সীমান্তে খুব একটা দেরি না হলেও বেলা প্রায় একটা নাগাদ এসে পৌঁছুলাম প্রিস্টিনাতে। যদিও সামনেই দেখলাম পেহা যাওয়ার বাস দাঁড়িয়ে আছে।
কসোভোর যুদ্ধ শেষ হয় ১৯৯৯ সালের দিকে, আর দেশটি স্বাধীনতা ঘোষণা করে ২০০৮ সালে। যদিও এখনও এ দেশটিকে পৃথিবীর অনেক দেশই স্বীকৃতি দেয়নি, নিকট প্রতিবেশী সার্বিয়ার তো দেওয়ার প্রশ্নই আসে না। এমনকি শুনেছিলাম পাসপোর্টে কসোভোর সিল থাকলে পরবর্তীতে নাকি সার্বিয়ায় ঢোকা কিছুটা দুঃসাধ্য হয়ে পড়ে। আমি অবশ্য সেজন্যই আগে সার্বিয়া গিয়ে তারপর মেসিডোনিয়া হয়ে কসোভোয় এসেছি।
যেহেতু খুব বেশিকাল আগে এদেশে যুদ্ধের নিনাদ শেষ হয়নি, তাই আমি ভেবেছিলাম প্রিস্টিনায় নেমেই হয়তো দেখবো যুদ্ধের ধ্বংসস্তূপ বা গুলিতে ঝাঁঝরা বাড়ির দেয়াল। কিন্তু কোথায় কী? বরং মূল সড়ক, যেটি গিয়ে মিশেছে শহরের প্রধান স্কয়ারে, সেটি ধরে হাঁটার সময়ে দু’পাশে কেবল অধুনা নির্মিত সারি সারি বহুতল আবাসন ভবনের দেখা মেলে। আর মসৃণ পিচঢালা সড়কে পুরনো গাড়ি তেমন চোখে পড়েই না বলা চলে।
মাঝে মাঝে হুসহাস করে পাশ কাটিয়ে চলে যায় দামি জার্মান গাড়ি। প্রিস্টিনায় যাওয়ার কিছুকাল পর আলবেনিয়ায় এক স্প্যানিশ ভদ্রলোকের সঙ্গে আলাপ হয়েছিলো। তিনিও প্রিস্টিনায় ঘুরে গেছেন বছরখানেক আগে। প্রিস্টিনার কথা উঠতেই সেই স্প্যানিশ ভদ্রলোকও দেখলাম একই প্রশ্ন করলেন। দেশটির অর্থনীতি যেখানে এখনও ততটা মজবুত নয়, বেকারত্বের হার যেখানে ত্রিশ থেকে চল্লিশ শতাংশ, সেখানে রাজধানী শহরে এই ঝাঁ চকচকে আবাসন কমপ্লেক্স আর গাড়িবহরের রহস্য কী?
আমাদের আলাপন কান পেতে শুনে পাশের একটি আলবেনীয় মেয়ে বলে উঠলো, কসোভোর একটি বিরাট জনগোষ্ঠী আজ জার্মানি সুইজারল্যান্ডের মতো ইউরোপের বিভিন্ন ধনী দেশে অভিবাসী, মূলত তারাই এই ভৌত অবকাঠামোগুলো নির্মাণে আজকাল বিনিয়োগ করছে, এটি আভ্যন্তরীণ বিনিয়োগের ফলে নয়।
আমি হাঁটছি এ সড়কের প্রধানতম সড়ক 'দেশময়রে বুলোভার্ড' ধরে। পশ্চিম ইউরোপীয় ধাঁচের কিছু কফিশপ আর পিৎজার দোকান পেরিয়ে যাওয়ার পর ডানধারে এক সবজি বাজারের সামনে এসে দাঁড়াই। বাজারটি ঠিক উন্মুক্ত স্থানে নয়, বরং এক অন্ধকারময় চাতালের নিচে টিমটিমে বিজলি বাতির আলোকসম্পাতের মাঝে নিজেকে সাজিয়ে নিয়েছে।
অজানা পথিকের তাই হঠাৎ করেই এটি নজরে পড়বার কথা নয়। তবে অন্তত আমার নজরে যেহেতু পড়েছে তাই ভাবি, ভেতরে একটু ঢুঁ মারলে ক্ষতি কি? সেখানে ঢুকতেই চোখে পড়ে রংবেরঙের ফল সাজিয়ে পাশে একটি চেয়ার পেতে খবরের কাগজ পড়ছেন রাশভারী বুড়ো দোকানি। মাথায় একটি জীর্ণ রোদ-টুপি, পরনে কালচে খয়েরি কোট, চোখে সিলভার ফ্রেমের মোটা কাচের চশমা।
ভদ্রলোক যদি এখানে না বসে খানিক দূরে এই চেয়ার পেতে বসতেন তবে আমি নিশ্চিত, তাকে কোনো স্কুলের মাস্টারমশাই বলে ভাবতাম। ভদ্রলোকের দোকানখানাও ভারী পছন্দ হলো। নানা পদের ফল তো আছেই, তার সঙ্গে আছে অন্তত চার-পাঁচ ধরনের ক্যাপসিকাম মরিচ।
এখানে একটা কথা বলে রাখি, বলকানের এ অঞ্চলে লম্বাটে এক ধরনের সবুজাভ-হলুদ ক্যাপসিকাম মরিচের ব্যাপক জনপ্রিয়তা। বাঙালি যেমন ভাতের সঙ্গে কচকচিয়ে কাঁচা মরিচের ঝাল পেতে পছন্দ করে, তেমনি এ অঞ্চলের মানুষেরা চেভাপি-বুরেকের মতো খাবারের সঙ্গে আগুনে পোড়া ওই ক্যাপসিকাম পাতে রাখে। এখানে হোটেল-রেস্টুরেন্টে খাবার অর্ডার দিলে প্লেটে মুফতে ও জিনিসও দেওয়া হয়। দু’একবার খেয়ে দেখেছি, খেতে মন্দ নয়।
** কসোভোর অন্ধ বাঁশিওয়ালা (পর্ব-৬)
** কসোভোর অন্ধ বাঁশিওয়ালা (পর্ব-৫)
** কসোভোর অন্ধ বাঁশিওয়ালা (পর্ব-৪)
** কসোভোর অন্ধ বাঁশিওয়ালা (পর্ব-৩)
** কসোভোর অন্ধ বাঁশিওয়ালা (পর্ব-২)
** কসোভোর অন্ধ বাঁশিওয়ালা (পর্ব-১)
বাংলাদেশ সময়: ০১৩৪ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১৮, ২০১৭
এএ