চলতি বছরের জুলাইয়ে না ফেরার দেশে পাড়ি জমিয়েছেন প্রিয় বন্ধু ও জীবনের শেষ দিনগুলোর সাথী ম্যারিঅ্যান ইহলেন।
এর কদিন আগেই তাকে চিঠিতে লিখেছিলেন, সেই সময় এসে গেছে যখন সত্যিই আমরা বেশ বৃদ্ধ এবং আমাদের শরীর আলাদাভাবে ধ্বংসের দিকে যাচ্ছে।
এরপর কেটে গেলো মাসতিনেক। ম্যারিঅ্যানকে ঠিকই অনুসরণ করলেন তার প্রাণপ্রিয় বন্ধু লিওনার্দ কোহেন। ১০ নভেম্বর অন্য ভুবনের দিকে যাত্রা শুরু করলেন এ মহাত্মা।
চিঠিতে সেই ইঙ্গিতও দিয়েছিলেন, দারুণ একটি ভ্রমণের জন্য তোমাকে শুভকামনা। শুভবিদায়, পুরনো বন্ধু। অফুরান ভালোবাসা, দেখা হবে।
নিশ্চয় তাদের দেখা হবে! তুমুল জনপ্রিয় কোহেনকে কেউ কবি-লেখক হিসেবে পছন্দ করেন, কেউ গায়ক। কিন্তু কানাডিয়ান এ মহারথীর পরিচয়ের ব্যপ্তি যে বিশাল।
সমালোচক ব্রুস এদর কোহেনের সামগ্রিক কর্মজীবন মূল্যায়ন করতে গিয়ে উল্লেখ করেছেন, ৬০ দশকের সর্বাধিক চিত্তাকর্ষক গায়ক ও গানলেখক। বব ডিলনের পর দ্বিতীয় কেউ যিনি চার দশক জুড়ে নিজের সঙ্গীতের মধ্য দিয়ে শ্রোতাদের ধরে রেখেছেন।
হালের জনপ্রিয় লেখক জে কে রাউলিং তারই দু’টি লাইন দিয়ে তার চিরশান্তি কামনা করেছেন, দেয়ার ইজ আ ক্র্যাক ইন এভরিথিং, দ্যাটস হাউ দ্য লাইট গেট ইন।
অন্যদিকে, সনি মিউজিক কানাডা নিজেদের ফেসবুক পেজে তার মৃত্যুসংবাদ জানিয়ে লিখেছে, দুঃখের সঙ্গে জানাচ্ছি, কিংবদন্তি কবি, গীতিকার, শিল্পী লিওনার্দ কোহেন আমাদের ছেড়ে চলে গিয়েছেন। সঙ্গীত জগতের এক অন্যতম প্রতিভাকে আমরা হারিয়েছি। কিছু দিনের মধ্যেই লস অ্যাঞ্জেলেসে তার স্মরণসভা আয়োজন করা হবে। তার পরিবার শোকের সময় একান্তে কাটানোর অনুরোধ জানিয়েছেন। মৃত্যুর কারণ ও সঠিক সময় জানা যায়নি।
১৯৩৪ সালের ২১ সেপ্টেম্বর কুবেকের ওয়েস্টমাউন্টে জন্ম কোহেনের। কিশোর বয়সেই গিটার বাজানো শিখে তৈরি করেন লোকসঙ্গীতের দল ‘বাকস্কিন বয়েজ’। স্প্যানিশ লেখক ফ্রেদেরিকো গার্সিয়া লোরকার সংস্পর্শে এসে কবিতা ভালবেসে ফেলেন। ম্যাকগিল ইউনিভার্সিটি থেকে স্নাতক হওয়ার পর বাবার গ্রিক আইল্যান্ড হাইড্রায় থাকতে শুরু করেন লিওনার্দ। সেখানেই প্রকাশ করেন প্রথম কবিতার সংকলন ফ্লাওয়ারস ফর হিটলার (১৯৬৪) এবং দ্য ফেভরিট গেম (১৯৬৩) ও বিউটিফুল লুজারস (১৯৬৬) উপন্যাস দু’টি।
