। পেশা জীবনে কী না করেছেন, পোস্ট অফিসে চাকরি কিংবা দরিদ্র-অশিক্ষিত লোকজনকে ইংরেজিতে চিঠি লিখে দেওয়া, সাংবাদিকতা, শিক্ষকতা। এ সমস্তের মাঝেই লেখালেখি ও সমাজকর্ম চলেছিল সমতালে; তার উপন্যাসের মাঝে উজ্জ্বলতম হচ্ছে- হাজার চুরাশির মা, অরণ্যের অধিকার, অগ্নিগর্ভ, চোট্টি মুণ্ডা এবং তার তীর, স্তনদায়িনী, কৃষ্ণা দ্বাদশী— বাংলা সাহিত্যের অমূল্য সম্পদ হিসেবেই বিবেচিত হবে। এই যে জুলাইয়ের ২৮ (২০১৬) অন্যভুবনে পাড়ি জমালেন ৯০ বছরে পৌঁছে, হয়তো ঔপোন্যাসিক মহাশ্বেতার এক নতুন সূচনাই হলো। এখন লোকে সবদিক মিলিয়েই তাকে বিবেচনা করুক।

বাংলাদেশ সময়: ১০১১ ঘণ্টা, জুলাই ৩১, ২০১৬
এসএনএস
 

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।