ছোঁয়াচে হাসির মতো সুখের এই অনুভূতিটা আমার নির্মল সুখ-স্মৃতির ঝাঁপি খুলে দিলো। মনের ভেতর একে একে স্পন্দন জাগাতে থাকল সেইসব স্মৃতি।
কতো বছর আগের কথা? মনে মনে হিসেব করে তা বের করার ধৈর্যটুকুও এখন নেই। তবে চোখ বন্ধ করে বলে দিতে পারিÑ আমি তখন গেঁয়ো ধুলো মাখা দুরন্ত এক বালক। ঝানু গোয়েন্দার মতো রহস্য উদ্ঘাটনের চেষ্টায় মেতে থাকিÑ প্রকৃতি আর আমার নিজস্ব চৌহদ্দির। এটি হয় তো বটে, কিন্তু কেন হয় তা খুঁজে বের করার তাগিদটা তাড়িয়ে বেড়ায় মনটাকে। দিন-তারিখ মনে নেই, তবে ঠিক সে বয়সটাতেই মা একবার গম ভাঙাতে আর এক হালি ডিম কিনতে বাজারে পাঠিয়েছিলেন। আগে ডিম কিনে নিয়ে গম ভাঙাতে পেষাই-কলঘরে লাইনে দাঁড়িয়েছিলাম। আমার সিরিয়াল আসার পর গম ভাঙাতে বেশি সময় লাগেনি। মাত্রই তো পাঁচ কেজি গম! মেশিনে দিতে না দিতেই পাঁচ কেজি গম হয়ে গেলো আটা। কলঘর থেকে বেরিয়ে ব্যাগটার ভেতর হাত সেঁধিয়ে সবে দেখতে গিয়েছি ঠিকমতো মিহি করে ভাঙানো হয়েছে কিনাÑ ও মা! কী গরম! এর ভেতর ডিম রাখলে নির্ঘাত সিদ্ধ হয়ে যাবে। যে-ই ভাবা সে-ই কাজ। সঙ্গে সঙ্গে একটি ডিম সেই গরম আটার ভেতর দিলাম ঢুকিয়ে। বড় রাস্তা ছেড়ে কাজীবাড়ির ভাঙা দেয়ালের ফাঁক গলে রায়বাড়ির পেছনের জঙ্গল দিয়ে নিজের আবিষ্কৃত শর্টকাট রাস্তায় আধা ঘণ্টার পথ দশ মিনিটে পেরিয়েছিলাম। মনে মনে বলেছিলামÑ বড় মানুষেরা কী বোকা! খামোখা সোজা রাস্তাকে ঘুরিয়ে নিয়েছে।
বাড়িতে ঢুকতেই মা আমার হাতের দিকে তাকিয়ে চোখ কপালে তুলে বলে উঠেছিলেনÑ ‘কি রে! ডিম আনতে বললাম এক হালি আর তোর হাতের পলিথিনে দেখি তিনটে, একটা কি ভেঙে ফেলেছিস?’ ব্যাগটা দাওয়ায় নামিয়ে মার হাতে ডিম তিনটি ধরিয়ে দিয়ে মুচকি হেসে ব্যাগের আটার ভেতর থেকে বাকি ডিমটা বের করে বলেছিলামÑ একটা ডিম আমি সিদ্ধ করেই এনেছি। ’ ‘তুই খা, বেবরাইদ্যা ছেলে কোথাকার!’ বলে মুখ ঝামটা দিয়ে মা ঘরে ঢুকে গিয়েছিলেন। ডিমটা সত্যিই সিদ্ধ হয়ে গিয়েছিল; খেয়েছিলামও খুব মজা করে।
