রাজনীতি বিজ্ঞানে অ্যারিস্ট্রটল, পর্দাথ বিজ্ঞানে নিউটন, মনোবিজ্ঞানে সিগমুন্ড ফ্রয়েড যেমন অবিস্মরণীয় অবদানের জন্য প্রসিদ্ধ, জীব বিজ্ঞান বা বায়োলজিক্যাল সায়েন্সে ডারউইন তেমনি প্রবাদপ্রতিম কৃতিত্বের অধিকারী। ‘বিবর্তনবাদ’ তত্ত্বের মাধ্যমে সমগ্র বিশ্বকে নাড়িয়ে দিয়েছিলেন তিনি।
দীর্ঘদিন জাহাজে ঘুরে ডারউইন প্রাণী ও উদ্ভিদ জগত সম্পর্কে অর্জন করেছিলেন প্রত্যক্ষ জ্ঞান। পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে প্রকাশ করেছিলেন বৈজ্ঞানিক মতামত। আকৃষ্ট করেছিলেন বিশ্বের নজর। এবং অবশেষে কাজের জন্য তিনি চলে গিয়েছিলেন লোক চক্ষুর চেয়ে দূরের শান্ত পরিবেশে। কোনো গবেষণাগার বা বিশ্ববিদ্যালয় নয়, ডারউইন আলোড়ন জাগানো কাজগুলো করেছিলেন বিলেতের এক প্রত্যন্ত গ্রামে। ডারউইনের নিভৃত কাজের জগত এখনও কর্মমুখী মানুষের এক অনিঃশেষ প্রেরণার উৎস।
একটি উদাহরণের সাহায্যে ডারউইনের নিভৃতচারী গবেষণাচর্চার বিবরণটি আঁচ করা যেতে পারে। রুশ বিজ্ঞানী ক্লিমেন্ত তিমিরিয়াজেক ১৮৬৭ সালের গ্রীষ্মে বিশ্ববন্দিত বিজ্ঞানী চার্লস ডারউইনের সঙ্গে সাক্ষাতের উদ্দেশে বিজ্ঞানীর আবাস ডাউনগাঁয়ে যাওয়ার জন্য লন্ডনের অদূরে অফিংটন স্টেশনে এসে নামেন। নামার পর গন্তব্যে পৌঁছার জন্য কোনো যানবাহন খুঁজেও তিনি পাননি। অগত্যা দশ মাইল পথ পায়ে হেঁটে পৌঁছানো সম্ভব হয় ডাউনগাঁয়ে। দ্বিজেন শর্মা, চার্লস ডারউইন: দ্বিশত জন্মবার্ষিকীর শ্রদ্ধার্ঘ্য গ্রন্থে এ প্রসঙ্গে বিস্তারিত বিবরণ দিয়েছেন। তা থেকে অনুমান করা যায়, কতোটা নিভৃত ও প্রত্যন্ত অঞ্চলে কাজের ক্ষেত্র ও পরিবেশ খুঁজে পেয়েছিলেন ডারউইন।
এ ঘটনার বৃত্তান্তের সঙ্গে একটি প্রশ্ন আবশ্যিকভাবে স্পষ্ট হয়, কীভাবে শহর থেকে দূরের এই গ্রাম্য-নির্জনে একজন মানুষের পক্ষে বিজ্ঞানের মতো পরীক্ষাসিদ্ধ বিষয়ে দুনিয়া কাঁপানো তত্ত্ব উদ্ভাবন করা সম্ভব হলো? শুধু ডারউইন নন, অনেকের ক্ষেত্রেই এমনটি সম্ভব হয়েছে বৈকি। গ্যালিলিও বা নিউটনের পরিবেশ কি তেমন জমকালো ছিলো? মোটেই না। যারা প্রকৃতই কাজ করেন, তারা পরিবেশ ও পরিস্থিতির বিরূপতায় ভেঙে যান না; কাজের প্রতি নিষ্ঠা ও একাগ্রতার মাধ্যমে বিরূপ পরিস্থিতিকেই বরং নিজের অনুকূলে নিয়ে আসেন। এটাই হলো প্রকৃত কর্মবীরের জীবন থেকে পাওয়া অন্যতম শিক্ষা।
