খ্রিস্টপূর্ব ২৬০০ সালে প্যাপিরাসের ব্যবহার, ১০৫ খ্রিস্টাব্দে চীনের হান সম্রাটের কাছে সভাসদ ৎসাই লুন-এর কাগজ ব্যবহারের প্রস্তাব এবং ৩০০-৪০০ খ্রিস্টাব্দে প্যাপিরাসের পরিবর্তে পার্চমেন্ট ব্যবহার থেকে শুরু করে প্রকাশনা-প্রযুক্তির সাম্প্রতিকতম ধাপগুলো, ছাপা, বাঁধাইয়ের ইতিহাস সৃষ্টির আনন্দে ভরপুর। একেকটি বইয়ের জন্ম মানে একটি নতুন শিশু বা জীবনের সৃষ্টি।
ইতিহাস থেকে বলতে পারি, পৃথিবীর প্রথম ভাবনাটি হয়তো লেখা হয়েছিলো কোনো এক প্রাচীন গুহার পাথুরে দেয়ালে। পরবর্তীকালে চিন্তা-চেতনার প্রবহমানতার পাশাপাশি লিপি ও প্রযুক্তির বিবর্তন মানুষের জ্ঞানচর্চাকে ক্রমশ এগিয়ে নিয়ে গেছে। আমরা ‘শ্রুতি’র যুগ পেরিয়ে এসেছি। তারপর গৃহস্থের গোয়ালঘরের মাচান থেকেও অগুন্তি মধ্যযুগের পুঁথিপত্র এসে জমা হয়েছে মোহাফেজখানায়, গ্রন্থাগারে। প্রাচীনকাল থেকে আজ অবধি পৃথিবীর নানান প্রান্তে স্থাপিত গ্রন্থাগারের সঞ্চিত সম্পদও কম নয়। আবার জ্ঞানান্বেষীরা এখন আন্তর্জাল বা ইন্টারনেটেও চক্ষুষ্মান। মানুষের অনুসন্ধিৎসু চোখ তাকিয়ে রয়েছে আকাশ, মহাকাশ, মহাশূন্য, এমনকি পাতালেও। তার মানে, মানুষ দেখতে চায়, পড়তে চায়। মানুষকে ঘিরে রয়েছে পাঠ, পুস্তক ও পাঠাগারের বৌদ্ধিক বলয়। হয়তো পাঠের ধরন বদলেছে, পুস্তকের আঙিক পাল্টাচ্ছে, পাঠাগারের রূপান্তর ও অগ্রগতি হচ্ছে, দুর্দশা বাড়ছে। তথাপি, মানুষ দেখতে ও পড়তে ভুলে গেছে, এ কথা কখনও সত্য নয়। এ কারণে জার্মানির গুটেনবার্গ থেকে বাংলার পঞ্চানন কর্মকার অদ্যাবধি স্মরণীয়। স্মরণীয় হ্যালহেড, উইলকিনস এবং আরও বহু নমস্য মানুষ।
ইতিহাসের ধারায় এটাও ঠিক যে, বাংলাদেশে বৌদ্ধিক চেতনা ও সাংস্কৃতিক ইতিহাসের সংরক্ষণের অপ্রতুলতা নিয়ে আক্ষেপের শেষ নেই। তবু কিছু কিছু কাজ চোখ কাড়ে। মোফাখখার হুসেইন ইংরেজিতে বাংলা বই ছাপা ও প্রকাশের বিস্তারিত ইতিবৃত্ত রচনা করেছেন দুই খণ্ডে। বাংলা একাডেমি ২০০০ সালে The Bengali Book: History of Printing and Book Making নামে বইদ্বয় প্রকাশ করে। গৌতম ভদ্র বাংলা পুথি থেকে আধুনিক বাংলা বইয়ের বিষয়ে দীর্ঘ আলোচনা করেছেন। গৌতমমভদ্র-এর বইটির নাম বেশ চমকপ্রদ, ন্যাড়া বটতলায় যায় ক‘বার? কলকাতা থেকে ২০১২ সালে প্রকাশ করেছে ছাতিম বুকস। তার ভাষায়, বই-টই, এই প্রাকৃত বাংলা শব্দের পূর্ণ ব্যঞ্জনা সন্ধান জরুরি কাজ। এই জোড়া শব্দ মোটেই অর্থহীন নয়। গৌরচন্দ্রিকা ও নিদের্শিকা পেরিয়ে গৌতমের বইটির তিনটি অংশ: নিবন্ধ, মহাফেজখানা প্রসঙ্গ এবং পড়া ও দেখাকে ঘিরে একটি অংশ। অখণ্ড বাংলার মুদ্রণ ও পঠন-পাঠন সংস্কৃতি নিয়ে কাজটির মূল অভিমুখ বর্তমান ভারতের পশ্চিমবঙ্গ।
বঙ্গদেশের বই ও প্রকাশনা নিয়ে আদি গবেষক জেমস লঙ-এর উত্তসূরী হিসেবে অনেকেই কাজ করেছেন এবং করে চলেছেন। পশ্চিমবঙ্গে যতীন্দ্রমোহন ভট্টাচার্য, শিবদাস চৌধুরী, সুকুমার সেন, গীতা চট্টোপাধ্যায় থেকে হাল আমলের স্বপন চক্রবর্তী, স্বপন বসু, আশীষ খাস্তগীর, অভিজিৎ সরকারের নাম করা যায়। বাংলাদেশে যারা কাজ করছেন, তারা ঢাকার মুদ্রণ ও প্রকাশনা শিল্পের পাশাপাশি উনিশ শতকের বাঙালি মুসলমানের চিন্তা-চেতনার ইতিহাস কথকের ভূমিকা পালন করেছেন। এক্ষেত্রে আনিসুজ্জামান, ওয়াকিল আহমদ, মুনতাসীর মামুন, ফজলে রাব্বি, মফিদুল হক, মোহাম্মদ সা’দাত আলী অগ্রগণ্য।
