দূরত্ব বেশি হলেও সে মাঝে মধ্যে আমার হলে আসতো।
ওকে একদিন বললাম, কি রে কেমন চলে?
সে বলল, দোস্ত তোদের দোয়ায় পারফরম্যান্স আরও ভালো; এখন যার সঙ্গে চলছে সেই মেয়ের নাম শ্রাবন্তি, বড়লোক বাবার একমাত্র মেয়ে, ঢাকায় বাগি-গাড়ি আছে।
এই জন্য তুই প্রায়ই ঢাকায় আসিস?
এই আর কি......।
দোস্ত তুই আমাকে সূত্রটা শেখাতে পারিস।
ওর উত্তর, তোর দ্বারা এগুলো হবে না। তুই পড়াশোনা কর।
আর কি করা, এমবিএ শেষ করে ২০০৬ সালে একটি বেসরকারি ব্যাংকে চাকরি নিয়ে এক মফস্বল শহরে আছি।
পাঁচ-ছয় বছর মাসুদের সঙ্গে দেখা নেই। কারণ, সে লন্ডন প্রবাসী। ২০১২ সালের মাঝামাঝি, ব্যক্তিগত প্রয়োজনে ঢাকার মতিঝিলে এক পড়ন্ত বিকেলে বিআরটিসি দ্বিতল বাসের অপেক্ষায়।
হঠাৎ একটি নারী কণ্ঠ, ভাইয়া কেমন আছেন?
পাশে তাকিয়ে দেখি এক ভদ্র মহিলা, হাতে বাসের টিকিট, ঘাড়ে ব্যাগ এবং অন্য হাতে ধরা চার-পাঁচ বছরের একটি মেয়ে। আপনি তো আল আমীন, মাসুদের বন্ধু।
আমি ইতস্তত করে, আপনি........।
আমি মৌসুমী, মাসুদের স্ত্রী ও আমার মেয়ে ঈরা।
ওর গালে হাত দিয়ে বললাম, আম্মু কেমন আছো?
ভালো, তুমি কেমন আছো? ঈরার ঝটপট উত্তর।
কিন্তু মাসুদ তো বিয়ের দাওয়াত দেয়নি।
বিয়েটা গোপনে। ভাইয়া, মাসুদের সঙ্গে যোগাযোগ আছে? আমি তার কোনো খোঁজ জানি না।
সে না লন্ডনে থাকে?
শুনেছি, যোগাযোগ নেই।
ইতোমধ্যে বাস চলে এলো, মৌসুমী বলল, ভাইয়া একসঙ্গে বসবো, আপনার সঙ্গে কথা আছে। আমরা দুই তলায় একদম সামনের সারির বামপাশে বসলাম, মৌসুমী জানালার পাশে, ঈরা আমার কোলে। আমার গন্তব্য মীরপুর ১০ হয়ে মীরপুর ২ নম্বরে ছোটভাইয়ের বাসা। তোমার সঙ্গে যোগাযোগ নেই মানে কি? ঘটনাটা খুলে বলো। প্রায় দুই ঘণ্টা ধরে তার গল্প শুনলাম।
‘সম্পর্কের প্রায় নয় বছরের মাথায় আমাদের বিয়ে হয়, ওর মাস্টার্স পরীক্ষার কিছুদিন আগে। আমি তখন অ্যাকাউন্টিংয়ে অনার্স ফাইনাল ইয়ারে। মাস্টার্স পরীক্ষা শেষ করে ঢাকায় আমাদের বাসা নেওয়ার কথা। পরীক্ষার দুই সপ্তাহ পর থেকেই তার কোনো খোঁজ পাচ্ছি না। শুনলাম, শ্রাবন্তিকে বিয়ে করে সে লন্ডন প্রবাসী। আপনি কি শ্রাবন্তিকে চেনেন?’
তারা এক সাথে পড়ত, কিন্তু কোনো সম্পর্ক ছিলো কিনা তা জানি না। আমি তাকে আর কষ্ট দিতে চইলাম না।
‘আমার ফ্যামিলি, তাদের ফ্যামিলিকে আমাদের বিয়ে মেনে নিতে বলেছিল, কিন্তু মাসুদ নাকি আমাকে চেনে না বলে তারা মেনে নেয়নি। ’
তুমি কী কথা বলেছ মাসুদের সঙ্গে?