আরেকটি সুখস্মৃতিও সে বছরেই। বৈশাখী ঝড়ের ডঙ্কা বাজিয়ে আষাঢ়ের গুড়ুগুড়ু মেঘ ঝমঝমিয়ে নেমে আসছে বৃষ্টি হয়ে। বাড়ির পাশের নদীটির নীলচে কালো পানি ঘোলা হয়ে গেছে। ফুলে ফেঁপে উঠছে বরষায়। কদিন পরেই কূল ছাপিয়ে ঢুকে পড়বে পাশের ক্ষেতে। ক্ষেত ছাড়িয়ে বাঁশঝাড় শুকিয়ে ঝাঁমা হয়ে ওঠা মাটি ভিজিয়ে দিয়েÑ গাব, হিজল, তেঁতুলতলা দিয়ে পানের বরজটাকে বাঁয়ে রেখে, ডানে মোচড় দিয়েই ঝাঁপিয়ে পড়তে থাকবে শুকনো পুকুরটায়। আমরা তখন কাচ্চা-বাচ্চারা বরষার সেই নতুন পানির গাইড হয়ে যেতাম সোৎসাহে। এক আঙুল এক আঙুল করে পানি বাড়ত আর আমরা সেই এগিয়ে চলা, ধেয়ে চলা পানির সঙ্গী হতাম দল বেঁধে। কোথাও কোনো উঁচু ঢিবিতে সেই পানি আটকে গেলে আমরা বাঁশের কঞ্চি দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে মাটি সরিয়ে নতুন পানি ঢোকার পথ করে দিতাম।
তো সেইসব উদ্দাম দিনগুলোরই কাহিনী সেটা। বাঁশঝাড় থেকে লুকিয়ে বাঁশ কেটে এনে হিজলতলার আমাদের গোপন ডেরায় মোল্লাবাড়ি, দত্তবাড়ির গাছ থেকে কাঁচা আম, তেঁতুল, লিচু পেড়ে গোপনে জমিয়ে রাখতাম। সেসব নুন-মরিচ দিয়ে মেখে খেতে খেতে ঝাড় থেকে কেটে আনা বঁশের সরু সরু ফালি বানাতাম দা দিয়ে। সেইসব ফালিকে নারকেলের কাতা দিয়ে জুড়ে বানা বানাতাম। বাড়ির পাশের সরু নদীটায় বাঁশের খুঁটি গেড়ে সেসব বানা গেড়ে চাঁই বা দুয়ারি পেতে রাখতাম শেষবিকেলে। গাঁয়ের হাট থেকে এসব দুয়ারি কিনতাম লুকিয়ে, বাড়ির কাউকে না জানিয়ে। গোয়ালঘরের বাঁশের খুঁটিতে ছিদ্র করে ব্যাংক বানিয়ে তাতে জমিয়ে রাখা টাকার প্রায় সবই তাতে খরচ হয়ে যেতো। কিন্তু সে দুঃখ পুষিয়ে যেতো মাছ ধরার বুনো আনন্দে। ভোরবেলা বাড়ির কেউ ঘুম থেকে জেগে ওঠার আগেই নদীতে গিয়ে দুয়ারি তুলতাম। তো, এমনই এক ভোরবেলা একটি দুয়ারি তুলতেইÑ ওহ্! কী যে আনন্দ! কী যে আনন্দ! কাঁচা হলুদ রঙের ডিমওয়ালা চিংড়ির ছোটাছুটিতে যেনো ভেঙে যাবে দুয়ারিটা! এত্তো চিংড়ি, আর এত্তো ওজনÑ দুয়ারিটা ডাঙায় তুলতে পিঠ বাঁকা হয়ে গিয়েছিল। মনের ভেতর সুখের সেই কাঁপনের কোনো তুলনা আজও খুঁজে পাই না।
খুশির খবরটা শুনে আমার বুকের ভেতর মুখ গুঁজে ওর সুখের সেই কাঁপনটা আমার কল্পনাকে রাঙিয়ে দিচ্ছে। এই ২০১৩ সালেÑ যখন পথে বেরুনো দায়; গাড়ি চলতে দেওয়া হয় না; রাস্তার পাশের সারি সারি গাছ কেটে ফেলে রাখা হয়; পেট্রলবোমায় পোড়া মানুষ মরণযন্ত্রণায় কাতরাতে থাকে হাসপাতালের বার্ন ইউনিটেÑ সেই তালকাটা সময়েও এই খুশির খবরটা দিয়ে প্রিয়ার মুখে আনন্দের দোলা দেখার ইচ্ছেটা চাগিয়ে উঠল। কিন্তু