বাঙালি ঐতিহ্যের অন্যতম ধারক পহেলা বৈশাখ। বাঙালি জীবনের সর্বত্রই এর অবাধ বিচরণ।
সাহিত্য সময়ের প্রতিচ্ছবি। আর সেই প্রতিচ্ছবিতে অংকিত হয় সমকালীন সময়ের চিত্র। সময়ের শিল্পীরা অত্যন্ত সুনিপুণভাবে ফুটিয়ে তোলেন নিজ নিজ শিল্পকর্মে তার চেতনা, বিশ্বাসের প্রতিফলন। বাংলা সাহিত্যের বিভিন্ন শাখায় বৈশাখভিত্তিক রচনা অনেক গুরুত্বপূর্ণ একটি জায়গা দখল করে আছে। এর মধ্যে কবিতাই প্রধান। যখন পহেলা বৈশাখ সেভাবে ঘটা করে পালন করা শুরু হয়নি তারও আগে থেকে বছরের শুরুতে যে এই অঞ্চলের মানুষের মধ্যে এই শুরুটাকে নিয়ে অন্য রকম প্রাণের গুঞ্জরণ তৈরি হতো। সেটা মধ্য যুগের কবিদের কবিতার মধ্যে প্রতিফলিত হয়েছে।
বাংলা কবিতার শাখায়-প্রশাখায় ছড়িয়ে রয়েছে উৎসবমুখর বাঙালির প্রাণের প্রতিধ্বনি। যে কারণে বলা হয়ে থাকে বাঙালির বারো মাসে তোরো পার্বণ। এই পাবর্ণের মধ্যে বৈশাখই অন্যতম প্রধান একটি উৎসব। বাংলা কবিতায় এর প্রবেশ এবং সরব হাঁটাচলা প্রত্যক্ষভাবে দেখা যায়। এমন কোনো কবি নেই যে কিনা বৈশাখ নিয়ে কিছু লেখেননি। এর মধ্য দিয়েই বুঝতে পারা যায়, সব সময়ই বৈশাখ এই অঞ্চলের মানুষের কাছে অত্যন্ত গুরুত্বের ছিলো। নতুন বছরকে বরণ করার জন্য নিজ থেকেই তারা প্রস্তুতি নিতো। বাংলাদেশে এখনাকার বৈশাখী উৎসব মানেই কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সেই চির পরিচিত গান-
‘এসো হে বৈশাখ, এসো এসো
তাপস নিঃশ্বাস বায়ে
মুমূর্ষুরে দাও উড়ায়ে
বৎসরের আবর্জনা দূর হয়ে যাক যাক যাক
এসো এসো...’
এই গানের মধ্য দিয়েই নতুন বছরকে বরণ করে নেওয়া অধিকাংশ অনুষ্ঠানমালার শুরু হয়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাংলা সাহিত্যের বটগাছরূপে দাঁড়িয়ে আছেন শুধু সেজন্যই নয়। বরং তার জীবন ঘনিষ্ট এই রচনা বাঙালিদের মনে নাড়া দেয়। আলোড়িত করে, নতুনভাবে শুরু করার উৎসাহ দেয়।
এই গান ছাড়াও কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার 'বলাকা' কাব্যগ্রন্থের অন্যতম কবিতা 'বলাকা'য় ঝড়ের মাঝে জীবনের যে স্পন্দন অনুভব করেছেন সেখানে নিশ্চল পর্বত বৈশাখের নিরুদ্দেশ মেঘ হতে চেয়েছে—
'...পর্বত চাহিল হতে বৈশাখের নিরুদ্দেশ মেঘ;...'
