আলো তখনও ফোটেনি। অনেক দূরের আকাশে ভোরের আভাটুকু মাত্র দেখা যাচ্ছে।
আজকাল মনও খুব খারাপ হয়। অপারেশনের কথা শুনলে মন ভারী হয়ে আসে। আর থেকে থেকে সেই পদ্মার চরের মধ্যে ফিরে যেতে সাধ হয়। সহজ, সুন্দর মধুর জীবনযাত্রাকে আবার কাছে পেতে ইচ্ছে করে। সেই যখন বিশ্বভারতীর ভাবনা ছিলো না, ছোট-বড় নানা দাবি মেটাতে হতো না রোজ রোজ। নৌকার উপর দিন কাটছে। কাছারি থেকে নায়েব প্রয়োজনমতো দুধ-তরকারি পাঠিয়ে দিচ্ছেন। ভাবনা বলতে কিছুই তেমন নেই। শুধু মাঝে মধ্যে বলেন্দ্রনাথের গল্পের তাগাদা। লিখতে বসলে যা দেখছেন সে সবই গল্পে রূপ পাচ্ছে। ‘গল্পগুচ্ছ’-এর কতো গল্প যে এভাবেই লেখা। তখন খ্যাতি ছিলো না, সম্মান ছিলো না। নিতান্ত সহজ-সরল জীবন। আবার প্রশংসা যে পাননি তাও তো নয়। সে বড় মধুর সময়। তারপর বিশ্বভারতী এলো, নাম এলো, সম্মান এলো। আর ক্রমশ দূরে দূরে চলে গেলো সেই নির্মল নির্জন পদ্মাচরের দিন। কবির প্রায়শই সেইসব দিনের জন্য মনখারাপ হয়। দূর থেকে হাত বাড়িয়ে ছুঁতে চান, কিন্তু সে কী আর সম্ভব! ‘তোমার কীর্তির চেয়ে তুমি যে মহৎ/তাই তব জীবনের রথ/পশ্চাতে ফেলিয়া যায় কীর্তিরে তোমার। ’
কিন্তু এই যে রবীন্দ্রনাথ, এঁকেই বা অস্বীকার করেন কী করে! এতো খ্যাতিসম্মানের মোহ কাটানো কী সহজ! ‘...কেউ যদি এসে বলে- রবীন্দ্রনাথ, তোমার এই দণ্ডমুকুট খসিয়ে নিয়ে যদি তোমাকে সেই অখ্যাত দিনগুলি শুধু ফিরিয়ে দিয়ে যাই, রাজি আছ? তখন নিশ্চয়ই বলব ‘না’। কারণ এই খ্যাতি, এই সম্মান, এই দায়ভার, এসবের মধ্যে কোনও মোহ নেই একথা বললে মিথ্যা বলা হবে। তার মানে এটাও চাই ওটাও চাই। মানুষের মন কি মজার দেখো। তবু একথা খুবই সত্যি, যে এই সম্মান খ্যাতির মধ্যে দিয়ে মানুষের যে ভালোবাসাটা পেয়েছি, সেইটাই সবচেয়ে বেশী মনকে স্পর্শ করেছে। আমার জীবনে এটাই বিধাতার শ্রেষ্ঠ দান। ’
খুট করে একটা আওয়াজে চিন্তাসূত্র ছিঁড়ল। কে এলো? রানি, নির্মলকুমারী। যাওয়ার পরোয়ানা বুঝি এলো।
২.
শরীরটা তেমন সায় দিচ্ছে না তা প্রায় বছরখানেক হতে চলল। এতোদিন তিনি বেশ জোরের সঙ্গে বলতেন, আর সবার শরীর আর রবীন্দ্রনাথের শরীর এক নয়। কিন্তু আর যেনো কথাটা বলতে পারছেন না। ১৯৩৭-এ একবার বড়সড় সংকটে পড়েছিলেন। জ্ঞান হারিয়েছিলেন। কিন্তু সামলে নিয়েছিলেন। এরপর ১৯৪০ সালের ০৭ আগস্ট। শান্তিনিকেতনে সেদিন সাজ সাজ রব। মস্ত উৎসবের আয়োজন। আর হবে নাইবা কেন! কবিকে সেদিন অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ডক্টর উপাধি দেওয়ার জন্যই জমকালো অনুষ্ঠান। ১৯১২ সালে গীতাঞ্জলী প্রকাশ হওয়ার পরই এ সম্মান দেওয়ার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু লর্ড কার্জন তখন সে বিশ্ববিদ্যালয়ের চ্যান্সেলর। শোনা যায়, কবিকে উপাধি দেওয়ার প্রস্তাবে বাধা দিয়েছিলেন তিনি নিজে। যাই হোক সে সম্মান কবির কাছে এলোই। ঠিক হয়ে আছে সেদিন উৎসবে আচার্যের কাজ করবেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ।