সেই মুহূর্তে প্রিয়ার সুখের চেয়ে আরেকজনের সুখ আমার কাছে বড় হয়ে উঠল। আমার কোনো অর্জনে বোধ করি যিনি সবচেয়ে বেশি খুশি হবেন। মনে ভেসে উঠল সেই মানুষটির ছবিÑ যাকে সুখী করার স্বপ্ন লালন করে আসছি মগজে দায়িত্ববোধ দানা বেঁধে ওঠার প্রাথমিক দিনগুলো থেকে। সুখবরটা দিয়ে জীবনে এই প্রথমবার তার সামনে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারব। বিশ^জয়ীর মতো। তাই খবরটা প্রিয়ার আগে বাবাকে জানাতেই পড়ি-মরি করে ছুটলাম বাসস্ট্যান্ডে। মোবাইলের ঘড়ি দেখে আঁচ করতে পারলাম, এখন রওনা দিলেও সন্ধ্যা নাগাদ বাড়ি পৌঁছানো যাবে।
বাসে উঠে বসতেই হুঁশ হলোÑ আরে, এখন না অবরোধ চলছে! গাবতলী গিয়ে বাস পাব তো? আদৌ যেতে পারব তো? না, যাবই। যেতে আমাকে হবেই। এমনকি হেঁটে হলেও। মনে মনে গোঁ ধরে বসলাম। ইচ্ছেটাকে আরও দৃঢ় করতে ভেতরে ভেতরে আওড়াতে থাকলামÑ বিদ্যাসাগর যদি মায়ের চিঠি পেয়ে ঝড়-ঝঞ্ঝায় নদী সাঁতরে বাড়ি যেতে পারেন তো আমি কেন বাবার জন্য সমস্ত বাধা ঠেলে বাড়ি যাব না? বাবার মুখে একটু হাসি দেখার জন্য কতোই না আকুলি-বিকুলিÑ সেই তিনি বিপন্ন হয়ে পড়ার পর থেকেই।
গ্রামের বাজারে ছোট্ট দরজি-দোকানের আয়ে একাই টেনেছেন একান্নবর্তী পরিবার। তিন ফুফুকে বিয়ে দিয়েছেন। ক্যানসার আক্রান্ত ছোটচাচার চিকিৎসা করিয়েছেন শেষ সম্বল জমিটুকু বিক্রি করে। না, এতো করেও বাঁচাতে পারেননি ভাইটিকে। বড়বোনকে বিয়ে দিয়ে কিছুটা নির্ভার হলেও পাঁচ সদস্যের সংসার-খরচ আর আমার এবং বাকি দুই বোনের লেখা-পড়া চালাতে দিন-রাত সেলাই মেশিনের চাকা ঘুরিয়ে গেছেন পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে পড়ার আগ পর্যন্ত। অবশ্য ততোদিনে আমি অনার্সটা শেষ করতে পেরেছিলাম। এরপর টিউশনি করে নিজে মাস্টার্স করার পাশাপাশি গ্রামের স্কুল আর কলেজে পড়া দুই বোনের পড়ার খরচ আমাকেই চালাতে হয়েছে। স্কুলের বোনটা আবার এবার এসএসসি দিচ্ছে। নতুন এক দর্জিকে দোকান ভাড়া দিয়ে মা তাতে বাবার চিকিৎসা আর সংসার খরচ চালাচ্ছেন। সংসারের ঘানি টেনে টেনে বিধ্বস্ত, বিপন্ন বাবা আমার চাকরি পাওয়ার খবরটা পেয়ে কী যে খুশি হবেন! ভাবতেই রোমাঞ্চে নেচে উঠছে মন। চাকরিটাও আবার যা-তা চাকরি নয়, দেশের অন্যতম সেরা করপোরেট হাউসে এক্সিকিউটিভ পদে চাকরি!