‘মাসুদের বাবা একদিন ফোন ধরিয়ে দিয়ে বলল কথা বলতে, আমি কথা বললাম, কিন্তু সে না চেনার অভিনয় করল। সে এমনভাবে কথা বলল যে, মৌসুমী নামে কোনো মেয়ের অস্তিত্ব তার ভিতরে নেই এবং তাকে এক অন্য মাসুদ মনে হচ্ছিল যা আমার কাছে অবিশ্বাস্য ছিলো। আমি ঈরার কথা বললাম, তাও বিশ্বাস করল না। একজন বাবা হয়ে সন্তানকে অবিশ্বাস করা সম্ভব? ভাইয়া, আপনার ফ্যামিলি সংবাদ: ভাবি-বাচ্চাকাচ্চা?’
বাচ্চা নেই তবে এ বছর শেষের দিকে আশা আছে, মানে তোমার ভাবি সন্তানসম্ভবা।
আমি আমার অনাগত সন্তানের কথা চিন্তা করে এক অন্যরকম বাবার অনুভূতি উপভোগ করি। এবং আমি বিশ্বাস করি সন্তানকে অবিশ্বাস করা অসম্ভব। মৌসুমীকে জিজ্ঞেস করি, তুমি না অ্যাকাউন্টিংয়ের ছাত্রী, হিসাবে গরমিল হলো কীভাবে?
‘কত ব্যালেন্স শিট মেলালাম কিন্তু জীবনের ব্যালেন্স শিটটা মেলাতে পারলাম না। ’
আসলে ব্যালেন্স শিট সব সময়ই মেলে, হয়তো লায়াবিলিটি বাড়ে আর ইকুইটি কমে।
‘অ্যাকাউন্টিংয়ে আপনার ডেপথ অনেক বেশি, তাই আপনি ব্যালেন্স শিট মেলাতে পারেন। ’
প্রায় দুই ঘণ্টা গল্প করে জানা গেলো, বাবা মারা যাওয়ার পর সে কীভাবে একটি কোম্পানিতে চাকরি করে মা ও মেয়েকে লালন-পালন করছে সেই কাহিনী। সে শ্যাওড়াপাড়ায় নেমে গেলো। নামার পরে তাকে মনে হলো, সে শুধু সুন্দরী নয়, বুদ্ধিমতী ও দৃঢ়চেতা। এবং ঈরাকে দেখে মনে হলো, সে মাসুদের পুরো কপি — সেই চোখ, নাক শুধু একটু মেয়েলি লুক। ডিএনএ পরীক্ষার প্রয়োজন নেই যে, সে মাসুদের মেয়ে।
২০১৩ সালের মার্চ মাস, ফেসবুকের ইনবক্সে একটি মেসেজ, দোস্ত কেমন আছিস? সেন্ডার, মাসুদুর রহমান।
বিভিন্ন আলাপচারিতার এক পর্যায়ে তাকে বললাম, কিছুদিন আগে তোর মেয়েকে দেখলাম, ঠিক তোর কপি।
‘তুই তো আগের মতোই আছিস, বিব্রত করে মজা পাস...’ ওর উত্তর।
আমি সিরিয়াসলি বলছি। কেন তুই তো মৌসুমীর গল্প অনেক বলেছিস।
‘কিন্তু আমার তো এ ধরনের কিছু মনে পড়ে না। মৌসুমী নামে একটি মেয়ে আমাদের বাড়িতে গিয়েও একই কথা বলেছে। কিন্তু একটা অপরিচিত মেয়ে কেন এ কাজ করবে? বিষয়টা আমাকে নতুন করে ভাবনায় ফেলছে। আমার স্ত্রীর নাম শ্রাবন্তি এবং ছেলে সাদনান, আমরা লন্ডনে আছি। মেয়েটার উদ্দেশ্য কি তুই জানতে পারলে আমাকে জানাস। শুভ সন্ধ্যা...’
শুভ রাত্রী...(আমাদের সময় রাত সাড়ে বারো ও লন্ডনে সন্ধ্যা সাড়ে ছয়)।
এক মাসের মধ্যে মাসুদ দেশে ফিরে এলো। সে আমার কাছ থেকে ঘটনাটা শুনে আর লন্ডন থাকতে পারেনি। যেকোনোভাবে এই রহস্য উদঘাটন করতে সে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ।
বাংলাদেশ সময়: ১৭৫২ ঘণ্টা, এপ্রিল ১০, ২০১৭
এসএনএস