রবীন্দ্র কবিতায় ঋতু পরিবর্তনের চিত্র তুলে ধরার ক্ষেত্রে অনেক সময় শিবের রুদ্রমূর্তির তুলনা এনেছেন। প্রকৃতির পরিবর্তনের বৈশিষ্ট্যগুলো সহসা কবির উপলব্ধিতে সাড়া জাগিয়েছে। আর সে কারণে রবীন্দ্র কবিতায় আমাদের ভূগোল, আমাদের পঞ্জিকার মাসগুলো অনায়াসে স্থান করে নিয়েছে। সেই সব মাসের উচ্চারণ যেমন প্রকৃতি দর্শন তেমনি প্রকৃতি কখনো অনুসঙ্গ, কখনো প্রসঙ্গ, কখনো তত্ত্ব-তথ্যের প্রতীকী ছোঁয়ায় নতুন ব্যঞ্জনায় ঋদ্ধ হয়ে ওঠে। গেরুয়া রঙ বৈরাগ্যের প্রতীক। বৈশাখের প্রকৃতির রঙে কবি রবীন্দ্রনাথ গেরুয়া রঙ দেখেছেন। বৈশাখ তেজোদ্বীপ্ত, শিবের মতোন ভয়াল রূপ ধারণক্ষম, আবার বিধবার বেশ ছিন্নকারী সাহসীর মতো। রবীন্দ্রনাথ বৈশাখের তুমুল বেগের মাঝে দেখেছেন ক্ষিপ্রতা আর সাহসিকতা, গেরুয়া রঙের মাঝে দেখেছেন পৃথিবীর বৈরাগ্য।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর দিয়ে শুরু করলেও বাংলা সাহিত্যের মধ্যযুগে গেলে আমরা নতুন বছরের শুরু নিয়ে তখনকার কবিদের উচ্চারণ খুঁজে পাই। মধ্য যুগের সৃষ্টি মঙ্গল কাব্যের মধ্যে বৈশাখ বিষয়ক পঙক্তি খুঁজে পাওয়া যায়। মধ্য যুগের অন্যতম কবি মুকুন্দরাম চক্রবর্তী (১৫৪০-১৬০০) চণ্ডীমঙ্গল কাব্যে কালকেতু ও ফুল্লরার দাম্পত্য জীবনের সুখ-দুঃখের চমৎকারভাবে কষ্টের বর্ণনায় প্রচণ্ড দাবদাহের মাস বৈশাখের কথা স্মরণ করেছেন। তিনি লিখেছেন-
‘বৈশাখে অনলসম বসন্তের খরা।
তরুতল নাহি মোর করিকে পসরা
পায় পোড়ে খরতর রবির কিরণ।
শিরে দিতে নাহি আঁটে খুঞ্চার বসন
নিযুক্ত করিল বিধি সবার কাপড়।
অভাগী ফুল্লরা পরে হরিণের দুড়’
বৈশাখ নিয়ে বাংলাদেশের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের নিবেদনকে সম্মান জানাতে হয়; বৈশাখের স্বকীয় স্বরকে তিনি নিজ সাধনে নতুন সৃষ্টির প্রয়াস পেয়েছেন। বৈশাখ মাস শুধু যে কাল-বৈশাখী নিয়েই প্রকৃতির প্রতি নিদারুণ উত্তপ্ত প্রকাশে থাকছে তা নয়। বৈশাখের একটি প্রধান অনুষঙ্গ হলো ‘বৈশাখী ঝড়’, সেই ঝড়ের আওয়াজ বাতাসের শনশন শব্দে গেঁথে তোলায় তার মতো কে আর মুন্সিয়ানা দেখিয়েছেন। চেনা বৈশাখের ভিন্নতর অবয়ব বাংলা কবিতায় কীভাবে এসেছে, বৈশাখের বৈশিষ্ট্য ধারণ করেও কবিতায় অভিনব কী অনুভূতি সংযুক্ত হয়েছে- তার অনুসন্ধান বরং অধিক গুরুত্বপূর্ণ। এখানেও বৈশাখ মাস নজরুলের মতোই বৈচিত্রীয় রূপে নিজেকে প্রকাশ করে। কখনো শান্ত কখনো উদাস কখনো নীল আকাশ বুকে করে নিশ্চিন্ত, কখনো কালো মেঘ সেই নীলাকাশকে গ্রাস করে। বাতাস বন্ধ। হঠাৎ প্রলয় বেগে ঝড়। ক্ষণিকের। প্রকৃতি ঝড় চলে গেলে শান্ত রূপ নিয়ে আনমনা হয়ে থাকে। নজরুল বৈশাখ নিয়ে নানান বৈচিত্রীয় চিন্তায় নিমগ্ন রইতেন। একটি কাব্য গীতির দ্বিতীয় অন্তরায় বর্ণনায় কবি নজরুল তার প্রেয়সীকে মনে করেন। অস্থির মনের বাণীতে বৈশাখী ঝড়ের বর্ণনা পাই-
‘বৈশাখী ঝড়ে রাতে চমকিয়া উঠি জেগে’
বুঝি অশান্ত মম আসিলে ঝড়ের বেগে,
ঝড় চলে যায় কেঁদে ঢালিয়া শ্রাবণ ধারা
সেকি তুমি? সে কি তুমি?’