কিন্তু কবির ক’দিন ধরেই অল্প অল্প জ্বর হচ্ছে। একদিন আগে থেকেই অনেকে বলছেন এতো পরিশ্রমের ধকল কবি এবার আর নাই বা নিলেন। যেই সে কথা কেউ বলতে বলতে যায়, কবি তাকে বলছেন, ‘মিথ্যে ভয় পাচ্ছেন, আমার কিছু হবে না। ’ কিন্তু সকালে আচার-অনুষ্ঠান করে বিকেলে ডিগ্রি নিতে সিংহ-সদন পর্যন্ত যেতে পারবেন তো! কপালে ভাঁজ পড়ল রথী ঠাকুরের। অপ্রিয় হলেও কথাটা তাকে বলতেই হবে। বললেনও। কবির তাকে বুঝিয়ে বললেন, ‘দ্যাখ, তোরা এ জিনিসটাকে কী মনে করিস জানিনে। মন্দিরের কাজটা আমার সমস্ত আশ্রমের অন্তরের জিনিস। এখানকার বিদ্যালয়ের প্রতিদিনকার জীবনযাত্রার সঙ্গে জড়িত। বিদেশি অতিথি যারা এসেছেন, তারা এ জিনিসটা দেখে না গেলে এখানকার সত্যরূপটিই দেখতে পাবেন না। আমাকে তোরা সবসময় কষ্ট হবে, ক্লান্তি হবে বলে ছোটো করে দেখিসনে। কাল আমি আর সব কাজই করতে পারব, শুধু মন্দিরের কাজটা করলেই আমার ক্লান্তি হবে?’ তিনি জানেন, এরপর আর কেউ কিচ্ছুটি বলবে না। সেদিন মন্দিরের সব কাজ নিজেই করলেন। কেমন হয়েছিল সেদিনের অনুষ্ঠান? রবীন্দ্রজীবনীকার জানাচ্ছেন, ‘ভারতের ফেডারেল কোর্টের প্রধান বিচারপতি স্যার মরিস গয়ার উক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে মানপত্র পড়লেন। অক্সফোর্ডের দেশী ও বিদেশী বহু প্রাক্তন ছাত্র সেদিন শান্তিনিকেতনে এসেছিলেন। ’
মনের জোরে অনেক কিছু করলেন বটে কিন্তু কবির শরীর ক্রমশ খারাপ হচ্ছে। দিনগুলি আর যেনো কাটতেই চায় না। চোখের দৃষ্টি ক্ষীণ হয়ে আসছে। হাঁটতে কষ্ট হয়। কানেও ইদানিং কম শুনছেন। শান্তিনিকেতনে থাকতে আর তেমন মন লাগে না। কলকাতাতে এলেও ডাক্তারদের বিধিনিষেধ। কবি যেনো হাঁপিয়ে উঠছিলেন। প্রতিমাদেবী সেইসময় ছিলেন কালিম্পংয়ে। কবিও চললেন সেখানে। যাবার আগে অমিয় চক্রবর্তীকে লিখে গেলেন, ‘কিছুদিন থেকে আমার শরীর ক্রমশই ভেঙে পড়ছে, দিনগুলো বহন করা যেন অসাধ্য বোধ হয়। তবু কাজ তো করতে হয়- তাতে এত অরুচিবোধ সে আর বলতে পারিনে। ভারতবর্ষে এমন জায়গা নেই যে পালিয়ে থাকা যায়। ভিতরের যন্ত্রগুলো কোথাও কোথাও বিকল হয়ে গেছে। বিধান রায় কালিম্পং-এ যেতে নিষেধ করেছিলেন। কিন্তু মন বিশ্রামের জন্য এত ব্যাকুল হয়েছে যে তাঁর নিষেধ মানা সম্ভব হল না। চল্লুম আজ কালিম্পং। ’ নির্মলকুমারী মহলানবিশকে অবশ্য বলেছিলেন, কালিম্পং যাওয়া তার উচিত হবে না। বরং গিরিডি যাওয়ার দিকেই মন ছিলো। কিন্তু শেষমেশ গেলেন সেই কালিম্পংয়েই।
কালিম্পং যাত্রাই যেনো কবির জন্য কাল হলো। ২৭ সেপ্টেম্বর কবি হঠাৎ অজ্ঞান হয়ে পড়লেন। প্রতিমাদেবী তড়িঘড়ি কলকাতায় প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশকে খবর পাঠালেন। সেদিন আবার মৈত্রেয়ী দেবী কবির সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলেন। কালিম্পংয়ে সাহেব ডাক্তার খুব করে ধরেছিলেন অপারেশনের জন্য। কিন্তু কবির অপারেশনের আপত্তির কথা ভেবেই, প্রতিমাদেবী রাজি হলেন না। কবিকে ফিরিয়ে আনা হলো জোড়াসাঁকোর বাড়িতে।