স্মর্তব্য, আবিষ্কার-উদ্ভাবনের জন্য যন্ত্রপাতি, সাজসরঞ্জাম, সুযোগ-সুবিধা অবশ্যই প্রয়োজন, তবে বিজ্ঞানী মানুষটি সত্যিকার বিজ্ঞানী না হলে সবই বৃথা। যারা সত্যিকারের বিজ্ঞানী, তারা প্রতিভার সঙ্গে অধ্যবসায় মিলিয়ে প্রতিকূল পরিস্থিতিকে পরাজিত করে অসাধ্যসাধন করেছেন। দুনিয়ার তাবৎ হইচই থেকে মুখ ফিরিয়ে তারা নিজের কাজটি সততার সঙ্গে করে যান এবং শেষ পর্যন্ত বিজয়ের হাসিতে উদ্ভাসিত হন।
বিজ্ঞানের মতোই শিল্প, সাহিত্য, সামাজিক ও মানবিক বিদ্যা কিংবা নন্দনতত্ত্বের ক্ষেত্রেও কথাটি সত্য। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় কলকাতায় থাকতেন না। মফঃস্বলের গ্রামে গ্রামে ঘুরে জীবন কাটিয়েছেন। শরৎচন্দ্রও ছিলেন এক যাযাবর। আরজ আলী মাতুব্বর বরিশালে আর আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ চট্টগ্রামের প্রত্যন্ত অঞ্চলে বাস করতেন। কদাচিৎ প্রয়োজনে নগরে তাদের আগমন ঘটেছে; বাকি সময় কেটেছে নিমগ্ন ধ্যানের মতো স্বকীয় কাজে। কাজের অমল পরিবেশেই তারা খুঁজে পেয়েছেন আনন্দ, তৃপ্তি ও সাফল্য। রচনা করেছেন ইতিহাস-খ্যাত কর্ম সম্ভার।
স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ পর্যন্ত কাজের প্রয়োজনে শহর ছেড়ে বহুদূরের গ্রাম্য প্রকৃতির শান্তিনিকেতনে চলে গিয়েছিলেন। আত্মা ও শরীরকে প্রকৃতির সঙ্গে মিশিয়ে পুষ্টি সাধন করে রচনা করেছেন অবিস্মরণীয় গান, কবিতা, নাটক, গল্প এবং আরও কতো কী! জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম ও জসীম উদ্দীন শহরে থেকেছেন কম কমই; চারণের মতো ঘুরে বেড়িয়েছেন দেশময়। ইতিহাস রচনা করে স্যার উপাধি পাওয়া যদুনাথ সরকার নিজের দলিল-দস্তাবেজ ও উপকরণ নিয়ে নিভৃত স্থানে গবেষণায় লিপ্ত হতেন। তার ছাত্র ও বিখ্যাত ইতিহাসবিদ তপন রায়চৌধুরী নিজের আত্মজীবনী বাঙালনামায় যদুনাথ সম্পর্কে এসব কথা সবিস্তারে উল্লেখ করেছেন।
মানব সভ্যতা ও শিক্ষা-সংস্কৃতির ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখা যায়, সুপ্রাচীন-ক্লাসিক্যাল গ্রিক-রোমান আমলের সক্রেটিস-প্লেটো-অ্যারিস্টোটল, স্বর্ণালি ইসলামী মধ্যযুগের ইবনে খলদুন, নিযাম-উল-মুলক এবং আধুনিক বা উত্তরাধুনিক কালপর্বের নোয়াম চমস্কি, জাক দেরিদা, মিশেল ফুকো প্রমুখ যারা জ্ঞান-বিজ্ঞান-শিল্প-সাহিত্যে অবিস্মরণীয় কৃতিত্বের অধিকারী, তারা কেউই রাজ-দরবারের অনুগ্রহভাজন বা রাজধানীর বাসিন্দা ছিলেন না; অধিকাংশরাই ক্ষমতা ও ভিড় এড়িয়ে নিভৃতে নিজের কাজ করতে পছন্দ করেছেন। কেউ কেউ সরকারের রোষানলে পতিত হয়ে দূরান্তে পালিয়ে যেতেও বাধ্য হয়েছেন। কিংবা কারাগারের অভ্যন্তরে থেকেও নিজের প্রতিভার পুরোপুরি সদ্ব্যবহার করেছেন।
