ঢাকা, শুক্রবার, ৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২২ নভেম্বর ২০২৪, ২০ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

শিল্প-সাহিত্য

বহুমাত্রিক ভ্রমণ | ড. মাহফুজ পারভেজ

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৮২৬ ঘণ্টা, এপ্রিল ১৮, ২০১৭
বহুমাত্রিক ভ্রমণ | ড. মাহফুজ পারভেজ বহুমাত্রিক ভ্রমণ / ছবি: সংগৃহীত

সাধারণভাবে সাহিত্যের দরবারে ভ্রমণের স্থান নেই। যদিও বাংলা সাহিত্যে ব্যতিক্রমী উদাহরণের অভাবও নেই। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথের রাশিয়ার চিঠি বা জাভাযাত্রীর পত্র, জলধর সেনের হিমালয়, সৈয়দ মুজতবা আলীর দেশে বিদেশে, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ছবির দেশে কবিতার দেশে তৎক্ষণাৎ মনে পড়ে।

সূক্ষতম অর্থে ভ্রমণ ও যাত্রা সমার্থক নয়। অভিযাত্রা ধারণ করে অন্যবিধ অর্থ।

ভ্রমণের গন্তব্য থাকে, উদ্দেশ্যও থাকতে পারে। যাত্রার জন্য উদ্দেশ্য বা গন্তব্য জরুরি নয়। কাছাকাছি অর্থের চরৈবেতি শব্দটির সঙ্গে আমরা পরিচিত। শব্দটির অর্থ ভাসা-ভাসা জানতাম: বসে থেকো না, চলতে থাকো। জেনেছি শব্দটির উৎস ভারতীয় মিথ। অতএব যথাস্থানে কিছুটা ঘাঁটাঘাঁটির পর শব্দটির তাৎপর্য বুঝতে পেরেছি। চরৈবেতি মানে চলতে থাকো, যাত্রা করো। যাত্রার আদি প্রণোদনা বৈদিক যুগের, তিন হাজার বছর আগেকার।

ঋগবেদ-এ ‘ঐতরেয় ব্রাহ্মণ’ অংশে একটি কাহিনীতে বরুণের শাপগ্রস্ত রাজা হরিশচন্দ্র এবং তার পুত্র রোহিতের দুর্দৈবের কথা বলা হয়েছে। রোহিত বাবার রোগমুক্তির জন্য ইন্দ্রের ধ্যান শুরু করলেন। ইন্দ্র রোহিতকে বলেন, ‘যে চলে বেড়ায়, ইন্দ্র তার সখা হন, তুমি বিচরণ করো’। পরের বছর ইন্দ্র আবার বললেন, ‘যে বসে থাকে তার ভাগ্যও বসে থাকে। যে শুয়ে থাকে তার ভাগ্যও শুয়ে থাকে। যে উঠে দাঁড়ায় তার ভাগ্য উঠে দাঁড়ায়। আর যে চরে বেড়ায় তার ভাগ্যও বিচরণ করে। অতএব তুমি বিচরণ কর’।

দীর্ঘকাল বিচরণ করতে করতে রোহিতের ভাগ্য সুপ্রসন্ন হলো। তার বাবা এবং তিনি বরুণের শাপমুক্ত হলেন।

জীবন মানেই যাত্রা। শৈশব থেকে যৌবনে, যৌবন থেকে বার্ধক্যে, স্থান থেকে স্থানান্তরে, কাল থেকে অন্য কালে, জগত থেকে জগতের ওপারে। মোক্ষ লাভের জন্য জীবনের এক-একটি স্তরের দাবি অনুযায়ী বিভিন্ন প্রস্থে যাওয়ার বিধান রয়েছে হিন্দু ধর্মে। পালি ভাষায় লিপিবদ্ধ বুদ্ধের বাণীতে  গৃহ থেকে গৃহহীনতায় যাত্রার কথা বলা হয়েছে। ইহুদি জাতি তো দেশে দেশে ঘোরাঘুরি করেই কাটিয়ে দিয়েছে সহস্র বর্ষ। খ্রিস্টান বা ইসলাম ধর্মেও বসে থাকার কথা নেই, বিচরণ করার কথা বলা আছে। মরমি সাধক, সাধু-সন্ত, আউল-বাউলেরা জীবনকে একটি অতিক্রান্ত নদীর মতো যাপন করেছেন পথ থেকে পথে; নিত্য বিচরণের স্রোতে। লালনও ভ্রমণ করেছেন অবিরাম। তবে সেটা নিজের ভিতরে, অন্তরাত্মার সন্ধানে, বাড়ির পাশের আরশিনগরে। রবীন্দ্রনাথও আত্মভ্রমণে ক্লান্তিহীন। বলেছেন, ‘আপনাকে চিনা আমার পুরিল না’।