শুধুমাত্র সমকালীন বিষয়ে না মজে পুরাতন বইয়ের চর্চায় ব্যাপৃত ছিলেন বিদ্যাসাগর-বঙ্কিম-সজনীকান্ত, রামদাস সেন, খগেন্দ্রনাথ মিত্র, আশুতোষ মুখোপাধ্যায়, সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়, চিত্তরঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়, বিনয় ঘোষ, শ্রীপান্থ এবং বাংলাদেশে আবদুর করিম সাহিত্যবিশারদ প্রমুখ গুণীজন। সে উত্তরাধিকার ক্ষীণ হলেও এখনও বহমান। পুরাতন বইয়ের গুরুত্ব বুঝেছিলো ইংরেজরাও। তারা জানতেন, সমাজ-সংস্কৃতি আর মানুষের ভাষ্য বহন করে বই। কালের দর্পণ স্বরূপ উদ্ভাসিত করে হারানো অতীত। জেমস লঙ বিভিন্ন সময়ে বইপত্রের যে তালিকা দিয়েছিলেন, পর্যবেক্ষণ করলে তা থেকে যেমন তৎকালীন সমাজ-সংস্কৃতি-পাঠাভ্যাস-বিষয়-রুচি ফুটে ওঠে, তেমনি পুরাতন বইয়ের বিজ্ঞাপন বাঁধাই, বিপণন, মুদ্রণ প্রযুক্তিরও এক ভিন্ন ইতিহাসের জানান দেয়। একসময় হিন্দু ধর্মগ্রন্থের বিজ্ঞাপনে জানানো হতো যে, এই গ্রন্থ অমুক যন্ত্রে মুদ্রিত ও হিন্দু ব্রাহ্মণ দ্বারা গঙ্গাজলে শোধিত। আরেকটি উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে। ১২৬৫ বঙ্গাব্দে (১৮৫৮ খ্রিস্টাব্দ) গৌরীশঙ্কর তর্কবাগীশ তার অনুদিত পুস্তকের বিজ্ঞাপনের লিখেছিলেন, ‘চণ্ডী মুদ্রাঙ্কণ কালে অনেক ব্যাঘাত হইয়াছিলো , যে সকল ব্রাহ্মণ দ্বারা কম্পোজ করাইয়াছি তাহার দিগের প্রতিজনের প্রায় সাংঘাতিক প্রীড়া হইয়াছিলো । আমি স্বয়ং অনেক দুঃখ পাইয়াছি, শয্যাগত হইয়াও শোধনাদি করিয়াছি, চণ্ডী ছাপাকালে অস্পৃশ্য স্পর্শ হয় নাই, শূদ্র দ্বারা গৃহে কালি প্রস্তুত করাইয়াছিলাম, শূদ্রেরা ছাপিয়াছে, পবিত্র বেষ্টন দ্বারা পুস্তক বন্ধন করাইলাম’। (পুরাতন বানান অপরিবর্তিত)। অপূর্ব সাহা (সম্পা.), থির বিজুরি (পুরোনো বই সংখ্যা), কলকাতা, অক্টোবর-ডিসেম্বর, ২০১৩ সংখ্যায় এমন আরও অনেক বিবরণ রয়েছে।
আবার ১২৬২ বঙ্গাব্দে প্রকাশিত রামধন রায়ের কলি-চরিত গ্রন্থের প্রকাশক কাজী সফীউদ্দীন এক প্রকারের ধমকের সুরে বিজ্ঞাপন দিয়েছিলেন, ‘সর্ব্বসাধারণকে অবগত করা যাইতেছে, যে কলি-চরিত গ্রন্থ আমি রীতিমত গবর্ণমেন্টের হোম ডিপার্টমেন্টে রেজিষ্টারি করিয়া লইয়াছি। অতএব, কোন ব্যক্তি ইহা পুনর্মুদ্রিত করিলে সমুচিত দণ্ড পাইবেন। আর আমার নামাঙ্কিত মোহর ব্যতীত কেহ এই গ্রন্থ ক্রয় করিবেন না’। ১৮৬৫ সালে ব্যক্তিগত উদ্যোগে নিজের বই ছেপেছিলেন মুন্সী শামসুদ্দিন। মাত্র বত্রিশ পাতার পুস্তিকাটির মুখবন্ধে রয়েছে মজার বিবরণ ও নকল পুস্তক সম্পর্কে সাবধানবাণী।
বুক পাইরেসির রমরমার সময়ে দাঁড়িয়ে অতীত বিজ্ঞাপন পাঠে প্রকাশনার তৎকালীন পরিস্থিতিও আঁচ করা সম্ভব। এছাড়াও পুরাতন বই-চর্চাই আমাদের জানিয়ে দিতে পারে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের বাণিজ্যবোধ, দাদাঠাকুরের বইফেরি (মাথায় ঝাঁকা নিয়ে গ্রামেগঞ্জে বই ফেরিওয়ালাদের কথা জেমস লঙ জানিয়েছেন। তাদের হাঁকডাক রাধাপ্রসাদ গুপ্ত-র গবেষণা গ্রন্থ কলকাতার ফিরিওয়ালার ডাক ও রাস্তার আওয়াজ-এ ঠাঁই পেয়েছে), দু®প্রাপ্য বই সংরক্ষণে রবীন্দ্রনাথের ভূমিকার কথা। ভাষাচর্চার বাইরে সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় পুরাতন পুস্তক ব্যবসায়ীদের রক্ষাকর্তার ভূমিকা পালন করেছিলেন।