দোতালার পাথরের ঘরটায় রাখা হয়েছে তাকে। গায়ে জ্বর। কীরকম একটা ঘুম ঘুম আচ্ছন্ন অবস্থা। ভালো করে কথা বলতে পারছেন না, কিন্তু মন সজাগ। ওই অবস্থাতেই একদিন দুপুরে রানী মহলানবিশকে ডেকে বললেন, ‘সামনের ওই আলমারিটা খোলো তো। ওই kali salf এর শিশিটা নিয়ে এসো। ’ বায়োকেমিকে কবির খুব বিশ্বাস ছিলো। একবার এক বিদেশি শান্তিনিকেতনে এসেছিলেন, কবির দেখাশোনা করতে। উলটে নিজেই জ্বরে পড়ে গেলেন। আর কবির সে কি উদ্বেগ। এই একে খোঁজ নিতে পাঠাচ্ছেন, তো ওই ওর হাত দিয়ে বায়োকেমিক ওষুধ পাঠাচ্ছেন। সেসময় নির্মলকুমারী শান্তিনিকেতনেই ছিলেন। কবির উদ্বেগ দেখে তিনি হেসে ফেললেন। কবি বলেছিলেন, গরম দেশে থাকতে এমনিই কষ্ট, তার উপর তো উনি বিদেশি। কবির এই বায়োকেমিক প্রীতির কথা নির্মলকুমারী ভালোই জানেন। ওষুধের বাক্সটা আনতে আনতে তিনি ভাবলেন, এবার নিশ্চয়ই নিজেই নিজের চিকিৎসা করবেন। ওষুধ এনে গোটা ছয় বড়ি কবির মুখে দিতে যাবেন, অমনি কবি মৃদু স্বরে বললেন, ‘আমি না নিজে খাও। হাত যে একেবারে পুড়ে যাচ্ছে। আমার গায়ে হাত বুলোচ্ছ তাই টের পাচ্ছি যে, তোমারও আমারই অবস্থা, তুমি আবার আমার সেবা করছো। ’
ডাক্তারদের মধ্যেও কবির চিকিৎসা নিয়ে নানা আলোচনা। কেউ ওষুধ দিয়ে চিকিৎসার পক্ষে, কেউবা অপারেশনের। স্যার নীলরতন সরকারের আপত্তিতে, সে যাত্রা অপারেশনের বদলে ওষুধ দিয়েই চিকিৎসা চলতে লাগল। শুয়ে শুয়ে কবি বলতে থাকেন রোগশয্যার কবিতা। পাশে যে থাকে সে-ই লিখে নেয়।
৩.
১৮ নভেম্বর কবি ফিরলেন শান্তিনিকেতনে। কখনই কারও সেবা নিতে চাইতেন না। কিন্তু এবারে তিনি যেনো অসহায়। বাধ্য হয়েই নিজেকে ছেড়ে দিয়েছেন সেবক-সেবিকাদের হাতে। এমনকি ডিকটেশন দিয়ে লেখানোর কাজও তিনি কখনও করেননি। এবার তাই করতে হচ্ছে। কখনওবা কেদারায় উঠে একটু বসেন। কখনও বিছানায় শুয়ে পড়েন। সময় কী তবে ফুরিয়ে আসছে? জানলার ধারে আরামকেদারায় বসে প্রতিমাদেবীর বাগানের দিকে তাকিয়ে থাকেন। দেখেন সৃষ্টির বিচিত্র এই লীলা। জীবন যেমন আছে, তেমনই মৃত্যুও আছে। তা তিনি সহজভাবে স্বীকারও করে নিয়েছেন। জীবনে ‘হাঁ’-এর দিক যদি বেঁচে থাকার আনন্দ হয়, তবে ‘না’-এর দিক মৃত্যু। তাই জীবনের দাবি নিশ্চয়ই বেশি। তবু ‘জীবন যেমন সত্য, মৃত্যুও ততোটাই সত্য। খুব কষ্ট হয় তা জানি, তবু এ কথা অস্বীকার করলে চলবে না যে মৃত্যু না থাকলে জীবনের কোনো মূল্যই থাকে না, যেমন বিরহ না থাকলে মিলনের কোনো মানে নেই। ’ এ সব তো তিনি সেই কতোদিন আগেই জানিয়েছেন। আজ বেলাশেষের ক্ষণে আবার নিজেকেই তা শোনাচ্ছেন। যতোই অস্তরাগের ছটা দেখছেন, জীবনের প্রতি বিস্ময় যেনো তার ততোই গাঢ় হচ্ছে- ‘বিপুলা এ পৃথিবীর কতটুকু জানি। ’ তবু তরী যে কেন এমন হঠাৎ ডুবে যেতে চায়!
