ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ৬ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২১ নভেম্বর ২০২৪, ১৯ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

শিল্প-সাহিত্য

ইউরোপের প্রাচীনতম হ্রদে (পর্ব-২)

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৯৩৪ ঘণ্টা, অক্টোবর ৬, ২০১৬
ইউরোপের প্রাচীনতম হ্রদে (পর্ব-২)

সেইন্ট সোফিয়া পান্থশালার সদর দরজায় নেমে আসতেই পাশের এক রেস্তোরাঁ থেকে ভেসে আসা মুচমুচে মাছ ভাজার গন্ধ নাসারন্ধ্রে এসে ঢোকে। তবে তো এক অর্থে হলো ভালোই।

আর মেহনত করে খাবারের জায়গা খোঁজার ঝামেলা নেই। আমি সেই রেস্তোরাঁর সামনের দিকে পেতে রাখা একটি টেবিলে বসে কিছু অয়েস্টারের অর্ডার দিয়ে হাতঘড়ির দিকে একবার অলক্ষ্যে চেয়ে নেই।

আগেই জেনে গেছি এ দেশে খাবার অর্ডার দেওয়ার পর মোটামুটি অনন্তকাল অপেক্ষার প্রহর গুনতে হয়, তাই এক্ষেত্রে ঠিক কেমনতর অপেক্ষা আমার কপালে আছে কে জানে! আমার অনুমানটি সত্যি প্রমাণ করে এবং কোনোরূপ ব্যতিক্রম দৃষ্টান্ত না রেখে বেয়ারা প্রায় চল্লিশ মিনিট পর বেশ কঠিন মুখে টেবিলে খাবার রেখে ভেতরে ছুট লাগালো। আর আমি আবারও বুঝে গেলাম প্রবল খিদে নিয়ে এদেশে রেস্তোরাঁয় ঢুকে চটজলদি সেই খিদে মিটিয়ে ফেলবার বাসনা এক দুরাশামাত্র।

অয়েস্টারের প্লেটটি সাবাড় করবার পর দেখতে পাই সূর্যগ্রহণ যেভাবে ধীরে ধীরে ঢেকে দেয় সূর্যের এক পিঠ, ঠিক সেভাবেই ধীরে ধীরে ছায়াছন্ন হয়ে পড়ে খাবার টেবিলটির সাদা চাদরে ঢাকা পৃষ্ঠদেশ। বুঝে যাই এবার সূর্য দেবতার হেলে পড়বার সময় হলো বুঝি! সেই বেরসিক বেয়ারাকে দাম চুকিয়ে ভাবতে বসি পুরোপুরি আঁধার নামার আগেই কোথাও দু’দণ্ড বসে একটু রোদের তাপ শুষে নেওয়া যায় কি?

অখ্রিদ শহরে আসবার আগে জানতাম এ শহরের প্রান্ত ছুঁয়ে গেছে ইউরোপের প্রাচীনতম হ্রদ এই অখ্রিদ। হ্রদের নামেই শহরের নামকরণ। প্রায় পঞ্চাশ লাখ বছর আগে নানা ভূমিকম্প আর তাল-বেতালে উৎপন্ন এই হ্রদ বুকে টলটলে স্বচ্ছ নীল পানি ধারণ করে দু’পাশে আটকে রেখেছে আজকের দু’টি দেশ মেসিডোনিয়া আর আলবেনিয়াকে। অখ্রিদ শহরটি এই মেসিডোনিয়া অংশে।

তবে কাচের মতো ঝকমকে হ্রদের পানি ছাড়াও এ শহরকে অতন্দ্র প্রহরীর মতো যে ঘিরে রেখেছে কিছু শৈলশ্রেণী সে বিষয়ে কিন্তু আমার পূর্ব ধারণা ছিলো না। সেটি জেনেছিলাম বাসস্ট্যান্ডে পা দিয়ে ট্যাক্সি ড্রাইভারে সঙ্গে ভাড়া নিয়ে মুলোমুলির সময়ে। সেই বলেছিল, সাহেব, তোমাকে নিয়ে ঠিকানামতো পৌঁছুতে হলে আমাকে ডিঙাতে হবে আস্ত এক পাহাড়। তাতে পোড়াতে হবে বেশ কিছু পেট্রোল। এ ভাড়ার কমে গেলে বড্ড লোকসান হয়ে যাবে।

গাড়ির রেডিওতে বাজতে থাকা মেসিডোনিয়ার এক লোকগীতি শুনতে শুনতে আর রেয়ার ভিউ মিররে পেন্ডুলামের মতো দুলতে থাকা এক অর্থোডক্স ক্রসের দিকে তাকিয়ে কিছুটা যখন সম্মোহনের পর্যায়ে পৌঁছে গেছি, তখনই বুঝতে পারি খাঁড়া এক পাহাড় বেয়ে গিয়ারে বেশ চাপ দিয়ে কিছুটা কঁকিয়ে গাড়িটি উপরে উঠে চলেছে। আর আমি তখন ভাবতে বসেছি, আমার যেখানে যাওয়ার কথা সেতো শুনেছি হ্রদের খুব কাছেই এক পাড়াতে, তাহলে এই পাহাড় বাইছি কেন? নাকি এই পাকদণ্ডি বেয়ে বেহুদা পথ পাড়ি দিয়ে ড্রাইভার তার ন্যায্য ভাড়ার সার্থকতা জাহির করতে চাইছে?

আমার এই ভাবনা শেষ হওয়ার আগেই দেখলাম যেভাবে উঠেছিলাম সেভাবেই এবার নিচে নামছি, তবে এবার যেন সব চাপ সামলাচ্ছে গাড়িটির বহু পুরনো এক ব্রেক। বস্তুত মূল শহর থেকে এই হ্রদের ধারে আসতে গেলে বিশাল ওই পাহাড়গুলো ডিঙানো ছাড়া খুব একটা গত্যন্তর নেই।

ট্যাক্সিটি আমাকে নিয়ে থেমেছিল এ পাড়ার কালচে পাথর বেছানো পথের পুরোটা দখল করে। এ ছাড়া অবশ্য উপায়ও নেই, সে সড়কে দু’টি গাড়ি চলবার ব্যবস্থাই যে নেই! পেছনের ট্রাঙ্ক থেকে বোঁচকা নামাবার সময়েই দেখেছিলাম উল্টোদিকে এক টং ঘর মতো দোকানে এক উদাসী রূপবতী যুবতি তার তাম্রবর্ণের চুল হাওয়ায় উড়িয়ে হাতের নেল পলিসের রং খুব গভীরভাবে নিরীক্ষণ করে দেখছে।

চলবে...

**ইউরোপের প্রাচীনতম হ্রদে (পর্ব-১)

বাংলাদেশ সময়: ০৯৩০ ঘণ্টা, অক্টোবর ০৬, ২০১৬
এএ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।