ধর্ম বা দর্শনই শুধু নয়, জীবনের প্রয়োজনে বিচরণশীলতার অন্ত নেই মানব বংশের ইতিহাসে। এখনেই চলে আসে অভিযাত্রা শব্দটি।  

স্কট গিয়েছিলেন দক্ষিণ মেরু অভিযানে। সব কিছুই স্কটের যাত্রার প্রতিকূল ছিলো। অর্থ-সম্বল থেকে আবহাওয়া, সবই বিরুদ্ধচারী। স্কট ব্যর্থ হয়েছিলেন আপাত দৃষ্টিতে। কিন্তু সেই ব্যর্থ ও করুণ অভিযানটিও লাভ করেছে একটি মহৎ মর্যাদা। অ্যাপস্লে চেরিগারাড-এর বিখ্যাত বই দ্য ওয়র্স্ট জার্নি ইন দ্য ওয়ার্ল্ড যারা পড়েছেন, তারা জানেন সেইসব কথা। স্কট মৃত্যুশয্যা থেকে লিখে গিয়েছিলেন জগৎ-বিখ্যাত একটি চিঠি। কী দুর্বিসহ কষ্টের মধ্যে দিয়ে তিনি এই অভিযানে গিয়েছিলেন, তার খানিকটা ছাপ পাওয়া যায় ওই চিঠির উদ্ধৃতির ভিতরে। মানুষ প্রয়োজনে কতো কষ্ট সহ্য করতে পারে, পরস্পরের প্রতি কতো গভীর আস্থার প্রকাশ ঘটিয়ে দুর্বিসহ যাত্রার মধ্যেও একত্রিত থাকতে পারে— স্কটের চিঠি সেই বিবরণ জানিয়ে গেছে। দক্ষিণ মহাদেশের যে অংশে স্কটের জাহাজডুবি হয়েছিল, এখন অনেক আধুনিক ব্যবস্থাপনাগত নিরাপত্তার মধ্যে সেইখানে গিয়ে সাধারণ মানুষ তো বটেই, অভিযাত্রীরাও থমকে উঠেন; ভয়ে শিহরিত হন। অথচ কোনো শিহরণ, ভয়, পিছুটান স্কটকে দমাতে পারেনি, শত বিরূপতা আর সীমাবদ্ধতা থামাতে পারেনি স্কট এবং তার দুঃসাহসী সঙ্গী দলের বিচরণ, যাত্রা কিংবা অভিযাত্রাকে।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অন্তিম সময়ের কথা। তখন জার্মান সৈন্যবাহনী পিছু হটতে আরম্ভ করেছে। মিত্রশক্তি চতুর্দিক থেকে এগিয়ে আসছে। পশ্চাৎপদরত জার্মান সৈন্যরা তাদের বন্দিদেরও সঙ্গে নিয়ে চলেছে। বন্দিদের প্রাণের কোনো মূল্য নেই জার্মান হানাদার বাহিনীর কাছে। মিত্রপক্ষ এগিয়ে এলে জার্মান বাহিনী পরাজয় স্বীকার করবে, বন্দিরা হয়তো মুক্তি পাবে। এই আশায় যাত্রা করছে বন্দিরাও। একই যাত্রার কী ভীষণ পার্থক্য। বন্দিরা খেতে পায় না ভালো করে, হাঁটবার শক্তি নেই, ভালো করে ঘুমাতে পারে না, একটি ছোট ক্যারাভানে ঠাসাঠাসি করে রাখা হয়েছে তাদের। তবু চোখ চকচক করে বন্দিদের মুক্তির সম্ভাবনায়। মাটি কাঁমড়ে সম্ভাবনার দিকে তারা যাত্রা শুরু করে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বহু ইহুদি বন্দি লিখে গেছেন মৃত্যুর মাঝখান দিয়ে যাত্রা করে জীবনে ফিরে আসার কাহিনী।