কিন্তু কবির শরীর যেনো নিজের মনের সজীবতার সঙ্গে তাল রাখতে পারে না। ১৯৪১ এর ১১ মাঘ উপাসনায় শান্তিনিকেতনের মন্দিরে তার আসন শূন্য থাকল। আশ্রমে থেকেও অসুস্থতার জন্য আসতে পারলেন না কবি। শরীরের কাছে তার সেই প্রথম হার মানা। নির্মলকুমারী মহলানবিশকে ডেকে বললেন, ‘মন্দির থেকে এলে? আমি তো আর যেতে পারলাম না, তাই এখানে বসেই আজকের কাজ আমি করলাম। ’- বলে খাতা থেকে পড়ে শোনালেন সদ্য লেখা একটি কবিতা- ‘সৃষ্টিলীলাপ্রাঙ্গনের প্রান্তে দাঁড়াইয়া/ দেখি ক্ষণে ক্ষণে/ তমসের পরপার/ যেথা মহা অব্যক্তের অসীম চৈতন্যে ছিনু লীন। ... এ মর্ত্যের লীলাক্ষেত্রে সুখে দুঃখে অমৃতের স্বাদ/ পেয়েছি তো ক্ষণে ক্ষণে,/ বারে বারে অসীমেরে দেখেছি সীমার অন্তরালে। / বুঝিয়াছি, এ জন্মের শেষ অর্থ ছিল সেখানেই,/ সেই সুন্দরের রূপে,/ সে সঙ্গীতে অনির্বচনীয়। / খেলাঘরে আজ যবে খুলে যাবে দ্বার/ ধরণীর দেবালয়ে রেখে যাবো আমার প্রণাম/ দিয়ে যাবো জীবনের সে নৈবেদ্যগুলি,/ মূল্য যার মৃত্যুর অতীত। ’
দেখতে দেখতে নববর্ষ এসে গেলো। সেদিন পাঠ করা হলো কবির রচিত ‘সভ্যতার সংকট’, গাওয়া হলো- ওই মহামানব আসে। কবি অবশ্য নিজে পড়লেন না, পড়লেন আশ্রমের ‘ঠাকুরদা’ ক্ষিতিবাবু। কিন্তু মুখে মুখেই অনেক কথা বললেন কবি। তারপর মজা করে বললেন, আমাকে তো পড়তে দিলে না। পড়লে কি ক্ষিতিবাবুর থেকে খারাপ পড়তুম? পড়তে দিলে না, তাই মুখে মুখেই এত কথা বলে দিলাম।
কবির জীবনের শেষ ২৫ বৈশাখ পালন করা হলো অনাড়ম্বরেই। কবি তখন থাকতেন উদয়নের একতলায় দক্ষিণ দিককার বড় ঘরটায়। সন্ধ্যেবেলায় উদয়নের পুবদিকে সামিয়ানা টাঙিয়ে ‘বশীকরণ’ নাটকের অভিনয় হলো। তাতে পার্ট করলেন কবির পুরাতন ভৃত্য বনমালি। অভিনয়ের পর বনমালি হেসে বললে, ‘বাবা, আমি কক্ষণো কিছু করি নাই, তার ওপর সামনে বাবামশায় চৌকিতে বসা। আমার তো কথা বলবার সময় গলা বুজে যাবার মতো হচ্ছিল। ’ কবি বললেন, ‘কেন, তোর তো বেশ ভালোই হয়েছিল। ’ তারপর অন্যদের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘আমার লীলমণির কত গুণ তাই দেখো। বাঁদরটা আমার কাছে থেকে নাটক করতেও শিখে গেল। ’
সে সময়ই ঘটল আর এক ঘটনা। বিলাতের পার্লামেন্ট সদস্যা মিস এলিনর র্যা থবোন দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে ভারতীয়দের বৃটেনের পক্ষে যোগদানের আহ্বান জানিয়ে একটা অপমানজনক খোলা চিঠি লেখেন। অশক্ত শরীরেও প্রতিবাদে মুখর হয়ে ওঠেন কবি। ‘এঁরা সভ্য জাত। আজ ২০০ বছরের civilized রাজ্যশাসনের ফলে দেশে না আছে অন্ন, না আছে বস্ত্র, না আছে স্বাস্থ্য, না আছে শিক্ষা, এমনকি একটুখানি তৃষ্ণার জল তাও আমরা পাইনি, কি পেয়েছি শুধু law and order এবং তার সঙ্গে এই র্যা থবোনের মতো ইংরেজের দাম্ভিক মন্তব্য। এ যে কাটা ঘায়ে নুনের ছিটে- এ সহ্য করবো কী করে? ... এদের লজ্জা করে না নিজেদের সিভিলাইজড গভর্নমেন্ট বলতে? আমার তো এই জলকষ্টের কথা মনে করলে সমস্ত শরীরের রক্তগরম হয়ে ওঠে, মনে হয় হাতে যদি বন্দুক থাকে দিই একেবারে গুড়ুম ...’- উত্তেজনায় আর কথা বলতে পারলেন না কবি। চোখ দিয়ে ঝরঝর করে গরিয়ে পড়ল জল। প্রতিবাদী চিঠির খসড়া লিখতে বললেন কৃষ্ণ কৃপালনিকে। সেটা ০৫, জুন ১৯৪১।
কিন্তু কবির শরীর যেনো আর চলে না। ০১ জুলাই প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশ, রথী ঠাকুরের থেকে একটা চিঠি পেলেন। তিনি লিখেছেন, ‘ইন্দুবাবুরা বুধবার এসেছিলেন। ওঁদের তিনজনেরই অর্থ্যাৎ রামবাবু, জ্যোতিবাবু ও ইন্দুবাবুর মতো যে, অপারেশন করা উচিত। ইন্দুবাবু ভার নিয়েছেন যে ললিতবাবু শিলং থেকে ফিরলেই তাঁকে এখানে নিয়ে আসবেন-পরীক্ষা করবার জন্য। তারপর অপারেশনের দিন স্থির হবে। ইতিমধ্যে জ্বরটা কমবার জন্য অটোভ্যাকসিন দেওয়া হবে। ইউরিন এ গতবার কলি পাওয়া গেছে। রামবাবু আবার কাল আসছেন সম্ভবত ভ্যাকসিন নিয়ে আসবেন। বাবার শরীর খুবই খারাপ হয়ে গেছে। জ্বর রোজই ১০০.৪ ডিগ্রি উঠছে। এখন সবসময় শুয়ে থাকতে হয় এত দুর্বল হয়ে পড়েছেন। তাই বিশেষ রকম চিন্তিত হয়ে আছি। ’