দুই প্রতিভাবান ইউরোপীয়ের কথা বাংলা পাঠ, পুস্তক, পাঠাগার ও প্রকাশনা প্রসঙ্গে আসবেই। দু’জনের বয়সও প্রায় সমান সমান। একজনের জন্ম ১৭৪৯ বা ১৭৫০ সালে। আরেক জনের ১৭৫১। প্রথমজনের নাম চার্লস উইলকিনস, দ্বিতীয়জন হলেন নাথানিয়েল ব্রাসি হ্যালহেড। দু’জনেই প্রায়-সমসময়ে ভারতে এসেছিলেন; দু’জনেরই কর্মক্ষেত্র ছিলো একইÑঔপনিবেশিক শক্তির আদি চারণভূমি তথা বঙ্গদেশ। উইলকিনস এদেশে এসেছিলেন ১৭৭০ সালে। দু’ বছর পর ১৭৭২ সালে আসেন হ্যালহেড। তাদের দু’জনের পরিচয় এই বঙ্গভূমিতেই, পরিচয় থেকে বন্ধুত্ব। সেই বন্ধুত্ব ক্রমশ প্রগাঢ় হয়ে ওঠে একটি বইয়ের সূত্রে। বইটির নাম A Grammar of the Bengal Language। পণ্ডিত মহলে বইটি এইখ নামে পরিচিত। আর সাধারণ মানুষের কাছে বইটির পরিচয় ছিলো ‘হ্যালহেডের গ্রামার’ নামে। বইটির লেখক হলেন হ্যালহেড। আর এই বইয়ে মুদ্রিত বাংলা বাংলালিপির গড়নগুলোর স্রষ্টা উইলকিনস। এই একটি মাত্র গ্রন্থের সূত্রে এই দুই বিদেশি যুবক যে একদিন বাংলা ভাষার ইতিহাসে ও বাংলা মুদ্রণের ইতিহাসে পথিকৃৎ রূপে বিবেচিত হবেন, সেদিন হয়তো তারা তা জানতেনও না। কারণ পথিকৃৎ হওয়ার স্বপ্নবিভোরতা তাদের ছিলো না। ছিলো প্রবাসী ইউরোপিয়ানদের উপকার করার ইচ্ছা। আর ছিলো প্রাণের তাগিদ, ভালোবাসার গরজ। হ্যালহেড অভিজাত, প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় শিক্ষিত। কিন্তু উইলকিনস তেমন নন, প্রাতিষ্ঠানিক তেমন কোনো শিক্ষাই তার ছিলো না। অথচ এই উইলকিনস-ই অধ্যবসায়ের জোরে ইংরেজিতে অনুবাদ করেছেন হিন্দু ধর্মের বহু বইÑ ভাগবতগীতা, হিতোপদেশ এবং শকুন্তলার গল্প। ইংরেজি ভাষায় লিখেছেন সংস্কৃত ভাষার ব্যাকরণ। তিনিই সম্ভবত প্রথম ইউরোপিয়ান, যিনি গীতা অনুবাদ করেছেন এবং সংস্কৃত ভাষার ব্যাকরণ লিখেছেন। এছাড়াও তিনি কুটিল লিপির পাঠোদ্ধার করে গুপ্তযুগের ব্রাহ্মীলিপির পাঠোদ্ধারের দরজা খুলে দিয়েছিলেন। হ্যালহেড ও উইলকিনস, দু’জনেই ছিলেন অসাধারণ পরিশ্রমী, অনুসন্ধিৎসু ও প্রতিভাবান। বাংলা ভাষাচর্চা ও বাংলা মুদ্রণের ইতিহাসে এই দুই ইউরোপিয়ের অবদান চিরকাল অম্লান হয়ে থাকবে। তারা জীবিত থাকবেন প্রথাগত বইয়ের সঙ্গে।
কিন্তু আধুনিক প্রথাগত বই এখন হুমকির মুখে। সেই সূত্রে পাঠাগারও বিপদাপন্ন। কিন্তু কেন? কারণ প্রযুক্তি। সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে ছাপানো বইয়ের বদলে নতুন পৃথিবীর উপযোগী ডিজিটাল বই-এর। যার নাম ই-বুক।
‘ই’ হয়ে যাচ্ছে সব। চিঠি থেকে কেনাকাটা, ব্যাঙ্কিং, শুভেচ্ছা-আমন্ত্রণপত্র এবং বই বা বই পড়া, সব কিছুই ‘ই’ মাধ্যমের অধীন। এরই মাঝে পাল্টে গেছে পরিচিত বহু শব্দের অর্থও। আইসক্রিম, স্যান্ডউইচ, জেলিবিন, ললিপপ জাতীয় খাদ্যসম্ভারের ইঙ্গিতবহ নাম যে ফোনের রকম হতে পারে, এ আর কবে কে ভেবেছিলো। উইনডোজ ঢুকে পড়েছে ফোনে। ফোনের আরেক নাম এখন ‘স্মার্ট’। ট্যাবলেট বলতে কেউ আর ওষুধের বড়ি বোঝে না। অ্যাপ্লিকেশন হয়েছে অ্যাপস। অনলাইন, আপলোড, লাইক, হিট বা শেয়ার শব্দগুলোর মাহাত্ম্য এখন প্রবল ও বহুমুখী। সেলফ পোর্ট্রেট হয়ে গেছে সেলফি। দাবানলের চেয়েও দ্রুততায় ছড়িয়ে পড়ছে একেকটি পরিবর্তন ও সংযোজন। এসবের নেপথ্যে কে? তথ্য প্রযুক্তির বিপ্লব এবং অবশ্যই গ্লোবালাইজেশন। বিশ্বায়নের সূত্র ধরেই ‘ই’-এর প্রভাব বিস্তার। এর অস্তিত্ব অস্বীকারের কোনো উপায় নেই। তবে কিঞ্চিত ভাবনার অবকাশ আছে; দরকারও আছে। ট্যাব-অ্যাপস-এর জগতে মেতেছে বিশ্বের মানুষ। কেউ কেউ হয়ে যাচ্ছেন ‘গ্যাজেট-ফ্রিক’। ফ্রিক বললেই চিন্তার উদ্রেগ হয়। মনে হয় মাথার রোগ। এ রোগ ছড়াচ্ছে বইয়ের পাতাও। বই হয়ে যাচ্ছে ই-বুক।
