ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ৬ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২১ নভেম্বর ২০২৪, ১৯ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

শিল্প-সাহিত্য

খায়রুল আনাম | মেহেরুন দাদী

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৪২২ ঘণ্টা, নভেম্বর ১, ২০১৬
খায়রুল আনাম | মেহেরুন দাদী

আমাদের কয়েকবাড়ি পরের বাড়িতে এক দাদী বেড়াতে আসতো। দাদী কথাটা বোধ হয় ঠিক না।

পাড়াতুতো দাদার উনি সৎ বোন। সৎ বোন কি করে হয়ে গেল সেও এক মজার কাহিনী। আমার দাদার চাচা আঁটকুড়ো ছিলেন। মানে নিঃসন্তান ছিলেন না, তাঁর সাত সাতটা মেয়ে, কোন পুত্র সন্তান ছিল না। প্রায় আশি বছর বয়সে কিছু ধান চাল বিক্রি করে হজে যাবার সব ব্যবস্থা করেন। যাবার আগে মিলাদ-টিলাদ দেওয়া, সবার কাছ থেকে মাফ চাওয়া, বিদায় নেওয়ার পালাও শেষ হয়েছে আগের রাত পর্যন্ত। সকালে উঠে নাস্তা খাওয়ার পর সবাই যাত্রাপথের বুচকি-বোচকা ও আনুষঙ্গিক জিনিসপত্র গুছিয়ে দেবার জন্য ব্যস্ত। ওনার কিন্তু সে সবে তেমন উৎসাহ বা তাড়া দেখা গেল না। একটু পরে সবাইকে ডেকে বললেন, ‘তোমরা শোন, ঐসব বাঁধাছাঁদা সব খুলে ফেল। হজে আর আমি যাচ্ছি না’। সবাই বলল, ‘সে কি!’ দাদা বললেন, ‘গত রাতে একটা স্বপ্ন দেখেছি, আমার যাওয়া হবে না’। সবাই অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো, ‘কী এমন স্বপ্ন দেখলেন যাতে আপনাকে হজে যেতে নিষেধ করছে?’ তিনি বললেন, ‘স্বপ্নে বলেছে, আমি উত্তর পাড়ার মর্জিনাকে বিয়ে করলে আমার একটা ছেলে হবে ও সে বড় হয়ে এই গাঁয়ের মোড়ল হবে। ’ শুনে তো সবার মাথায় হাত। লোকটা বলে কী? কোথায় নেতাজি আর কোথায় পেঁয়াজি। কোথায় হজ আর কোথায় বিয়ে? আর এই আশি বছর বয়সে? তাও ঐপাড়ার মর্জিনাকে, যে নিজে ও তার বিধবা মা মিলে ওনাদের বাড়ির ঢেঁকিতে ধান ভেনে পেট চালায়? অন্যান্যরা বলল, ‘নিশ্চয়ই শয়তান পেছনে লেগে আল্লাহর দ্বীনের কাজে বাধা দিচ্ছে’। সবাই দৌড়াদৌড়ি করে আশেপাশের গ্রাম থেকে তিনজন মাওলানা হুজুর খুঁজে আনলো। ওয়াজ নছিহত হলো। কেউ কেউ গুণীন নিয়ে এসে অনেক ঝাড়ফুঁক করালো। কিন্তু ভবি ভুলবার নয়। কিছুতেই কিছু হলো না।

এদিকে দুটো পক্ষ গেল ভীষণ চোটে। একদিকে ওনার সাত জামাই, যারা ও‍ৎ পেতে বসে ছিল, বুড়ো কবে অক্কা পাবে আর তারা ওনার বিশাল সম্পত্তিটা ভাগাভাগি করে নেবে। অন্যদিকে ওনার অন্যান্য আত্মীয়স্বজন ও পাড়া ভর্তি নিজ বংশের সব লোকজন। তাদের সোজা বক্তব্য, ওই রকম একটা খেটে খাওয়া, প্রায় ভিখিরীর মেয়েকে কিভাবে এই সম্ভ্রান্ত পরিবারে উঠতে দেওয়া যাবে? ঐ মেয়ে হবে এই বাড়ির বউ? নৈব নৈব চ, মরে গেলেও না। পরের অধ্যায় অবশ্য অনেকটা বাংলা সিরিয়ালের মতই। ইন শর্ট, সংকল্পে অনঢ় বুড়ো বিয়েটা করেই ছেড়েছিলেন এবং যথারীতি কিছু দিনের মধ্যে হজ ভারসাস বিয়ে নিয়ে বাহাস করতে ঈশ্বরের কাছে উপরতলায় চলে গিয়েছিলেন। কিন্তু বনিয়াদের বীজ বপন করতে একটুও ভুলে যাননি। সময় মতো ঘর আলো করে একটা ফুটফুটে ছেলেও হয়েছিল এবং ছেলেটা বড় হয়ে বেশ হ্যান্ডসাম ও অত্যন্ত বিচক্ষণ পুরুষ হয়েছিল। বাবার চেয়ে বয়সে অনেক ছোট হলেও আমার দাদার চাচাত ভাই হিসেবে সম্পর্কে তিনি বাবার চাচা হয়ে গিয়েছিলেন। এবং মোড়ল না হতে পারলেও গ্রাম্য সালিশিতে সবাই বিচক্ষণ মানুষ হিসেবে তার মন্তব্যই জানতে চাইতো ও তাঁর সিদ্ধান্তই শেষ কথা হতো। যাই হোক, সাইড ট্র্যাক হওয়া থেকে এখন দাদীর কথায় ফিরে আসি।