ফলে কাজের সঙ্গে স্থানের সম্পর্ক থাকলেও সেটা গৌণ। কাজ করতে চাইলে, তা যে কোনও স্থানেই করা যায়। উল্লেখ্য, বিশ্বের অধিকাংশ সাড়া জাগানো রচনা জেলখানায় বসে বহু বিখ্যাতজন রচনা করেছেন। পণ্ডিত নেহেরু, মিশেল ফুকো, নাজিম হিকমত তেমনই উজ্জ্বল উদাহরণ।
অতএব, কাজ করতে না-পারা বা না-চাওয়ার জন্য স্থান বা পরিবেশের প্রতি দোষারোপ করা আসলেই দুঃখজনক। তারপরও অনেকেই কাজের ক্ষেত্রে স্থানগত সুবিধা বা অসুবিধাকে প্রাধান্য দেন। বলেন, আহা! ঢাকা থাকলে কতো ভালো হতো! এই হতো, ওই হতো! টিভিতে চান্স পেতাম, প্রধান প্রধান কাগজে লেখা ছাপা হতো। প্রকাশকরা পেছন পেছন ছুটে আসতেন। এসব কথা যতো না বাস্তবসম্মত, তারচেয়েও বেশি কল্পনাপ্রসূত। নিজের মৌলিক কাজ ও কৃতিত্ব না থাকলে ঢাকা বা লন্ডন বসবাসের ফলে কিছুই যায় বা আসে না। আসল কথা হলো কাজ, স্থান নয়। সংসদ ভবনের পাশে বসবাস করলেই যে সংসদ সদস্য হওয়া যায় না, সেটাই হলো সার-সত্য-কথা।
তবুও বিশ্ব পরিস্থিতি ও যোগাযোগ ব্যবস্থার কারণে এখন অবস্থা পাল্টেছে বলে কারও কারও পক্ষ থেকে মনে করা হয়। কেউ কেউ এমনও মনে করেন, (এমনকি চট্টগ্রামের মতো প্রভাবশালী নগরের কেউ কেউ পর্যন্ত) ঢাকায় বা মিডিয়ার কাছে না থাকলে গবেষণা, লেখালেখি ইত্যাদিতে মোক্ষলাভ বা স্বীকৃতি অর্জন অসম্ভব। এ কথা আংশিক সত্য যে, একবিংশ শতাব্দীর তথ্যপ্রযুক্তিগত উৎকর্ষের যুগে মিডিয়ার বদান্যতায় বহু মানুষ নিজের প্রচার-প্রচারণাসহ এক ধরনের ব্র্যান্ডিং করে নিচ্ছেন। বাজার অর্থনীতির তোড়ে নিজেকে বাজারের চৌরাস্তায় টিকিয়ে রাখছেন। নিজের পণ্যটিও বিকোতে চেষ্টা করছেন। কিন্তু যখন মিডিয়ার ফোকাস বা লাইমলাইট সরে যাচ্ছে, তখন সেই ব্যক্তি ধ্বস্ত হয়ে ভূপাতিত হচ্ছেন। পাদপ্রদীপের নিচেও তার ঠাঁই হচ্ছে না। মিডিয়া দয়া করে বা বিশেষ কার্যকারণে লোকসম্মুখে ধরিয়ে না দিলে বা তুলে না ধরলে কেউ তাকে গ্রাহ্যই করছে না; মানুষ মনে রাখছে না; ইতিহাস তাকে ও তার কাজকে নিচ্ছে না।