কবির অপারেশনে একদমই ইচ্ছে নেই। কেবল বলেন, ‘আর কদিনই বা বাকি আছে? এই কটা দিন দিক না আমাকে যেমন আছি তেমন করে থাকতে। কোনোদিন তো আমাকে যেতেই হবে। কিন্তু আমি কবি। আমার ইচ্ছে কবির মতনই যেতে- সহজে এই পৃথিবী থেকে ঝরে পড়তে চাই, শুকনো পাতার মতো। যাবার আগে আমাকে নিয়ে এই টানাছেঁড়া কেন?’ তাই কবির ইচ্ছেতেই এলেন কবিরাজ বিমলানন্দ তর্কতীর্থ মশাই। তাকে কবি বললেন, ‘দেখো হে তোমরা আমার কিছু করতে পার কিনা। ছেলেবেলা থেকে আমার শরীরে কোন অস্ত্রাঘাত হয়নি। শেষকালে কি যাবার সময় আমাকে ছেঁড়াখোঁড়া করে দেবে?’ কবিরাজ আশ্বাস দিয়ে বললেন, কবির নাড়ির গতি খুবই ভালো। যদিও এ রোগ পুরোপুরি সারে না, তবু শরীরের গ্লানি অনেকখানি কমে আসে। কবি বললেন, ‘তাহলেই হল। এই বয়সে তো আর আমি লাফালাফি করতে চাচ্ছি না। ... হাতের আঙুল টাঙুলগুলো আড়ষ্ট হয়ে গেছে, লিখতে পারি না আজকাল। এটুকু পেলেও তো অনেকখানি। ’
সেইমতো শুরু হলো চিকিৎসা। কবির মনে ভিড় করে আসে নানা স্মৃতির কোলাজ। ফিরে ফিরে আসে সেই ইউরোপে যাওয়ার দিনগুলি, শিলাইদহের গল্প, আরও কতো কী। একেকদিন সেসব বলে চলেন ক্লান্তিহীনভাবে। ০৪ জুলাই প্রায় ঘণ্টা দু’য়েক চলল সেই কথা দিয়ে ছবি আঁকা। পিছনে বসে রাণি চন্দ কলমে ধরে রাখলেন সেই ছবি।
শরীরের এই হালেও রীতিমতো চালিয়ে যাচ্ছেন রসিকতা। একদিন ইন্দিরা দেবীকে সামনে পেয়ে নালিশ জানিয়ে বললেন, ‘তুই দেখ আমাকে এরা আজকাল কি খেতে দিচ্ছে। এ কি কখনো খাওয়া যায়? না কেউ কাউকে খেতে দেয়? ... কবিরাজমশাই বলেছেন এসব খেলেই নাকি আমি আর ক’দিন পরে লাফালাফি করে বেড়াতে পারবো। কিন্তু তুই সত্যি করে বল এসব কি মানুষে খেতে পারে? কেবলই চালকুমড়ো খাবো, কেবলই চালকুমড়ো খাবো? আর কি ভালো জিনিস কিচ্ছু নেই? তুই তো দেখছিস, এঁরা আমাকে কী খেতে দেন। তারপর আবার বলেন আহা আর একটু খান, আপনি কিছু খাচ্ছেন না ইত্যাদি ইত্যাদি। আরে, ভালো জিনিস একটু কিছু দাও, তারপরে দেখো খাই কিনা। ’ কবির নালিশ করার ধরন দেখে সবাই হেসে উঠলেন। তাকে ঘিরে আনন্দের হাট যেমনি ছিলো তেমনই আছে। জীবনের এই চক্রটিকে বেশ ভালভাবে অনুধাবন করতে পারছিলেন। সেই পদ্মাচরের দিন আজ আর নেই। আজ আশেপাশে ঘোরাঘুরি অনেক নতুন মানুষের। এরকমটাই তো হওয়ার কথা-
বহুলোক এসেছিল জীবনের প্রথম প্রভাতে
কেহ বা খেলার সাথী, কেহ কৌতুহলী,
কেহ কাজে সং দিতে, কেহ দিতে বাধা।
আজ যারা কাছে আছে এ নিঃস্ব প্রহরে,
পরিশ্রান্ত প্রদোষের অবসন্ন নিস্তেজ আলোয়
তোমার আপন দীপ আনিয়াছে হাতে,
খেয়া ছাড়িবার আগে তীরের বিদায়-স্পর্শ দিতে।
তোমরা পথিক বন্ধু,
যেমন রাত্রির তারা
অন্ধকারে লুপ্তপথ যাত্রীর শেষের ক্লিষ্ট ক্ষণে।
কবিরাজিতেও কাজ হচ্ছে না। ধীরে ধীরে সবাই অপারেশনের দিকেই ঝুঁকলেন। প্রবল অনিচ্ছা সত্ত্বেও রাজি হলেন কবি নিজে।
অবশেষে এই ২৫ জুলাই, শান্তিনিকেতন থেকে কবিকে কলকাতায় ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার দিন ধার্য হয়েছে। এতোক্ষণে ভোরও হয়েছে। আশ্রমের ছেলেরা এসে জড়ো হয়েছে কবির জানলার কাছে।
একটু পরে স্ট্রেচারের হাতলের ওপর ভর দিয়ে আধশোয়া হয়ে শান্তিনিকেতন দেখতে দেখতে কবি চলেছেন। আশ্রমের সবাইও বুঝেছে কবিকে আর হয়তো কাছে পাওয়া যাবে না। ছেলেমেয়েরা সবাই গাইছে- আমাদের শান্তিনিকেতন, আমাদের সব হতে আপন। যখন গাড়িতে উঠলেন, চালক ইচ্ছে করেই শান্তিনিকেতনের চারিদিক ঘোরাতে ঘোরাতে কবিকে নিয়ে চললেন। কবি শেষবারের মতো দেখে নিচ্ছেন তার শান্তিনিকেতনকে। গ্রামের লোকেরা হাতজোড় করে দাঁড়িয়ে আছে। কোনো চিৎকার নয়, জয়ধ্বনি নয়, নীরবে তারা কবিকে বিদায় অভিনন্দন জানালো। দেখতে দেখতে শান্তিনিকেতনের সীমা শেষ হয়ে এলো, গাড়ি চলল স্টেশনের দিকে। চোখের ওপর রুমাল চাপা দিলেন কবি।
৪.
