ঢাকা, শুক্রবার, ৬ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২২ নভেম্বর ২০২৪, ২০ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

শিল্প-সাহিত্য

বিদগ্ধ সময়ের পাঠমুগ্ধপুরে ‘দিকশূন্যপুর’

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২০৩৫ ঘণ্টা, আগস্ট ৫, ২০১৬
বিদগ্ধ সময়ের পাঠমুগ্ধপুরে ‘দিকশূন্যপুর’

মাহবুব ময়ূখ রিশাদ। তরুণ গল্পকার।

তার তৃতীয় গল্পগ্রন্থ ‘দিকশূন্যপুর’ প্রকাশিত হয়েছে চলতি বছর একুশে বইমেলায়।
গ্রন্থের গল্পগুলোতে চিত্রায়িত হয়েছে সাম্প্রতিক সময়ের তারুণ্য। তবে গল্পগুলোর আঙিনা সহজেই আশির দশক পর্যন্ত পিছিয়ে দেওয়া যায়। তাই শুরু থেকে শেষ অবধি একটা নষ্টালজিয়ার ভেতর দিয়ে পরিভ্রমণ হবে পাঠকের। এ গল্প আমার গল্প, আমাদের গল্প, আমাদের সময়ের গল্প! চরিত্রগুলো বদলেছে, ডিটেইলড বদলেছে কিন্তু ক্যানভাস বদলায়নি, উপজীব্য বদলায়নি। পড়তে পড়তে মনের পর্দায় ভেসে ওঠে আমাদের ক্যাম্পাস জীবন।
লেখকের নিজের কথায় ‘আকাশে বাতাসে ধূলিকণার মতো গল্প উড়ে বেড়ায়। আমি ধরতে পারছি না। মুঠো গলে বের হয়ে যায়...... /কোন গল্প বানানো হয় না’ (ডেলফিনার কবুতর)। আসলেতো তাই। জীবনের অতি পরিচিত গল্পগুলোই লেখকেরা তুলে আনেন তাদের নিজস্ব রং তুলিতে।

‘দিকশূন্যপুর’ও তেমন গল্পেরই সংকলন। সে জন্যই রিলেট করা সহজ হয়েছে। জীবনের কিছু কিছু অনিবার্য অনুষঙ্গ রিশাদের মুঠো গলে বের হয়ে যেতে পারেনি। তিনি ঠিকই মুঠোবন্দি করে আমাদের সামনে তুলে ধরেছেন।
 
পড়তে গিয়ে তার লেখার ধরন অনেক ক্ষেত্রেই কবিতাশ্রয়ী মনে হয়েছে। এ ধরনের গল্প বলার ঢং বুকের গভীরতম প্রদেশকে আন্দোলিত করে। রিশাদের গল্পের পরতে পরতে এধরনের কবিতার পংক্তি সাজানো।
‘নাহোলের চোখ দিয়ে পানি পড়তে দেখি, ঠিক যেন পাথর ধুয়ে যাচ্ছে শিশির কণায়, বিষণ্ন কিন্তু সুন্দর!’
(দিকশূন্যপুর)
কি সুন্দর কিন্তু বিষণ্ন চিত্রকল্প!
 
অথবা
‘...টের পাচ্ছি আমার ফুসফুসে ভেসে আছে পুরাতন ডুবসাঁতারে ভিজে যাওয়া শাপলা ফুল। ’ (দোতারা)
গল্পগুলোর উপস্থাপন চমৎকার। কেন্দ্র থেকে পরিসীমায় না গিয়ে বরং পরিসীমা থেকে ধীরে ধীরে কেন্দ্রে যাওয়ার প্রবণতা লক্ষণীয়। প্রথমেই গতিবিধি বোঝা যাবে না। কিন্তু গল্পের কেন্দ্রে প্রবেশের কৌত‍ূহল হবে। পাঠক গল্পের সঙ্গে একাত্ম হয়ে প্রবেশ করবেন তার কেন্দ্রে। কোথাও ঘটনার ঘনঘটা নেই। কিন্তু প্রায় প্রতিটি গল্পের চৌহদ্দিতেই একাধিক গল্প রয়েছে। মাত্র কয়েক পৃষ্ঠায় একটি গল্পের মোড়কে একাধিক গল্পের উপস্থাপনা, 'নাহি তত্ত্ব, নাহি উপদেশ' এর মধ্যেও মনস্তাত্ত্বিক টানাপড়েন, জীবনদর্শন এবং সবশেষে নিজস্ব বক্তব্য প্রতিফলিত হয়েছে চমৎকার মুন্সিয়ানায়।

গ্রন্থের ১১টি গল্পের সবগুলোই মনস্তাত্ত্বিক উৎকর্ষের বিচারে উত্তীর্ণ। তবুও আমি প্রথম আর শেষ গল্প যথাক্রমে 'দিকশূন্যপুর' এবং 'ডেলফিনার কবুতর'কে এগিয়ে রাখবো। গল্প দু'টো পড়তে গিয়ে আমার রিশাদকে নিছক গল্পকারই নয়, বরং মনোবিদ্যা বিশারদও মনে হয়েছে। দিকশূন্যপুরে আমাদের চারপাশের জগতটিকে নাহোলের একটু ভিন্নভাবে দেখা আর নাহোলের জুতোয় পা দিয়ে (Standing on Nahole's shoes) নীরার অনুভব করতে চাওয়া আমাদের অতি পরিচিত কাউকে মনে করিয়ে দেয়। তেমন কেউতো আমাদের চারপাশেই ঘুরঘুর করছে।