কিন্তু ছাপানো বই বা গ্রন্থ ছাড়া গ্রন্থাগারের কথা কল্পনাও করা যায় না। সে গ্রন্থ বা বইই যদি অস্তিত্বের সঙ্কটে নিপতিত হয়, তাহলে গ্রন্থাগারের অস্তিত্বই বিপন্ন হতে বাধ্য। বিশেষত একুশ শতকের প্রযুক্তিগত চরম উৎকর্ষতায় ছাপানো গ্রন্থের ভবিষ্যৎ নিয়ে একটি আশঙ্কার ছায়া দেখতে পাওয়া গেছে। বলা হচ্ছে, পৃথিবী পুরোপুরি ডিজিটাল সিস্টেমের চলে এলে ছাপানো বই-পুস্তকের দিন শেষ হয়ে যাবে। কিন্তু তারপরেও বিবর্তিত ভবিষ্যতে বেঁচে থাকবেই গ্রন্থ, গ্রন্থাগার আর নিমগ্ন পাঠ। হয়ত আঙ্গিকগত পরিবর্তন হবে, তবুও বিশ্ব ও সভ্যতা যতদিন থাকবে, গ্রন্থ, গ্রন্থাগার এবং মানুষের পাঠচর্চা থাকতেই হবে। মানব সভ্যতার সুদীর্ঘ ইতিহাস এমন কথাই বলেছে। চিন্তা ও বিবেকের অধিকারী মানব প্রজন্ম পাঠহীন জগতে বসবাস করতে পারবে না।
বর্তমানে আমরা যেরূপ বই বা গ্রন্থ সম্পর্কে আলোচনা করছি বা কথা বলছি, সে ছাপানো পুস্তকের বয়স চার শত বছর। তার আগে ছিলো হাতে লেখা পাণ্ডুলিপি। আরও আগে মাটির চাকতির বই। এসবের বহুল প্রচার সম্ভব ছিলো না। ছাপাখানা বা প্রেস আবিষ্কারের পর পৃথিবীর অনেক ভাষাতেই সাহিত্যের নানা শাখায় ব্যাপক কাজ হতে থাকে। মুদ্রিত বই প্রচুর সংখ্যায় ছড়িয়ে পড়ে ব্যাপক সংখ্যক মানুষের মধ্যে। বহুবছর এমনভাবে চলার পর বিংশ শতাব্দীর শেষ দিকে এসে পড়লো ডিজিটাল যুগ। এখন প্রকাশক ও পুস্তক বিক্রেতাদের মাধ্যম ছাড়াই একজন লেখকের রচনা সরাসরি পাঠকের কাছে পৌঁছে যেতে পারে। পশ্চিমি দেশগুলোতে তা শুরু হয়ে গেছে; ঝাপ্টা লেগেছে এদেশেও। কোনো কোনো প্রকাশক এখন শুধু ই-বই বের করছে। কিছু প্রসিদ্ধ পত্রিকা ছাপানো সংস্করণ প্রকাশ বন্ধ করে ই-সংস্করণ বের করছে।
এটা সম্ভব হয়েছে নানা কারণে। পুস্তক মুদ্রণের জন্য যে বিপুল পরিমাণ কাগজের প্রয়োজন, তার জন্য ধ্বংস হয় প্রকৃতির বৃক্ষ সম্পদ; তাই কাগজ ছাড়াই ই-বুক তৈরি করা হোক, এমন দাবি অনেকেরই। এটাও এক ধরনের আশার কথা। চাকতি থেকে পাণ্ডুলিপি থেকে মুদ্রিত বই থেকে ই-বইÑসবই উৎকর্ষতা, উন্নয়ন ও প্রযুক্তির বিকাশের ফল। বইয়ের আকার-আকৃতি ও কাঠামোগত বিবর্তনের ভালো ও মন্দ, দু’টি দিকই থাকতে পারে। এর মধ্য দিয়েই বই এগিয়ে যাবে। আমরা যেমন পুথিকে শ্রদ্ধা করবো ও ভালোবাসবো, তেমনি কিন্তু পুথির যুগে থাকতে চাইবো না; সামনের দিকে এগিয়ে যাবো। বই-ও এভাবেই এগিয়ে চলেছে। এখনও যে মানুষ ই-বই সম্পর্কে আগ্রহী হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পাণ্ডুলিপিও দর্শন করার সুযোগ পাচ্ছে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির বদৌলতে। ছাপার অক্ষরে বই পড়ার আনন্দ তো আছেই, কিন্তু চোখের সামনে যদি দেখা যায়, পছন্দের কোনো লেখার আঁকিবুঁকি, কাটাকাটি সমেত হাতে লেখা পাণ্ডুলিপি, তার মূল্য পাঠকের কাছে অন্যরকম হবেই।
ইংরেজি ভাষায় রোমান্টিক এবং ভিক্টোরিয়ান যুগের লেখকদের পাণ্ডুলিপি বা ম্যানুস্ক্রিপ্ট দেখার ব্যবস্থা করেছে ব্রিটিশ লাইব্রেরি তাদের ওয়েবসাইটের মাধ্যমে। জেন অস্টেন, এমিলি ব্রন্টি, চার্লস ডিকেন্স প্রমুখ লেখকের বইয়ের আদিরূপ এবার চোখের সামনে। প্রেসে ছাপার জন্য যে লেখা তৈরি করা হতো, সেই ফেয়ার কপি নয়, একেবারে খসড়া অবস্থাতেই দেখা যাবে বিখ্যাত লেখকদের নিজের হাতে তৈরি শব্দ-অক্ষরগুলো। যেমন, ওয়েবসাইট দেখাচ্ছে, এমিটি ব্রন্টির ডায়েরির ২৬ জুন ১৮৩৭ তারিখের একটি পৃষ্ঠায় লেখকের হস্তাক্ষর, চিত্র, নোট ইত্যাদি। সংরক্ষণের এমন বোধ বাংলাদেশে হবে? কবে?