কাটাছেঁড়া কোনোভাবেই আটকানো গেলো না। ঠিক হয়েছে ৩০ জুলাই কবির অস্ত্রোপচার হবে। কবিকে সে কথা জানানো হলো না। তিনি শুধু শুনেছেন অপারেশন হবে, অজ্ঞান করা হবে না, লোকাল অ্যানাস্থেসিয়া করা হবে। বারবার জানতে চাইছেন, ‘আচ্ছা জ্যোতি, আমাকে বুঝিয়ে বলতো ব্যাপারটা কিরকম, আমার কতদূর লাগবে। আগে থেকেই আমি সব বুঝে রাখতে চাই। ’ জ্যোতি অর্থাৎ ডা. নীলরতন সরকারের ভাইপো জ্যোতিপ্রকাশ রায় বললেন, তেমন লাগবে না। ওই ইঞ্জেকশন দেওয়ার মতো। চাইলে কবি অপারেশনের সময় মুখে মুখে কবিতাও তৈরি করে ফেলতে পারেন। কবি আশ্বস্ত হয়ে বললেন, ‘তাহলে তুমি বলতে চাইছ যে আমার কিছুই লাগবে না? তাহলে তো আজ তোমাকে এখানে খাইয়ে দিতে হয় ভালো করে। ’
অপারেশনের দিন সকাল থেকে কবি ছিলেন খোশমেজাজে। প্রশান্তচন্দ্রের সঙ্গে যুদ্ধ নিয়ে কথাবার্তাও বলেছেন। সকালে একটা কবিতা লেখাও হয়েছে। কলকাতায় আসার পর থেকে ইতিমধ্যেই দু’টো কবিতা তৈরি হয়ে গেছে। আর আজ একটা। ‘তোমার সৃষ্টির পথ রেখেছো আকীর্ণ করি/ বিচিত্র ছলনাজালে/হে ছলনাময়ী! মিথ্যা বিশ্বাসের ফাঁদ পেতেছ নিপুন হাতে/সরল জীবনে!/এই প্রবঞ্চনা দিয়ে মহত্বেরে করেছ চিহ্নিত/ তার তরে রাখোনি গোপন রাত্রি/ তোমার জ্যোতিষ্ক তারে যে পথ দেখায়, সে যে অন্তরের পথ, সে যে চিরস্বচ্ছ/ সহজ বিশ্বাসে সে যে করে তারে চির সমুজ্জ্বল। / বাহিরে কুতিল হোক অন্তরে সে ঋজু/ এই নিয়ে তাহার গৌরব। / লোকে তারে বলে বিড়ম্বিত। / সত্যেরে সে পায়/আপন আলকে ধৌত অন্তরে অন্তরে/ কিছুতে পারে না তারে প্রবঞ্চিতে,/শেষ পুরস্কার নিয়ে যায় সে যে আপন ভান্ডারে। ’ সাড়ে ন’টার সময় রানি চন্দকে আরও তিনটে লাইন বললেন, ‘অনায়াসে যে পেরেছে ছলনা সহিতে/সে পায় তোমার হাতে/শান্তির অক্ষয় অধিকার। ’ বললেন, ‘সকালবেলার কবিতাটার সঙ্গে জুড়ে দিস। ’
তখন কে জানত,এটাই হবে কবির শেষ রচনা!
সাড়ে দশটার সময় ললিতবাবু এসে জানালেন, আজ দিনটা ভালো মনে হচ্ছে, আজই তাহলে সেরে ফেলি? এই প্রথম গম্ভীর হলেন কবি। বললেন, ‘আজই?’। আয়োজন সব করাই ছিলো। স্ট্রেচারে করে কবিকে অপারেশনের জন্য নিয়ে যাওয়া হলো। সবাই উৎকণ্ঠিত। অবশেষে খবর এলো, অপারেশন ভালোয় ভালোয় হয়ে গেছে। বারোটার সময় রুগীকে তার বিছানায় শুইয়ে দেওয়া হলো। কবির খাটের পাশে এসে দাঁড়ালেন, প্রশান্তচন্দ্র ও নির্মলকুমারী। কবি বিরক্ত হয়ে বললেন, ‘জ্যোতি মিথ্যে কথা বলেছে। কেন বলেছিল যে, কিছু লাগবে না। আমার খুব লেগেছে। এতো কষ্ট হচ্ছিল যে, আমি জোর করে ঠোঁট চিপে চোখ বুজে পড়ে রইলুম-পাছে আমার মুখ দিয়ে কোনরকমে আর্তনাদ বেরিয়ে যায়’।
৫.