'দোতারা'কে প্রাত্যাহিক জীবনের চালচিত্র বলা যেতে পারে। জীবনের সৌন্দর্যের মধ্যেও দেখা যায় এক ধরনের নিষ্ঠুরতা ব্লেন্ড করা। লাইফ অ্যাট ইটস আনকাট ভার্সন। 'ঝড়ের যাদুঘর'-এ একটা দুঃস্বপ্ন আর পরাবাস্তবতার মাখামাখি আছে। আমাদের কৈশোরের কোনো বন্ধুর কথা মনে পড়ে যাবে, যার সঙ্গেহয়তো পুরোপুরি সুবিচার করতে পারিনি। 'মৃত্যুস্পর্শী রোদ' বাস্তবতার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আমাদের অসহায়ত্বের একটি মৃত্যুস্পর্শী গল্প। পড়তে ভালো লাগবে। কিন্তু শেষ হলে দীর্ঘশ্বাসটি এড়ানো যাবে না। 'লাঠি' গল্পটি রূপকাশ্রয়ী। যদিও দর্শন আছে, তবুও দর্শনের চেয়ে ক্যাম্পাস জীবনের আড্ডার দিনগুলোই বেশি মনে করিয়ে দেয়।

'রক্তাক্ত শহরে' ও 'কাঁটাচামচের ভুলযাত্রা' মোটামুটি একই ধরনের উপজীব্য নিয়ে লেখা। ধর্মীয় মৌলবাদ আর জঙ্গিবাদের থাবায় ক্ষতবিক্ষত আমাদের অস্থির সময়টিকে চিত্রায়িত করা হয়েছে। সেই সঙ্গে আমাদের সম্মিলিতি নির্লিপ্ততা আর আধা প্রগতিশীলতার মুখোশে লুকোনো আমাদের মৌলবাদী মুখচ্ছবিটিও আঁকতে ভুল হয়নি।

‘আমাদের সংগে হাজার হাজার মানুষ, তারা কেবল মুখোশ পরে আছে, একটু টোকা দিলেই সব চলে আসবে, ভয় পাবি না, একদম না’। (রক্তাক্ত শহরে)। এই হলো সময়ের চিত্র। আমাদের মুখোশের ভিতরে লুকিয়ে থাকে ওরা, হলি আর্টিজানে যায়, কল্যাণপুরেও। তারাই হুঙ্কার দেয় ‘বিপথে থাকা মানুষদের মরণ  হবে রক্তের ভেতরে’। (কাঁটাচামচের ভুলযাত্রা)। তারা জানে ‘লোক-দেখানো সামাজিকতা ভাইরাসের মতো যেখানে নিঃশেষ করেছে সবাইকে, সেখানে কেউ-কেউ সমাজ বদলের স্বপ্ন দেখে – কী বোকা’! তবে এতোটুকু সমাজবিশ্লেষণের মধ্যেও গল্পগুলো মোটেও গল্পের চরিত্রচ্যুত হয়নি। মানবিক চাওয়া পাওয়া আর প্রবৃত্তির প্রতিফলনও ছিল।

‘মাঝে মাঝে নিজেকে মেলে ধরতে হয়’ এই আকুতি ফুটে উঠেছে ‘কেবিন নাম্বার এগারো’তে। নিজেকে ভেন্টিলেট করার মধ্যে যে একটা থেরাপিউটিক ইফেক্ট আছে তা আমরা অনেক সময় বুঝতে পারি না। এই গল্পে তা আবার নতুন ভাবে প্রতিভাত হয়েছে।

‘নন্দিনী, নন্দিনী’ পাঠককে ক্যাম্পসের দুরন্ত দিনগুলোতে ফিরিয়ে নিয়ে যায়। এই নষ্টালজিয়া আর চটুল উপাখ্যানের মধ্যেই লুকানো আছে আমাদের জ্বালানো পোড়ানোর রাজনীতির প্রতি তীব্র কটাক্ষ। এই যে চটুল উপাখ্যানে কঠিন সমস্যাকে চিত্রায়িত করা আর সিরিয়াস কোনো বিষয়ের অবতারণায় চটুল রসের সূক্ষ্ম ব্যবহার – এই পারদর্শিতাগুলো রিশাদের গল্পগুলোতে উৎকর্ষতার মাত্রা দিয়েছে।

প্রতিটি গল্পেই রিশাদের বিভিন্ন ধরনের শক্তিমত্তার পরিচয় ফুটে উঠেছে।

বইটি পড়তে গিয়ে বারবার মনে হয়েছে আমরা একজন সদ্য পাস করা তরুণ চিকিৎসকের লেখা গল্প পড়ছি। মনে হয়েছে একই গল্পের পটভূমিগুলো হয়তো অন্যভাবেও সাজানো যেত। তাহলে হয়তো ক্যানভাসের পুনঃপৌনিকতা এড়ানো যেত।

কারুতিতাসের করা প্রচ্ছদটি আরো একটু চিত্তাকর্ষক হলে বইটির প্রতি সুবিচার করা হতো বলে ধারণা।

‘দিকশূন্যপুর’ প্রকাশ করে অনিন্দ্য প্রকাশ আমাদের নিঃসন্দেহে নিয়ে গেছে পাঠমুগ্ধপুরে। বইটি ব্যাপক পাঠকনন্দিত হবে বলে বিশ্বাস করি।

বাংলাদেশ সময়: ২০৩০ ঘণ্টা, আগস্ট ০৫, ২০১৬
এএ

 

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।