তবে নানা আশার মধ্যেও বই বাস্তবিক বিপদে পড়ছে কয়েকটি দিক থেকে। যেমন, পাঠাভ্যাস কমে যাওয়া; বই কেনার প্রবণতা হ্রাস পাওয়া, পাঠাগারের অব্যবস্থা ইত্যাদি। একদা নিয়ম করে কোনো কোনো নির্বাচিত বা বিষয়ভিত্তিক বই মানুষ পড়তেন। এখন সময়ের স্বল্পতায় পাঠে মন দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না অনেকের পক্ষেই। আবার নানা অনুষ্ঠানে-উৎসবে বই উপহার দেওয়ার একটি রেওয়াজ ছিলো। এখন সেটাও নেই। তাই কমছে বইয়ের কেনা-বেচা।
এরই মাঝে আশা জাগাচ্ছে, বাৎসরিক বইমেলা। তখন বইপাড়ায় সাজ সাজ রব ওঠে। পাঠক, লেখক, প্রকাশক জেগে উঠে। বইকেন্দ্রিক এক ধরনের উচ্ছ্বাস নগরের নাগরিককে আলোড়িত করে। সবাই মেলায় ছোটেন। অধিকাংশের হাতেই নিদেন পক্ষে রোগা-পাতলা গোছের একটি বই হলেও থাকে। প্রসঙ্গত উল্লেখ করা যায়, বিখ্যাত ব্রাজিলীয় লেখক ওসমান লিনস-এর একটি উক্তি। তিনি বলেছিলেন, ‘‘অধিকাংশ ক্ষেত্রেই মানুষের জ্ঞান আহরণের মাধ্যম একটি রেক্টঙ্গল। কথাটি কত সত্য। দৃষ্টি মূলত একটি চতুর্ভূজ ফ্রেম মেনে চলে। একটি জানালা, একটি বই, একটি টিভি, একটি কম্পিউটারÑএসবই কম-বেশি সমকোণী-চতুর্ভূজ বা রেক্টঙ্গল। বই, ই-বই, যে নামেই ডাকা হোক, মানুষকে থাকতে হবে জ্ঞানের একটি চতুর্ভূজকে নিয়েই। এসব জানতে পড়া যেতে পারে কলকাতার মিত্রম প্রকাশনী থেকে ২০১৩ সালে প্রকাশিত ড. তারকনাথ ভট্টাচার্য প্রণীত গ্রন্থাগারে কম্পিউটারের প্রয়োগ নামের বইটি।
এটা ঠিক যে, বইপড়া হ্রাস আর বিশ্বায়ন ও তথ্য-প্রযুক্তিগত আগ্রাসী বিপ্লবের সঙ্কুল এই সময়ে গ্রন্থ ও গ্রন্থাগার ক্রমেই প্রান্তিক অবস্থানে চলে আসছে এবং মানুষের মধ্যে প্রযুক্তির ব্যবহার, যেমন টিভি, ইন্টারনেট, আইফোনে বসার হার বাড়ছে। অতএব প্রশ্ন দেখা দিচ্ছে, গ্রন্থাগার শব্দটি কতদিন বেঁচে থাকবে এবং গ্রন্থ বা বই-এর আয়ুই বা কতদিন? প্রযুক্তি বিশ্বের ই-বুক এবং সাইবার অঙ্গনের ভার্চুয়াল জগত কি গ্রাস করবে কালি, কলম, কাগজে মোড়ানো গ্রন্থ সম্ভার? আমরা প্রত্যয় ব্যক্ত করেছিলাম যে, বিশ্বায়নের বৈশ্য পৃথিবীর দ্রুতলয় প্রবাহ এবং ইন্টারনেট ও তথ্য-প্রযুক্তি গ্রন্থ বা গ্রন্থাগারকে অপ্রয়োজনীয় বিষয়ে পরিণত করে খারিজ করতে পারবে না। এজন্য অবশ্যই গ্রন্থাগারের প্রযুক্তিগত উন্নতি ও বিকাশের প্রয়োজনীয়তাও একই সঙ্গে লক্ষ্য করতে হবে।
এবার আরেকটি সমীক্ষার কিছু তথ্যের উল্লেখ করছি। ২০০৮ সালে জাতিসংঘ সংস্থা ইউনেস্কো-এর সহায়তায় ভারতের পশ্চিমবঙ্গের রাজধানী কলকাতায় একটি ‘পাইলট স্টাডি’ হয়। পরে ৫০ জন গবেষণা সহকারীকে নিয়ে পুরো কলকাতা মহানগরীতে ‘ফিল্ডস্টাডি’ করা হয়। গবেষণার বিষয় ছিলো, বিশ্বায়ন ও প্রযুক্তির একবিংশ শতকে ‘পাঠস্পৃহা ও পাঠরুচি’। গবেষণার আওতায় মহানগরকে বাগবাজার, শ্যামবাজার, হাতিবাগান অঞ্চল; ভবানীপুর, রাসবিহারী, ল্যান্সডাউন, বালিগঞ্জ, গড়িয়াহাট অঞ্চল, বালি, উত্তরপাড়া, কোন্নগর অঞ্চলÑ এভাবে কয়েকটি অঞ্চলে ভাগ করে সেসব অঞ্চলের মানুষের পাঠস্পৃহার হিসাব নেওয়া হয়েছে। গ্রন্থাগার ধরে ধরে দেখানো হয়েছে, কোন গ্রন্থাগারে প্রতিদিন কতজন মানুষ পড়েন। তাদের বয়স ও পেশা কী? তাদের পাঠ-আগ্রহের বিষয়গুলো কি? সমীক্ষা শেষে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া সম্ভব হয়েছে যে, কলকাতায় পুরুষদের তুলনায় মেয়েরা বেশি গ্রন্থাগারমুখী। পাঠিকাদের পছন্দ অনুসারে আশাপূর্ণা দেবী সবচেয়ে জনপ্রিয় লেখক। এরপরে জনপ্রিয়তার তালিকায় আসেন রবীন্দ্রনাথ। জন্মের সার্ধ-শতবর্ষে জন্মশহর কলকাতায় তিনি হয়েছেন দ্বিতীয়। তারপরের স্থান শরৎচন্দ্রের। পরবর্তী স্থান সুচিত্রা ভট্টাচার্যের। আধুনিককালের লেখকদের মধ্যে তিনিই প্রথম। বাংলা ভাষীদের কাছে জনপ্রিয় সুনীল, শঙ্কর, শীর্ষেন্দু, সমরেশের স্থান কলকাতার পাঠকদের পছন্দের তালিকার নিচের দিকে।