অপারেশন হলো বটে। তবে কবির শারীরিক অবস্থার আশানুরূপ উন্নতি হলো না। তবে কী স্যার নীলকান্ত সরকারের ভাবনাই ঠিক ছিলো? সবার শরীর আর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শরীর এক নয়। সে দেহ যেনো ভালো করে সুরে বাঁধা বাদ্যযন্ত্রের মতো। বাইরে থেকে আঘাত করতে গেলে সমস্ত দেহযন্ত্রটাই বিকল হয়ে যাবার আশংকা। সবাই চিন্তিত।
৩১ জুলাই আবার কবির জ্বর বাড়ল। কষ্টে বলে উঠলেন, ‘জ্বালা করছে, ব্যথা করছে’।
০১ আগস্ট কবির হিক্কা শুরু হলো। কাতর হয়ে নির্মলকুমারীকে বললেন, ‘কিচ্ছু কমবে না। ওরা কিচ্ছু বুঝতে পারছে না আমি তা টের পেয়েছি, কেবল আন্দাজে অন্ধকারে ঢিল ছুঁড়েছে। তুমি আমার কীরকম হেডনার্স? কমাও আমার কষ্ট। ’ এলাচ–মিছরি দিতে সেদিন হিক্কা একটু কমলো। কিন্তু পরদিন ভোর থেকে আবার শুরু হলো হিক্কা।
০৩ আগস্ট অবস্থা আরও সংকটজনক। অসাড় হয়ে আছেন কবি। মাঝে মাঝে পথ্য বা জল খাওয়াতে গেলে বলছেন, ‘আর জ্বালিও না তোমরা। ... যিনিই বলুন না কেন আমি কারও কথাই আর শুনছি নে। তোরা আর জ্বালাস নে আমাকে। ’ মুষড়ে পড়লেন সবাই।
০৪ আগস্ট শান্তিনিকেতন থেকে ফিরে এলেন প্রতিমাদেবী। তাকে চিনতে পারলেন। কিন্তু অবস্থার কোনো উন্নতি নেই। বরং সবার আশংকাকে সত্যি করে খবর এলো- কিডনি ফেল করেছে।
০৫ আগস্ট কবির বন্ধু, ডা. নীলরতন সরকার এলেন কবিকে দেখতে। অভ্যাসবশে নাড়ি দেখলেন। তারপর কবির হাতে ধীরে ধীরে হাত বোলাতে লাগলেন। চোখে মুখে ফুটে উঠছে অসহায়তা। ধ্বন্বন্তরি ডাক্তার তিনি। কিন্তু এ যেনো অর্জুনের হাত থেকে গাণ্ডিব খসে গেছে। কিছুই আর করার নেই। উঠে চলে যাবার সময় দরজার কাছ থেকে বারবার ফিরে চাইলেন। তিনি জানেন, এই তার শেষ দেখা। কবিও জানতেন। তার চোখে গড়িয়ে পড়ল জল। নীরবে বললেন কি, হে বন্ধু, বিদায়!
০৫ আগস্ট রাত্রি থেকেই স্যালাইন দেওয়া হলো। একবার কি কবিরাজকে ডাকা হবে? বিধানবাবু কিছুতেই রাজি হলেন না। সুতরাং কিছুই আর করার নেই। শুধুই অপেক্ষা।
০৭ আগস্ট, ১৯৪১। ১৩৪৮ সালের ২২ শে শ্রাবণ। কবি পুবদিকে মাথা করে শুয়ে আছেন। অচৈতন্য। নিঃশ্বাসের সঙ্গে ঘড়ঘড় আওয়াজ হচ্ছে। বেলা যতো বাড়ছে, জোড়াসাঁকোর বাড়িতে লোকের ঢল নামছে। তাদের মধ্যে কে বা কারা যেনো ব্রাহ্মসঙ্গীত গাইছেন। বিধুশেখর শাস্ত্রী মশাই পায়ের কাছে দাঁড়িয়ে ‘পিতা নোহসি’ মন্ত্রপাঠ করছেন। রামানন্দ বাবু খাটের পাশে দাঁড়িয়ে প্রার্থনা করলেন।
বেলা ১২ টা বেজে ১৩ মিনিট। কবির ডান হাতখানা কাঁপতে কাঁপতে কপালের কাছে গিয়েই পড়ে গেলো। অন্যভুবনে পাড়ি জমালেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
‘প্রথম দিনের সূর্য/ প্রশ্ন করেছিল/ সত্তার নতুন আবির্ভাবে-/ কে তুমি?/ মেলেনি উত্তর!/ বৎসর বৎসর চলে গেল, দিবসের শেষ সূর্জ/ শেষ প্রশ্ন উচ্চারিল/পশ্চিমসাগরতীরে/ নিস্তব্ধ সন্ধ্যায়-/ কে তুমি?/ পেল না উত্তর। ’
৬.