মন্ট্রিয়লের কাপড়ের কারখানায় কাজ আর বই বিক্রি না হওয়ায় হতাশায় ১৯৬৬ সালে নিউইয়র্ক পাড়ি দেন কোহেন। আলাপ হয় লোকসঙ্গীত গায়ক জুডি কলিনসের সঙ্গে। নিজের অ্যালবাম ‘ইন মাই লাইফ’-এ কোহেনের লেখা দু’টো গান সংযোজন করেন কলিনস। এই দু’টোর মধ্যেই ছিলো কোহেনের প্রথম সাড়া জাগানো গান ‘সুজানে’। ১৯৬৭ সালে প্রকাশিত হয় সংস অব লিওনার্দ কোহেন অ্যালবাম। বাড়তে থাকে জনপ্রিয়তা। একে একে আসে তার অন্যসব অ্যালবাম, কবিতার বই, উপন্যাস প্রভৃতি।
ব্যক্তিগত জীবনে সুজানে এলরোডের সঙ্গে সম্পর্কে দু’বার বাবা হয়েছেন কোহেন। দুই সন্তান ফোটোগ্রাফার লোরকা কোহেন ও অ্যাডাম কোহেন তৈরি করেন লো মিলিয়নস গ্রুপ। ১৯৯৫ সাল থেকে কেরিয়ারে রাশ টানেন কোহেন। লস অ্যাঞ্জেলেসের মাউন্ট বালডি জেন সেন্টারে গিয়ে বৌদ্ধধর্মে দীক্ষা নেন কোহেন। নতুন নাম হয় জিকান। যার অর্থ নিস্তব্ধতা। এর মধ্যেই ২০০১ সালে মৌনতা ভেঙে বেরিয়ে আসেন কোহেন। শ্যারন রবিনসনের সঙ্গে হাত মিলিয়ে বের করেন টেন নিউ সংস।
২০০৫ সালে শুরু হয় কোহেনের কেরিয়ারের শেষ অধ্যায়। দীর্ঘদিনের ম্যানেজার কেলি লিঞ্চের প্রতারণার শিকার হয়ে ৫০ লাখ ডলার ক্ষতি হয় তার। ক্ষতিপূরণ করতে শুরু করেন এপিক ট্যুর। ২০০৮ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত ৩শ ৮৭টি শো করেছেন তিনি। ২০১২ সালে বের করেন অ্যালবাম ‘ওল্ড আইডিয়াজ’। তার আশিতম জন্মদিনের পরদিন প্রকাশিত হয় অ্যালবাম ‘পপুলার প্রবলেমস’।
২০১৩ সালের ডিসেম্বর মাসে গ্র্যান্ড ট্যুর শেষ হওয়ার পর থেকে আর জনসমক্ষে দেখা যায়নি কোহেনকে। ২০১৬ সালের অক্টোবর মাসে ছেলে অ্যাডামের প্রযোজনায় বের করেন ‘ইউ ওয়ান্ট ইট ডার্কার’। শারীরিক অসুস্থতার জন্য বাড়ির বাইরে বেরোতে পারতেন না কোহেন। ডাইনিং টেবিলে বসেই মাইক্রোফোনের সাহায্য ল্যাপটপে রেকর্ড করতেন তিনি। শেষ অ্যালবামেও বিস্ময়কর সাড়া পাওয়ার পর কোহেন বলেন, আমি মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত। আশা করছি খুব একটা কষ্ট হবে না।
প্রিয়বন্ধুকে লেখা তার চিঠির লাইন থেকেই তাকে বলি, উইশ ইউ আ ভেরি গুড জার্নি কোহেন...
বাংলাদেশ সময়: ১৪২৮ ঘণ্টা, নভেম্বর ১১, ২০১৬
এসএনএস