সমীক্ষায় আরও দেখা গেছে যে, সংবাদপত্রের পাঠ এখনও জনপ্রিয়তার শীর্ষে। ইউনেস্কো-এর এই সমীক্ষার শেষে মন্তব্য করা হয়েছে, ‘যত বিঘœই আসুক, মুদ্রিত বইয়ের অস্তিত্ব এবং গ্রন্থাগারের উপস্থিতি বহুদিন বজায় থাকবে। ’ ঊর্মি রায় চৌধুরী ‘দীপ্তিতে উজ্জ্বল এক লাইটহাউস’, (বইয়ের দেশ, কলকাতা: আনন্দ পাবলিশার্স প্রাইভেট লিমিটেড) শীর্ষক প্রবন্ধে গ্রন্থাগার/পাঠাগার সম্পর্কে এমনই আশাবাদের কথা বলেছেন।
সমীক্ষার সঙ্গে একমত না হওয়ার কারণ নেই। আশা জাগে যে, আজকের এই ডিজিটালের যুগে বইয়ের বাজারের তীব্র প্রতিযোগিতা সত্ত্বেও সনাতন মুদ্রিত বই এখনও টিকে আছে গ্রন্থাগারের প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর চৌহদ্দীতে। ফলে বইয়ের দোকান ও প্রকাশনা সংস্থাগুলিতে সরবরাহের তেমন অভাব নেই। কিছুদিন আগেও পুস্তকের বাজারের ব্যাপারে বিশেষজ্ঞরা সনাতন মুদ্রিত বইয়ের ইতি ঘটবে বলেই ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন। আজকের ডিজিটালের যুগে ইলেকট্রনিক বা ই-বইয়ের জয়যাত্রা যেভাবে বাড়ছে, তাতে ছাপা বইয়ের টিকে থাকা কষ্টকর হবে, এই ছিলো তাদের ধারণা। বাস্তবিকই এক্ষেত্রে চিত্রটা অনেক বদলেছে। বেশকিছু বইয়ের দোকান বন্ধ হয়ে গেছে। ছোট ছোট কিছু প্রকাশনা সংস্থাও বন্ধ হয়ে গেছে। কোনো কোনো সংস্থা মুদ্রিত বইয়ের পরিবর্তে সম্পূর্ণভাবে ই-বইয়ের দিকেই ঝুঁকেছে। তবে হতাশাব্যঞ্জক সব ধরনের ভবিষ্যদ্বাণী পুরোপুরি ফলেনি। এর পেছনে রয়েছে বিভিন্ন কারণ। অনেক বইয়ের দোকান ক্রেতাদের আকৃষ্ট করার জন্য সুচিন্তিতভাবে নানা কর্মসূচি নিয়েছে। প্রকাশনা সংস্থাগুলো যদি খ্যাতনামা লেখকদের লেখা এবং আকর্ষণীয় বিষয়বস্তু তুলে ধরতে পারে, তাহলে মুদ্রিত বইকে ভবিষ্যৎ নিয়ে তেমন চিন্তা ভাবনা করতে হবে না। এছাড়া বইকে নতুন রূপে সাজাতে হবে, যাতে তারা ই-বইয়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে পারে, হতে পারে বিকল্প। আর এসব পদক্ষেপ নিতে পারলেই চিরাচরিত মুদ্রিত গ্রন্থ তার ভবিষ্যতের ব্যাপারে অনেকটা নিশ্চিন্ত হতে পারবে। ইদানীং বইয়ের ডিজাইনের ব্যাপারে বিশেষ করে তরুণদের মধ্যে আগ্রহ বাড়ছে। এমন কথা বলেন গ্রন্থ শিল্প ফাউন্ডেশনের আলেক্সান্ড্রা সেন্ডার। ওফেনবাখের গ্রন্থ ও লিপিকলা মিউজিয়ামের পরিচালক স্টেফান সোলটেকও এই প্রবণতাটা লক্ষ্য করেছেন। তার ভাষায়, ‘আমি লক্ষ্য করেছি, বইয়ের নান্দনিক দিকটার প্রতি যেমন সাধারণ পাঠক তেমনি আইটি এবং গ্রাফিক বিভাগের লোকজনের আগ্রহ বাড়ছে’।