রবিন ডেভিডসন সম্পাদিত ও নয়াদিল্লির পিকাডর প্রকাশনী কর্তৃক প্রকাশিত জার্নিস গ্রন্থে নতুনভাবে উঠে এসেছে প্রাগৈতিহাসিক ও ঐতিহাসিক মহাসময়কালকে আবর্ত করা নানা জীবন-ঘনিষ্ঠ ভ্রমণের উপাখ্যান: ভ্রমণ, যাত্রা, অভিযাত্রা আর চরৈবেতির বাতাবরণে। বই সম্পর্কে রাসকিনের একটি নোট বা টীকা উল্লেখ করা হয়েছে। রাসকিন বলেছেন, ‘যে বই পড়ে মনে হবে, আহা, আমিও তো এমনই ভেবেছিলাম, সে বই আদৌ মূলবান নয়। অন্যপক্ষে যে বই পড়ে পাঠকের মনে হবে, আশ্চর্য, এমনটা তো আমি আগে কখনও ভাবিনি, বইটা পড়ে নতুন এক ভাবনার দ্বার খুলে গেলো— সেই বই মূল্যবান’। জার্নিস হলো রাসকিন বর্ণিত মূল্যবান বই-এর একটি।

জার্নিস-এর সঙ্গে তুলনা করা যায়, নোবেলজয়ী অরহান পামুকের উপন্যাস স্নো-এর। বাংলা করলে, যার নাম দাঁড়ায় তুষার। তুর্কি ভাষা থেকে ইংরেজিতে অনুদিত ভাষ্য পাঠে জানা যায়, কাহিনীটি সমকালের। স্থান ও পাত্র-পাত্রীরা অপরিচিত। ঘটনার স্থান তুরস্কের প্রত্যন্ত প্রদেশের নাম না-জানা একটি ছোট শহর। দুর্গম স্থান, তদুপরি শীতকালের অবিরাম তুষারপাতে আচ্ছন্ন। পথে লোকজন নেই। সর্বদা আলো-আঁধারির আবহ। সেখানে আলোও যেনো শীতার্ত-সঙ্কুচিত, ম্রিয়মানভাবে টিমটিম করছে। এই রকম একটি প্রায়োন্ধকার প্রেক্ষাপটটিও কিন্তু অস্থির; সমাজ জীবন অশান্ত। এই পটভূমিতে দেখা যায় অন্ধ গোঁড়ামি আর কুপমণ্ডুকতাও অন্ধকারের সহযোগী হয়ে সবকিছু আড়াল ও আচ্ছন্ন করছে। বিপন্ন মানুষগুলো অচলায়তন ভেঙে আলো ও আধুনিকতার অভিমুখে যাত্রা করার জন্য সতত সংগ্রাম করছে। ভ্রমণ, যাত্রা, অভিযাত্রা আর চরৈবেতির বাতাবরণে ফুটে উঠেছে জীবন সংগ্রামের এক অনবদ্য শিল্পিত-ভাষা-চিত্রকলা ও পরিবর্তনের রূপকল্প।

ভ্রমণ, যাত্রা, অভিযাত্রা আর চরৈবেতির বাতাবরণে সংগ্রামশীলতার সাম্প্রতিক একটি চিত্র পাওয়া যায় দক্ষিণ আমেরিকায়, পের্তো আলেগ্রে নামক একটি শহরে। পোর্তো আলেগ্রে পর্তুগিজ শব্দ। কথাটির মানে হলো সুখী বন্দর। পোর্তো আলেগ্রে দক্ষিণ ব্রাজিলের একটি শহর। ব্রাজিল ছাড়া দক্ষিণ আমেরিকার অন্য সব দেশের ভাষা স্প্যানিশ। কারণ, দেশগুলো ছিল স্পেনের উপনিবেশ আর ব্রাজিল ছিলো পর্তুগালের দখলে।
পৃথিবীর মানুষ এই বন্দর-শহরটির নাম জানে এ কারণে যে, ২০০১ সালে এখানেই জন্ম নিয়েছিল ‘ওয়ার্ল্ড সোস্যাল ফোরাম’। পোর্তো আলেগ্রে ওয়াল্ড সোস্যাল ফোরামের জন্মস্থান হিসাবে বিশেষ উপযুক্ত। বহু মতের আলোচনা ও ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে মুক্তির পথ খোঁজার প্রচেষ্টা এই শহরে যতখানি হয়েছে, হয়ে চলেছে, সেটা আক্ষরিক অর্থেই অতুলনীয়। ইতালির ফ্লোরেন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের ইউরোপীয় ইতিহাসের শিক্ষক পল গিনসবর্গ মুক্তি ও গণতন্ত্রভিত্তিক অভিযাত্রার শ্রেষ্ঠ পরীক্ষাগার হিসাবে পোর্তো আলেগ্রেকে সনাক্ত করেছেন।