এই বৈশাখী ঝড়কে কবি কাব্য করেছেন ‘ভাঙার গান’-এ। ‘কারার ঐ লৌহ কপাট’-দারুণ আন্দোলন উপযোগী সঙ্গীত। গানটিতে যে ধরনের যন্ত্রসঙ্গীত ব্যবহার করার ব্যবস্থা নজরুল রেখেছেন তাতে গানখানির সুর যে নিপুণ মার্চের তালে মনকে নাড়া দেয় সেখানে কাল-বোশেখীর প্রলয়ঙ্করী রূপের সাথে পরিবেশকে ক্ষেপিয়ে তোলে। তিনটির শেষ অন্তরায় পাই কাল-বোশেখীর কাব্যিক প্রকাশ। কাল-বোশেখীর প্রলয়ঙ্করী দাপটকে কবি নৃত্যের সাথে তুলনা করেছেন। অপূর্ব এক পৌরুষদীপ্ত রূপ প্রকাশ এখানে ফুটে উঠেছে-
‘নাচে ঐ কাল-বোশেখী
কাটাবি কাল বসে কি?
দেরে দেখি
ভীম কারার ঐ ভিত্তি নাড়ি।
লাথি মার ভাঙরে তালা
যত সব বন্দী-শালায়
আগুন জ্বালা
আগুন জ্বালা ফেল উপাড়ি॥’
আধুনিক বাংলা কবিতার রাজপুত্র যাকে বলা যায় সেই কবি জীবনানন্দ দাশও তার কবিতায় বৈশাখি কামনাভরা জীবনের ছবি এঁকেছেন। তার প্রাণের উচ্ছ্বাসে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বছর কবি চিরলালিত এই চেতনায় চিড় ধরে। কঠিন রাজনৈতিক বাস্তবতার সময়ে বৈশাখের মাটিতে দেখা দেয় ফাটল: তার মেঘ বৈশাখের নিরুদ্দেশ মেঘ নয়, তার মেঘ কড়ি-শঙ্খের পাহাড়। তার কবিতায় বৈশাখের জোছনার রাত ছায়াময় আর রৌদ্রের দিন রঙিন। গ্রীষ্মের রঙিন রোদ্দুর বিলাসে মেতে ওঠেন। উষ্ণতাভরা বৈশাখের চিত্রে লিখেছেন-
‘বৈশাখের মাঠের ফাটলে
এখানে পৃথিবী অসমান।
আর কোনো প্রতিশ্রুতি নেই।
কেবল খড়ের স্তূপ পড়ে আছে দুই-তিন মাইল
তবু তা সোনার মতো নয়;
কেবল কাস্তের শব্দ পৃথিবীর কামানকে ভুলে
করুণ, নিরীহ, নিরাশ্রয়। ’
কবি জীবনানন্দ দাশ তার অন্য এক কবিতায় আরও লেখেন :
‘এসো এসো ওগো নবীন,
চলে গেছে জীর্ণ মলিন-
আজকে তুমি মৃত্যুবিহীন
মুক্ত সীমারেখা। ’
বাংলা কবিতা ত্রিশের দশক পেড়িয়ে এসে পঞ্চাশের দশকে আবার নতুন করে সাজগোজ করে নয়ে। সেই মঞ্চের এক উল্লেখযোগ্য কবি শামসুর রাহমান। কবি শামসুর রাহমান তার লেখার মধ্যে লিখেছেন, ‘আমার মাকে আমি কোনোদিন গান গাইতে শুনিনি’কথাটি আমার জীবনেও প্রায় সত্য, ব্যাতিক্রম কেবল চৈত্রসংক্রান্তির দিন। শিশুকাল থেকে দেখেছি চৈত্রসংক্রন্তির দিন বাড়ির উঠোন-অঙ্গিনা ঘর-দোর পরিস্কার করতে করতে মা গাইছেন–