ভাগেনবাখ প্রকাশনা সংস্থার প্রধান সুসানে শ্যুসলার সযতেœ তৈরি বইয়ের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে আশাবাদী। কিছু কিছু গ্রন্থ শুধু মুদ্রিত আকারেই বের হতে পারে। বইয়ের দোকানগুলোতে এই প্রকাশনা সংস্থার টকটকে লাল রং-এর লিনেনের বাঁধাই করা বইগুলি চোখে পড়ার মতো। ‘আউফবাউ' প্রকাশনা সংস্থার ক্রিশ্চিয়ান ড্যোরিং পুস্তক সিরিজ ‘ভিন্ন ধরনের গ্রন্থাগার'-এর দায়িত্বে রয়েছেন ২০১১ সাল থেকে। ১৯৮৫ সাল, অর্থাৎ অ্যানালগের যুগ থেকেই এই সংস্থার বইয়ের সাজসজ্জা মানুষকে আকৃষ্ট করছে। দেশ পত্রিকা ০৪ ফেব্রুয়ারি, ২০০৩ সালে প্রকাশিত ‘বই নিয়ে হইচই কই?’ শীর্ষক রাম রায়ের প্রবন্ধ এসব কথা জানাচ্ছে।
অতএব গ্রন্থকে শুধু বিষয়বস্তুর দিকে নজর না দিয়ে ‘পোশাকে'-র দিকেও মন দিতে হবে। মলাট, কাগজপত্র, লেখার স্টাইল, রঙ-চঙ, বাইন্ডিং এসব কিছুকেই আকর্ষণীয় করে তুলতে হবে। অর্থাৎ বইটি হাতে নিয়ে যেন ভালো লাগে, নজর কাড়ে, মন জুড়ায়। ছোট ছোট আরও কিছু প্রকাশনা সংস্থাও চোখ জুড়ানো আবরণে সাজিয়ে বইকে বাজারে নিয়ে আসছে। পড়তেও ভালো লাগে এসব বই। তবুও এটা সত্য যে, অসংখ্য বইয়ের দোকানের দ্বার বন্ধ হয়ে গেছে। এক্ষেত্রে বিশেষ করে বড় বড় প্রতিষ্ঠানগুলো সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে। ব্যক্তিগত মালিকানায় পরিচালিত ছোটখাট চটপটে দোকানগুলো সহজেই এগিয়ে যাচ্ছে। আমাজনের মতো ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো বইকে ব্যবসার সামগ্রী হিসাবে দেখে। শিল্প ও সংস্কৃতির দিকটি চোখ এড়িয়ে যায় তাদের। এমন কথা বলেন, মিউনিখের ঐতিহ্যবাহী বইয়ের দোকান লেমকুলের মিশাইল লেমলিং। এই জন্য তাদের এই ক্ষেত্রে টিকে থাকতেও কষ্ট হচ্ছে। ক্রেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ, ব্যক্তিগত পরামর্শদান, বিশেষ করে দোকানের সাজানো-গোছানো পরিবেশ মানুষকে টানতে পারে। আর ছোট ছোট বইয়ের দোকানগুলো এদিকটায় খেয়াল রাখে। অতএব বইয়ের ব্যবসার চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় বিপণনের দিকটিও গুরুত্বের সঙ্গে দেখতে হচ্ছে। বিজ্ঞাপনও দিতে হবে লাগসইভাবে। পাঠককে জানাতে হবে, তার পছন্দের বইটির কথা।
বঙ্গদেশের আদি প্রকাশকরা এমনটিই করেছিলেন। ১৮৮৭ সালের ১৫ নভেম্বর ‘ক্যালকাটা গেজেট’-এ প্রথম বইয়ের বিজ্ঞাপনে ছাপা হয়েছিলো: The first book in which Bengalee types were used was Halhed’s Bengalee grammar printed Hoogly at the press established by Mr. Andrews, a book-seller in ১৭৭৮. এরও আগে, ১৮৩০ সালের ৩০ জানুয়ারি ‘সমাচার দর্পণ’-এ বিজ্ঞাপন ভাষ্যে লেখা হয়: ‘এতদ্দেশীয় লোকের মধ্যে বিক্রয়ার্থে বাঙ্গালা পুস্তক মুদ্রিত করণের প্রথমোদ্যোগ কেবল বহু বৎসরাবধি হইতেছে...যে পুস্তক মুদ্রিত হয় তাহার নাম অন্নদামঙ্গল, শ্রীযুক্ত গঙ্গাকিশোর ভট্টাচার্য তাহা বিক্রয়ার্থে প্রকাশ করেন। ’ পত্রিকায় নয়, সবচেয়ে বেশি বইয়ের বিজ্ঞাপন থাকত পঞ্জিকায়। অত্যন্ত আকর্ষণীয় ছিলো সেসব বিজ্ঞাপন। আগে পঞ্জিকা, তারপর সংবাদপত্র, সাময়িকিতে বিজ্ঞাপন। ‘বঙ্গবাসী’ সম্পাদক যোগেশচন্দ্র বসু ‘মঙ্গলকাব্য’ ছাপতেন ধারাবাহিক, খণ্ডে খণ্ডে। এর আগে সংবাদপত্রে সাহিত্য বিষয়ক রচনা ধারাবাহিক ছাপানোর রেওয়াজ ছিলো না। ১৮৮৩ সালে সাধারণী’ পত্রিকায় যোগেশচন্দ্র বিজ্ঞাপন দিলেন, ‘বাংলা সাহিত্য ভাণ্ডারে এক উজ্জ্বল মণি; বীর, করুণ, আদি প্রভৃতি সব রসেই এ মহাকাব্য (অন্নদামঙ্গল) পরিপূর্ণ। হোমার, মিল্টন, ভার্জিন, বাল্মীকি পাঠে যে ফল, ইহা পাঠেও সেই ফল; তবে ভাই বঙ্গীয় যুবক তুমি উহা পড়িবে না কেন?’