কবিকে স্নান করিয়ে সাজিয়ে দেওয়া হলো। সাদা বেনারসীর জোড়। কপালে চন্দন। চাদরখানা পাট করে গলায় ঝুলিয়ে দেওয়া হয়েছে। শুভ্র কেশ। শুভ্র বেশ। কবি যেনো পরম নিশ্চিন্তে ঘুমোচ্ছেন। আর সারা দেশ উত্তাল হয়ে উঠছে। সবাই একবার শেষ দেখা দেখতে চায় কবিকে। খবর গিয়ে পৌঁছালো রেডিওতে। সেখানে তখন উপস্থিত ছিলেন কাজী নজরুল ইসলাম। রবিহারার শোক তিনি তক্ষুণি জানালেন তার কবিতায়।
কবি শেষ ইচ্ছা ছিলো, যেনো তার নামে জয়ধ্বনি না ওঠে। বিশ্বকবির জয় বন্দেমাতরমের মধ্যে দিয়ে যেনো তার শেষযাত্রা অনুষ্ঠিত না হয়। তিনি ফিরে যেতে চান সেই শান্তিনিকেতন। যেখানে কোলাহল নেই। প্রকৃতির কোলে থেকে যেতে চান। কিন্তু কে শোনে কার কথা। সেদিন এক যুবক থারমোডাইনামিক্সের ক্লাস করছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ে। হঠাৎ প্রিন্সিপাল এসে জানালেন, রবীন্দ্রনাথ নেই। যুবকটি বাইরে বেরিয়ে দেখলেন জনসমুদ্র জোড়াসাঁকোমুখী। তিনিও পৌঁছলেন। সবাই তখন বৃথা চেষ্টা করছে, কীভাবে দোতালার ঘরটায় পৌঁছানো যায়। যেখানে রাখা আছে কবির মরদেহ। অসম্ভব ভিড়, কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। ভিতরে ছবিটা কেমন ছিলো? কবিকে যখন স্নান করানো হচ্ছে একদল লোক তখন ছিটকিনি ঘরে ঢুকে পড়ল। ‘কী দারুণ অপমান কবির চৈতন্যহারা এই দেহটার!’ যে কবি নিজের ব্যক্তিগত প্রয়োজন কখনও কারও সামনে প্রকাশ করেননি, তার আত্মাহীন দেহটা ‘জনতার কৌতূহলী দৃষ্টির সামনে পড়ে রইল। ’ যুবকটি ছাদে দাঁড়িয়ে এসব টের পাননি। একটু পরে বাইরে বের করে আনা হলো কবির মরদেহ। ‘কবি যেন ভেসে ভেসে চললেন অগণিত মানুষের মাথার উপর দিয়ে। মৃতদেহ ফুলে ফুলে ঢাকা। ’ কবিকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে নিমতলা শ্মশানে। ‘পুরো কলকাতা শহরটা যেন কাঁদছে। শূন্যতা। আবার পূর্ণতা। ’ সেদিন কবির শেষযাত্রায় আরও এক ট্র্যাজেডির সাক্ষী হয়েছিলেন যুবকটি। এক যুবক পিতা তার মৃত শিশুসন্তানকে এনেছিলেন দাহ করাতে। পারেননি। উন্মত্ত জনতার ভিড়ে হারিয়ে গিয়েছিল মৃত শিশুটি। হয়তো পদপিষ্ট হয়েছিল তার মৃতদেহ। যে যুবকের চোখের সামনে এই ঘটনা ঘটেছিল, তিনিই ভারতীয় চলচ্চিত্রে অদ্বিতীয় মৃণাল সেন হয়ে উঠবেন ভবিষ্যতে, আর ট্র্যাজেডির এই অনুভব থেকে কিছুতেই তার ছবির নাম বদলাতে রাজি হবে না।
২২ শ্রাবণ কবির বিদায় শুধু, নাকি সুন্দর, পরিমিতি, নান্দনিকতা বোধেরও অপমৃত্যু! কবির জন্য কি এই সম্মান তোলাই ছিলো! এমনকী এই উন্মত্ততার ট্র্যাডিশন আজও চালিয়ে নিয়ে যাওয়া কি সেই কবির প্রতিই অসম্মান নয়? এই ব্যথার ভিতর দাঁড়িয়ে প্রতি ২২ শ্রাবণ অতি সঙ্গোপনে একটা চিঠির ভাঁজ খোলে। কী যে ছিলো সেই চিঠিতে-ব্যথা, অভিমান নাকি নিছক রসিকতা! প্রতিবার এই চিঠির অক্ষরে অক্ষরে সে হাত বুলোয়, আর শ্রাবণের ধারার মতো প্রকৃতির বুকে মিশে যায় সেই কথাগুলো-
... যদি পারো তবে সেই কবিকে মনে কোরো যে একদিন গেয়েছিল ‘বসন্ত জাগ্রত দ্বারে’- আজ তার ভাঙা গলায় আওয়াজ বেরচ্ছে না।
ইতি
তোমাদের সস্তাদামের রবিঠাকুর
..........................................।
ঋণ:
১. রবীন্দ্রজীবনকথা, প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়
২. বাইশে শ্রাবণ, নির্মলকুমারী মহলানবিশ
৩. তৃতীয় ভুবন, মৃণাল সেন
বাংলাদেশ সময়: ০৯৪৭ ঘণ্টা, আগস্ট ০৬, ২০১৬
এসএনএস