তাপস নিশ্বাস বায়ে মুমূর্ষূরে দাও উড়ায়ে
বৎসরের আবর্জনা দূর হয়ে যাক যাক
এসো এসো ॥
এসো হে বৈশাখ এসো এসো
যাক পুরাতন স্মৃতি, যাক ভুলে-যাওয়া গীতি
অশ্রুবাষ্প সুদূরে মিলাক ॥
মুছে য্কা গ্লানি ঘুচে যাক জরা
অগ্নিস্নানে শূচি হোক ধরা’
কবি শামসুর রাহমানের কবিতায় বৈশাখ আবির্ভূত হয়েছে অভাব, যন্ত্রণা ও কষ্টের প্রতীক হিসেবে। অভাব-অনটনে অতিষ্ঠ হয়েও অনেকসময় মানুষ দুর্দান্ত সংগ্রামের পথ বেছে নেয়। তা হলে দেখা যাচ্ছে, শেষতক এদের কবিতায়ও বৈশাখ সংগ্রামী চশমায় সজ্জিত।
‘রাত্রি ফুরালে জ্বলে ওঠে দিন
বাঘের থাবায় মরছে হরিণ
কাল বোশেখের তান্ডবে কাঁপে পড়ো পড়ো চাল
শূন্য ভাঁড়ারে বাড়ন্ত চাল ইচ্ছে তার ইচ্ছে। ’
গ্রাম্য জীবন, প্রকৃতি আর পল্লী মানুষের মনের কথা- এই তিনের মিলনে নির্মিত এই গান। এই গান সৃষ্টির মূলে রয়েছে কৃষক, জেলে, মাঝি, তাঁতি, কুমোর ও কামারের মতো গ্রাম্য মানুষের প্রাণের আর্তি আর হৃদয়ের ভাষা। এ গানে কোনো কৃত্রিমতা নেই, কোনো কষ্ট-কল্পনা নেই। বৈশাখী গানের ভেতরও রয়েছে গ্রাম্য সমাজের একটা নিবিড় সম্পর্ক। তাই এই গান বিষয়, ভাব, রস আর সুরের দিক দিয়ে অত্যন্ত সমৃদ্ধ। ‘সোনালী কাবিন’র কবি আল মাহমুদের হাতেও লিখিত হয়েছে নতুন বছরের শুরুর দিন পহেলা বৈশাখ নিয়ে সুন্দর অবয়বের কবিতা। পুরনোকে পেছনে ফেলে নতুনের আহবান যদি বৈশাখের প্রেরণা হয়ে থাকে, তবে সব অপরাধীর শাস্তি হোক! সব শোষক তলিয়ে যাক বোশেখের বাউলা বাতাসের বন্যায়! বৈশাখ যদি ধ্বংসই করবে, তাহলে কবি আল মাহমুদের প্রার্থনা, ধ্বংস করুক বিভেদকারী পরগাছাদের। তার ‘বোশেখ’ শিরোনামের কবিতা থেকে পাঠ করা যেতে পারে-
‘যে বাতাসে বুনোহাঁসের ঝাঁক ভেঙে যায়
জেটের পাখা দুমড়ে শেষে আছাড় মারে
নদীর পানি শূন্যে তুলে দেয় ছড়িয়ে
নুইয়ে দেয় টেলিগ্রাফের থামগুলোকে।
সেই পবনের কাছে আমার এই মিনতি
তিষ্ঠ হাওয়া, তিষ্ঠ মহাপ্রতাপশালী,
গরিব মাঝির পালের দড়ি ছিঁড়ে কী লাভ?