উদাহরণ স্বরূপ বলা যায়, জীবনানন্দ দাশকে মফস্বলে গ্রাম্য কবি আখ্যা দিয়ে কলকাতার নাক-উঁচু বনেদিরা সমাজ ও পত্রিকার পাতায় বিশেষ স্থান দেননি। সে আমলের পত্রিকায় তার খুব কমই লেখা প্রকাশ পেয়েছে। আর তখন যাদের প্রচুর লেখা তৎকালীন পত্রিকায় ছাপা হয়েছে, তারা কেউ ভাবীকালে জীবনানন্দের মতো বিখ্যাত হননি।
ফলত সত্যিকারের প্রতিভার সঙ্গে মিডিয়া-সৃষ্ট ইমেজ বা কল্পচিত্রের মৌলিক পার্থক্য রয়েছে। এই পার্থক্য স্বীকার করে যারা স্বকীয় শ্রমে নিজের ব্যক্তিসত্ত্বার দিগন্তকে কর্মের বিশালতার উচ্চস্থরে পৌঁছাতে পারেন; তাদের সামনে স্থান, কাল, পাত্র, পরিবেশ, পরিস্থিতি, আনুকূল্য বা প্রতিকূলতা একমাত্র জরুরি বিবেচ্য বিষয় নয়। সবকিছুকে ছাপিয়ে তারা নিজের কর্ম-র্কীতির আলোকে উদ্ভাসিত হন সব বিরূপতার ঘেরাটোপ ভেঙেই। এটিই শিল্পীর নিয়তি, কবির বাস্তবতা এবং সৃষ্টিশীল মানুষের কর্মধারা।
এইসব কথা ও ঐতিহাসিক তথ্যে উল্লেখ্য করা হলো এজন্য যে, অধুনা প্রায়ই অনেকের মুখে হতাশার সুর শোনা যাচ্ছে। স্থানগত, পরিবেশগত, প্রশাসনিক বা রাজনৈতিক সুবিধা না পাওয়ায় নিজের মধ্যে অপার সম্ভাবনা থাকার পরেও কিছু করতে পারছে না বলে অনেকেই হা-হুতাশ করছেন। কিন্তু এই হতাশাবাদ কোনো কাজের কথা নয়। ঔপনিবেশিক আমলের ইংরেজ যুগে বা পাকিস্তানি আমলেও পরিবেশ-পরিস্থিতিগত বাধা-বিঘ্ন ছিলো। এখন নানা সীমাবদ্ধতা রয়েছে। যারা কিছু করতে চান বা করতে পারঙ্গম, তারা সব বাধা ডিঙিয়েই সেটা করতে পারবেন। হাতের তালুতে-ধরা মুঠোফোনের তরঙ্গে তারা অবারিত বিশ্বের কেন্দ্র ও প্রান্তে প্রান্তে স্বকীয় ঔজ্জ্বল্যে ছড়িয়ে যেতে পারেন। কাজের সংস্কৃতিতে মনোযোগী ও নিষ্ঠাবান হওয়ার মাধ্যমেই নিজেকে প্রকাশিত করার পথ উন্মোচিত করতে পারেন। তখন সব বাধা পেরিয়ে সাফল্যের স্বর্ণালী আলোয় চারদিক ভরে ওঠবেই। এটাই ধ্রুব ও ঐতিহাসিক সত্য।
‘ফাঁসির মঞ্চ থেকে’ নাম বিশ্ববিশ্রুত গ্রন্থের লেখক জুলিয়াস ফুচিক একটি মোক্ষক কথা বলেছিলেন, ‘জীবনকে ভালোবাসে বলেই মানুষ জীবনের সৌন্দর্যের জন্য যুদ্ধ করে’। জীবনবাদী-ইতিবাচক মানুষেরা জীবন ও সুন্দরের জন্য যুদ্ধ বা প্রচেষ্টার নিরন্তর পথেই পৌঁছাতে চান সাফল্যের ঠিকানায়। বিঘ্ন বা বিরূপতার যেকোনো কালা-পাহাড়কেও তারা অতিক্রম করেন অন্তঃহীন কর্মের প্রতীতীতে; নিভৃত কাজের জগতের অপ্রতিরোধ্য-সার্বভৌম শক্তিতে।
ড. মাহফুজ পারভেজ, কবি ও লেখক
অধ্যাপক, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
বাংলাদেশ সময়: ১২২৯ ঘণ্টা, মে ১৫, ২০১৭
এসএনএস