বিজ্ঞাপন যে সর্বদাই চটকদার এবং প্রকৃত সত্য নয়, উপরোক্ত ভাষ্য তার প্রমাণ। কারণ, উক্ত গ্রন্থ উল্লেখিত মহাকবিদের রচনার সঙ্গে একাসনে বসতে পারেনি। বিজ্ঞাপন ছাড়াও সেকালে পুস্তক বিপণনের অন্যরূপ দেশজ প্রক্রিয়া ছিলো। বটতলার বই ফেরিওয়ালারা মাথায় করে বিক্রি করত রাস্তায় হেঁকে হেঁকে। দুপুরবেলা বাড়ির মেয়েরা সে বই শুয়ে শুয়ে পড়ে বিনোদন লাভ করত; এখন যেমন বিনোদন হয় টিভি দেখে দেখে। বিজ্ঞাপন এখন পাঁজি-পঞ্জিকার বদলে টিভিতে। যদিও পত্রিকার বিজ্ঞাপন এখনও লুপ্ত হয়নি। তথাপি কেবল টিভি, ডিস, স্যাটেলাইট তথা ইলেক্ট্রনিক মিডিয়া ক্রম বর্ধিষ্ণু। ‘দেবদাস’ সিনেমা তৈরি হলে মূল বইয়ের বিক্রি হয় বেশি। হুমায়ূন আহমেদের যেসব উপন্যাস নাট্য বা চলচ্চিত্র হয়েছে, সেগুলোও বাজারে বেশি চলেছে। কিন্তু পশ্চিমা জগত বইয়ের বিজ্ঞাপনে ও বিপণনে যে বিশাল আয়োজন করে থাকে, সেটার ধারে-কাছেও কেউ পৌঁছাতে পারেনি। জে.কে. রাউলিং-এর হ্যারি পটার সিরিজের নতুন বই বের হওয়ার বছর খানেক আগেই পৃথিবীর দেশে দেশে তোড়জোড় শুরু হয়ে যায়। প্রকাশনা, বণ্টন, বিপণন, বিজ্ঞাপন ইত্যাদির মাধ্যমে মিলিয়ন কপি বিক্রিও টার্গেট করা হয়। বই ও প্রকাশন সেখানে আসলেই শিল্প। আর আমাদের এখানে দোকানদারির মতো ব্যক্তিগত ব্যবসা; কুটির শিল্পও নয়।
বিজ্ঞাপন ও বিপণনের প্রধান উদ্যোগ পরিলক্ষিত হয় বইমেলার সময়ে। অবশ্য ঢাকার বাংলা একাডেমির অমর একুশে বইমেলা এখন জেলায় জেলায়, হাটে-গাঁয়ে-গঞ্জে ছড়িয়ে পড়েছে। আয়োজনে খামতি থাকলেও আবেগ ও ঐতিহ্যগত দিক থেকে বইমেলার তুলনা নেই। অসংখ্য স্টলের মাঝে সুপরিসর সভামঞ্চ, আলো ঝলমল পরিবেশ, সুবেশ-সুবেশা তরুণ-তরুণীর কলকাকলি, খাদ্য-পানীয়ের সমাহার, বৈদ্যুতিক যন্ত্রে হারানো-প্রাপ্তি-নিরুদ্দেশের সঙ্গে নতুন বইয়ের ঘোষণা ইত্যাকার আয়োজনে একুশের বইমেলা সরব। কোনো কোনো স্টলের সামনে লম্বা লাইন, কেউ কেউ বই ছুঁতে চান, কেউ কেউ শুঁকতে চান, ক্বচিৎ কয়েকজন কিনতেও চান। বইমেলাকে অছিলা করে বহু অন্যান্য সামাজিক-রাজনৈতিক সন্ধি-অভিসন্ধিও বিকল্প-উন্মোচনের রাস্তা খুঁজে বেড়ায়। প্রেমিক-প্রেমিকারা ভিড়ের মধ্যেও দূরের অন্ধকার দুরন্ত প্রতিভার খোঁজে নিবিড় হতে আসেন, বিপ্লবীরা সোচ্চারে শহীদ হওয়ার কল্পনা বুনতে আসেন, সফল কবিরা হঠাৎ ব্যর্থতার স্বাদ পেতে, ব্যর্থ কবিরা সফলতার মরীচিকা ধরতে উদ্যত। এরই মধ্যে বেওয়ারিশ হট্টগোল বইমেলাকে প্রকম্পিত করে। চলে বইয়ের বিপণন ও বিজ্ঞাপন। সবই চলে মূলত বইকে কেন্দ্র করেই। বই থাকে মননে ও অন্তরে। বইকে কেন্দ্র করে জনসমাবেশ ও জনআবেগকে সামনে রেখে উদ্যোগী প্রকাশকরা এগিয়ে এলে হতাশার অন্ধকার ক্রমেই কেটে যাবে। এবং বইকে বিষয়বস্তু ও বাহ্যিক দিক দিয়ে আকর্ষণীয় করে তুলতে পারলে এই ডিজিটালের যুগেও মুদ্রিত বই-এর ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল হয়ে থাকবে। হয়তো বিক্রয় বা পসার কমবে, কিন্তু সামাজিক ব্যবহারের প্রয়োজনে বইয়ের দরকার পড়বে। ছোট্ট সিডিতে বন্দি ই-বুকে কাজ চলবে না। আর আমাদের দেশে সবাই এখনও কম্পিউটার ব্যবহারের সুযোগের আওতায় আসেনি। ফলে ই-বুক ব্যাপক হতে আরও অনেক দিন লাগবে। শেষ ভরসা হয়ে থাকবে লাইব্রেরি বা পাঠাগার।
অতএব, বিশ্বায়ন ও তথ্য-প্রযুক্তির বিপ্লবের মাতাল সময়েও গ্রন্থ ও গ্রন্থাগার টিকে থাকবে, এই আনন্দ প্রকাশই সুবিবেচনাপ্রসূত একমাত্র কাজ হতে পারে না। গ্রন্থ ও গ্রন্থাগার বিবর্তন ও উন্নয়নে আজকের যে চেহারা ও কাঠামোগত রূপান্তর সাধন করেছে, সেটাকে সমকালীন বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ব্যবহারের মাধ্যমে ধীরে ধীরে আরও এগিয়ে নেওয়াই জরুরি।
বাংলাদেশ সময়: ১৭১৬ ঘণ্টা, এপ্রিল ২৮, ২০১৭
এসএনএস