কেন! কী করেছেন এ শহরের নাগরিকরা! তারা দৈনন্দিন জীবনে গণতন্ত্রের পথে যাত্রা অব্যাহত রেখেছেন। তারা স্থির, নিচল হয়ে বসে থাকেননি, ইতিবাচক পরিবর্তনের দিকে বিচরণ করেছেন।  

‘পরিবর্তন’ শব্দটিও তাহলে এসে মিশে যাচ্ছে ভ্রমণ, যাত্রা, অভিযাত্রা আর চরৈবেতির সঙ্গে। নিজেকে বদলানো, নিজের পারিপার্শ্বকে বদলানো, সমস্যা ও সঙ্কুলতাকে বদলানোর জন্যও তো যাত্রারম্ভ করতে হয়। এতো ক্ষিপ্রগতির পরেও আমেরিকানরা আদর্শ হিসাবে নিলো ‘চেঞ্জ’ বা ‘পরিবর্তন’কেই। এ-ও তো এক চলিষ্ণু ধারা। রবীন্দ্রনাথ যেমন বলেছেন, ‘সময়ের পরিবর্তন হইয়াছে এবং হইয়াই থাকে। সেই পরিবর্তনের জন্য আমাদিগকে প্রস্তত হইতে হইবে। নহিলে আমাদের জীবন নিষ্ফল। নহিলে, মিউজিয়ামে প্রাচীনকালের জীবেরা যেমন করিয়া স্থিতি করিতেছে আমাদিগকেও ঠিক তেমনি করিয়া পৃথিবীতে অবস্থান করিতে হইবে। পরিবর্তনের মধ্যে যেটুকু সার্থকতা আছে, যেটুকু গুণ আছে, তাহা আমাদের খুঁজিয়া বাহির করিতে হইবে। কারণ, সেইখান হইতে রসাকর্ষণ করিয়া আমাদিগকে বাড়িতে হইবে, আর-কোন গতি নাই। যদি আমরা সত্যিই জলে পড়িয়া থাকি, তবে সেখানে ডাঙার মতো চলিতে চেষ্টা করা বৃথা, সাঁতার দিতে হইবে’।

ভ্রমণ, যাত্রা, অভিযাত্রা, চরৈবেতি, পরিবর্তন পায়ে হেঁটে না সাঁতার দিয়ে সম্পন্ন করতে হবে, নিজস্ব বাস্তবতার বিশ্লেষণে সিদ্ধান্তটি নিতে হবে। দেকার্তে বলেছেন, ‘আমি চিন্তা করি। তাই আমার অস্তিত্ব আছে’। আর অস্তিত্ব থাকলে ভ্রমণ, যাত্রা, অভিযাত্রা, চরৈবেতি, পরিবর্তন— অন্দরে আর বাহিরে চলতেই থাকবে।  

সামাজিক মানুষের ইতিহাস-বিশ্লেষক তপন রায় চৌধুরী গুরু মেনেছেন আরেক নমস্য ঐতিহাসিক স্যার যদুনাথ সরকারকে। গুরুর কাজকে চিহ্নিত করেছেন, It’s like traveling. A traveling with an interest that’s curious as well as sensitive to completely unfamiliar things. What it felt like to be therewith mental world of people in the past. An unfamiliar territory, unfamiliar human beings, to whom you have some access through your cultural world of knowledge. 

ইতিহাস অন্বেষণও একটি ভ্রমণের বিষয়। হারিয়ে যাওয়া অতীত, মানুষের মনন আর মানসিকতার ভিতরে ভ্রমণ করে তুলে আনা গতিশীল লক্ষ্যন ও প্রপঞ্চ। কিন্তু গবেষকের সেই পরিভ্রমণ মানব গতিশীলতার অভিমুখী। স্থির, অচল, অগতির মানুষ কোনো ঐতিহাসিক বিশ্লেষণের গুরুত্বও দাবি করতে পারে না।

তার মানে কী সাঙ্ঘাতিক? যাদের মধ্যে গতি তথা ভ্রমণ, যাত্রা, অভিযাত্রা, চরৈবেতি, পরিবর্তন নেই, তারা ইতিহাসের মধ্যেও গৃহীতই হয়নি।

বাংলাদেশ সময়: ১৪২৪ ঘণ্টা, এপ্রিল ১৮, ২০১৭
এসএনএস 

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।