ঐ দাদার সাত সৎ বোনের ছ’জনই মারা গিয়েছিলেন। এই এক বোনই মাঝে মাঝে ভাইয়ের বাড়িতে বেড়াতে আসতেন। ইনিও বিধবা। আমরা এনাকে মেহেরুন দাদী বলতাম। এই দাদী একাধারে খুবই অস্থির প্রকৃতির ও সুচিবাইগ্রস্ত মহিলা ছিলেন। দিনের মধ্যে আশি বার বাড়ির সামনে দিয়ে যেতেন আসতেন। উদ্দেশ্য শুধুমাত্র শানের পুকুরে গিয়ে পা দুটো ধুয়ে আসা। পা’তে নাকি বার বার নোংরা জিনিস লেগে যেত। ফেরার পথে বার বার পিছন ফিরে দেখতেন আবার কাপড়ে কোথাও কোনো ধুলোটুলো লেগে গেল কি না। দেখতেন আর পরনের কাপড়ের নিচের দিকটা বার বার ঝাড়া দিতেন, যাতে ধুলোগুলো পড়ে যায়। কাউকে একটুও বিশ্বাস না করলেও আমার মাকে অনেকটা বিশ্বাস করতেন, তবে পুরোপুরি নয়। দিনে অন্তত চার বার এসে মাকে বলতেন, ‘ও হামিদা, বাক্সটা একবার খোলতো মা, হাতের বালা দুটো, সোনার মাদুলিটা আর টাকাপয়সাগুলো ঠিকমতো আছে কিনা দেখে যাই’। মা খুবই বিরক্ত হতো। কিন্তু ‘এমন ভালো মেয়ে আর হয় না’-র সমাজে প্রতিষ্ঠিত এই তকমা বা ইমেজটা নষ্ট হয়ে যাবে, সেই ভয়ে মা কখনো মুখ খুলতে পারতো না। কেবল খুব নিচু গলায় আমাদের কাছে এসে গজগজ করতো, ‘বিশ্বাস যদি না থাকে তো আমার কাছে রাখা কেন বাপু?’ যাই হোক মালপত্র দেখা শেষ হলে দাদী প্রতিবারই আমাকে বলতেন, ‘তা হ্যাঁ ভাই, ক’টা পাশ দিলি?’ বলতাম, ‘বুবু, আমি এখন ইঞ্জিনিয়ারিং-এ ভর্তি হয়ে এসেছি। আর কিছুদিন পর থেকে আমাদের ক্লাশ শুরু হবে’। উনি বললেন, ‘তোরা সব কলিকালের ছেলে, বড় পেঁচিয়ে কথা বলিস, সোজা কথা তোদের মুখে আসে না। বলি শেষ পর্যন্ত এনটেরেন্সটা কি পাশ দিতে পেরেছিলি?’

আসলে আগে ওটাকে এন্ট্র্যান্স পরীক্ষা বলা হতো। আমাদের বাপেরা এন্ট্র্যান্স পাশ করেছিলেন। পরে ওটার নাম হয়েছিল ম্যাট্রিক। আমাদের সময় বোধ হয় ওটার নাম হয়েছিল স্কুল ফাইনাল বা হায়ার সেকেন্ডারি স্কুল ফাইনাল। তবে ম্যাট্রিকও চলতো। অত কিছুর মধ্যে না গিয়ে সহজ করে আমি বলি, ‘বুবু ওসব অনেক আগে পাশ করে আমি এখন...’। আমাকে থামিয়ে দিয়ে উনি রেগে মেগে বেশ জোর গলায় বলে ওঠেন, ‘চুপ, অসভ্য ছেলে, মিথ্যেবাদী। বললেই তো হয় এনটেরেন্সটা অনেকবার চেষ্টা করেও এখনও পাশ দিতে পারিস নি। এতে লজ্জার কী আছে? আমি জানি ওটা পাশ দেওয়া অত সহজ নয়। অনেক শক্ত। অনেকেই পারে না। তবে কথা সেটা না। সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে, এই বয়সে অত মিথ্যে কথা বলার ওব্বেশটা একটুও ভালো না। আল্লাহ না করুক, তবে আমার কোন সন্দেহ নেই যে বড় হয়ে শেষ পর্যন্ত তুই একজন চোর হবি’।
বাংলাদেশ সময়: ১৪১৬ ঘণ্টা, নভেম্বর ০১, ২০১৬
এমজেএফ/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।