কী সুখ বলো গুড়িয়ে দিয়ে চাষীর ভিটে?
বেগুন পাতার বাসা ছিঁড়ে টুনটুনিদের
উল্টে ফেলে দুঃখী মায়ের ভাতের হাঁড়ি
হে দেবতা, বলো তোমার কী আনন্দ,
কী মজা পাও বাবুই পাখির ঘর উড়িয়ে? ’
কবিতার মধ্যেই কথা বলে ওঠে শব্দের দলবল। সেই দলবলকে নিয়ে কবি খেলতে থাকেন তার ইচ্ছে মতো। ইচ্ছেগুলো সময়ের চাদর থেকে বের হয়ে আসে লোকালয়ে তখন তারাই কথা বলতে থাকে নিজস্ব স্বরে। কবি সৈয়দ শামসুল হকের কবিতার মধ্যে তেমন এক উচ্ছ্বাস দেখা যায়। তার রচিত ‘বৈশাখে রচিত পংক্তিমালা’ কাব্যগ্রন্থের মধ্যে তিনি লিখেছেন-
‘বহুদিন থেকে আমি লিখছি কবিতা;
হঠাৎ দেখতে পাই কালবৈশাখের
ঝড় ফেটে পড়ে তীব্র আর্তনাদে,
বাতাসের হাহাকারে, নৌকোয় নৌকোয় দোলে ‘
বাংলা কবিতাকে সমকালীন পাঠকের কাছে পৌঁছে দিতে ষাটের অন্যতম জনপ্রিয় কবি মহাদেব সাহার গুরুত্ব অনেক। কবিতার সাথে তিনি হেঁটেছেন অনেক পথ। কথা বলেছেন নিজের ভাষায়। কবিতাতে বলেছেন বিচিত্রসব মেঠোপথের কথা। সেই প্রেমের কবি মহাদেব সাহার ‘বৈশাখে নিজস্ব সংবাদ’কবিতায় ধ্বনিত হয়েছে বৈশাখের সুর-
‘মা আমাকে বলেছিলো- যেখানেই থাকিস তুই
বাড়ি আসবি পয়লা বোশেখে। পয়লা বোশেখ বড়ো ভালো দিন
এ দিন ঘরের ছেলে বাইরে থাকতে নেই কভু, বছরের এই একটি দিনে
আমি সিদ্ধিদাতা গণেশের পায়ে দিই
ফুলজল, কে বলবে কী করে কার বছর কাটবে,
বন্যা, ঝড় কিংবা অগ্নিকান্ড কতো কি ঘটতে পারে, তোর তো কথাই নেই’
আমরা সমকালীন আরও কয়েকজন প্রতিনিধিত্বশীল কবির কবিতা থেকে বৈশাখের পঙ্ক্তির পাঠ নিতে পারি-
‘আজ ধ্রুবতারা অস্ত গেল না
মঞ্চে ফুটে আছেন শুধু আপনি, রবিঠাকুর
টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়ায়, ঘর থেকে মুখর প্রাঙ্গণে
আজ সারাদিন বর্ষবরণের যতো উৎসব হবে
তার সব কটিতে প্রধান
নক্ষত্রপুরুষ আপনি, রবিঠাকুর’
(আজ বর্ষবরণের যত উৎসব/ শিহাব সরকার)
‘বৈশাখ, আমার অপরাজিত পূর্বপুরুষের মতো
তুমিও আমাকে শেখাও তোমার বজ্রের ভাষা
তোমার হিংস্র রৌদ্রের বর্ণমালা
তোমার কালবৈশাখীর ঝড়ের ডানার আদর।
(বৈশাখ/ আবিদ আজাদ)
‘ঝড়কে নেব, কারণ তারা রাগী
কারণ তারা উড়িয়ে নেয় ক্ষত’
(হালখাতা/ কামাল চৌধুরী)
বাংলাদেশের নাগরিক জীবনে যে সাংস্কৃতিক চেতনায় পহেলা বৈশাখের উৎসব হচ্ছে, তা প্রবর্তনের কৃতিত্ব কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের। তিনিই প্রথম শান্তিনিকেতনে ঋতুভিত্তিক উৎসবের আয়োজন করেন। এর অংশ হিসেবে বৈশাখ বরণের উৎসব আয়োজনের পাশাপাশি বাংলা নতুন বছরকে সম্ভাষণ জানিয়ে রচনা করেছেন বহু কালজয়ী সংগীত ও কবিতা। ত্রিশ পরবর্তী বাংলা কবিতার উজ্জ্বল সময় পঞ্চাশ ও ষাটের প্রধান কবিরা তাঁদের আত্মপ্রকাশকারী কবিতাগ্রন্থের শিরোনামে স্থান দিয়েছেন বৈশাখের মুকুটকে; সৈয়দ শামসুল হকের কাব্য ‘বৈশাখে রচিত পঙ্ক্তিমালা’এবং মোহাম্মদ রফিকের কবিতার বই ‘বৈশাখী পূর্ণিমা’। ষাটের আরেক অন্যতম কবি নির্মলেন্দু গুণ লিখেছেন ‘চৈত্রের ভালোবাসা’নামের একটি কাব্যগ্রন্থ। বৈশাখ প্রেমের মাস না হলেও বৈশাখ পুরাতন স্মৃতি-জরা-গ্লানি পেছনে ফেলে নতুনকে-সবুজকে আবাহনের কাল, বৈশাখ নতুনের সাথে হাত ধরে চলার প্রেরণা, বৈশাখ সম্ভাবনার দুয়ার খুলে দেয়ার স্পর্ধার সময়।
বৈশাখ আমাদের গ্রামীন মানুষের জীবনে অনেক সময়ই একটা অতংকের নাম। বৈশাখী মেলা আর উৎসবের আমেজ ছাড়িয়ে কাল বৈশাখী অনেক সময়ই আতংকিত করে এই জনপদের মানুষদের। এখানে ঘূর্ণিঝড়, সাইক্লোন, টর্নেডো, সিডর ইত্যাদির আতঙ্কে যতটুকু না মানুষের হৃদয় কেঁপে ওঠে, তার চেয়ে অনেক বেশি কেঁপে ওঠে অপসংস্কৃতির সিডর-আতঙ্কে। কারণ ঘূর্ণিঝড়, সাইক্লোন, টর্নেডো, সিডর ইত্যাদির ক্ষয়ক্ষতি খুব তাড়াতাড়ি পুষিয়ে নেয়া যায়। কিন্তু সাহিত্য-সংস্কৃতির অঙ্গনে চাপিয়ে দেয়া সিডরে বিধ্বস্ত জাতি শিরদাঁড়া সোজা করে দাঁড়াতে সময় লাগে; কখনোবা আর দাঁড়াতেই পারে না। তার অকালমৃত্যু ঘটে। তাই আমাদের সাহিত্যে-সংস্কৃতিতে, মানুষের বিবেক-বুদ্ধিতে, কর্তাব্যক্তিদের মননে-মস্তিষ্কে, উঁচু-নিচু সর্বস্তরের জনগণের জীবন ও মননে একটা বিশাল বৈশাখী ঝড়ের বড় প্রয়োজন। যে ঝড়ে সব অপসংস্কৃতির ধুলো উড়ে গিয়ে বাংলাদেশের মাটি পবিত্র হয়ে উঠে সেখানে ফলবে বাংলা কবিতার উজ্বল সব ফসল।
বাংলাদেশ সময়: ১৫১২ ঘণ্টা, এপ্রিল ১৪, ২০১৭
এসএনএস