যা আশঙ্কা করেছিলাম তা-ই সত্য হলো। গাবতলী থেকে দূরপাল্লার কোনো বাস ছাড়ছে না। দু-একটা লোকাল বাস চলছিল সাভারের নবীনগর পর্যন্ত, অগত্যা তারই একটিতে উঠে পড়লাম। একটু তো এগিয়ে যাওয়া যাবে! নবীনগর গিয়ে অনেকক্ষণ ঘোরাঘুরি করে মাটি টানা একটি ট্রাক পেলাম, মানিকগঞ্জ পর্যন্ত যাবে। অনেক বলে-কয়ে ড্রাইভারকে রাজি করিয়ে তাতে চড়ে বসলাম। ভাড়া অবশ্য অনেক বেশি নেবে; নিক, যেতে তো আমাকে হবেই। মানিকগঞ্জ থেকে টেম্পো পেলাম তরা পর্যন্ত। সেখান থেকে আরেক টেম্পোতে পাটুরিয়া ফেরিঘাট। পাটুরিয়া যেতেই রাত নটা বেজে গেলো। পদ্মা পেরিয়ে দৌলতদিয়াতে মিনিবাস পেলাম রাজবাড়ি রাস্তার মোড় পর্যন্ত। কিন্তু বড় মুশকিলে পড়লাম সেখানে নেমে। এমনিতেই তেমন কোনো যানবাহন চলছে না, তার ওপর রাত যতো বাড়ছে ততোই ফাঁকা হয়ে যাচ্ছে রাস্তা। যশোর-খুলনার দিকে যাও-বা দু-একটা বাস যাচ্ছে, কিন্তু কুষ্টিয়ার দিকে কিচ্ছুটি যাচ্ছে না। কোনো হোটেল না থাকায় থাকারও উপায় নেই এখানে। এদিকে রাত প্রায় বারোটা বাজে। হঠাৎ একটি টেম্পো পেয়ে গেলাম রাজবাড়ি পর্যন্ত। সৌভাগ্য আর কাকে বলে! আমার এই চাকরি পাওয়ার মতোই অনেকটা।
মহা বিপদে পড়লাম রাজবাড়ি এসে। জানতে পারলাম রাত দশটা পর্যন্ত দু-একটা যদিও চলেছে কুষ্টিয়া পর্যন্ত, কিন্তু এখন কোনো গাড়িই যাচ্ছে না ওদিকে, এমনকি রিকশা-ভ্যানও নয়। ছুটলাম রেলস্টেশনে। ভাগ্যটা ভালোই বলতে হবে। লোকাল ট্রেন নেই, তবে জানা গেলÑ যশোর থেকে ঢাকাগামী আন্তঃনগর একটি ট্রেন আসবে আধ ঘণ্টার ভেতরই।
ট্রেন থেকে যখন ভেড়ামারা স্টেশনে নামলাম তখন রাত তিনটা। এখন আমার গ্রামের রাস্তায় পনেরো কিলোমিটার পথ হাঁটা ছাড়া কোনো উপায় নেই। একটু ভয় ভয় যে করছিল না তা নয়। ভয়টা ছিনতাইয়ের। অবশ্য আমার কাছে মোবাইলটা ছাড়া ওদের নেওয়ার মতো কিছু নেই। মোবাইলটাও আবার একেবারেই সস্তা দামের। হাঁটতে হাঁটতে ভাবছিলামÑ এই যে ইরাকে, আফগানিস্তানে, এখন আবার আমাদের দেশেও রোজ এতো এতো মানুষ মারা হচ্ছেÑ যারা মারছে তারা কি তাদের শত্রু ছিলো? মরার বেলায় সব সময়ই সেই তারাই আগেÑ যারা কারও আগেও নেই, পিছেও নেই। এইসব মৃত্যুতে কে কী পায়? এইসব আক্ষেপে ধপধপ করে বেড়ে যাচ্ছিল হাঁটার গতি। হালকা হাওয়া বইছে। শীত প্রায় যাই-যাই করছে, তবু এই ভোররাতে বেশ ভালোই শীত লাগছিল। হাঁটার গতি বাড়িয়ে দিলাম। দশ মিনিটেই শীত যে কোথায় পালালো! রীতিমতো ঘামতে শুরু করলাম। ভোরের হাওয়ায় নিবিড় গাছপালায় ছাওয়া ধুলো-ওড়া রাস্তায় হাঁটতে বেশ লাগছিল, তার ওপর বুকের ভেতর সুখবরের পুলক!
বাড়ির ভিটায় যখন পা রাখলাম মা তখন খোপ থেকে মুরগিগুলো ছেড়ে খুদ-কুড়ো দিয়ে সবে উঠোন ঝাড়– দিতে শুরু করেছেন। আমাকে দেখেই চরম উচ্ছ্বাসে আমার নামটা উচ্চারণ করেই ছুটে এসে জরিয়ে ধরলেন। ঘরের ভেতর থেকে ‘কে, কে এসেছে’Ñ উঁচুস্বরে জিজ্ঞেস করেই কাশতে শুরু করলেন বাবা। কোমরের নিচ থেকে পক্ষাঘাতগ্রস্ত না হলে বোধ হয় তিনিও ছুটে বেরিয়ে আসতেন। দুই বোনও চোখ কচলাতে কচলাতে, কিন্তু বাঁধভাঙা খুশিতে বেরিয়ে এলো উঠোনে।
মা পরাটা বানানোর জন্য আটা ঢালছিলেন পাত্রে। বাড়ির সবাই জানে সকালের নাশতায় পরাটা আর ডিমভাজি আমার খুব প্রিয়। আমি মার হাত টেনে ধরে থামিয়ে দিলাম। বললামÑ ক্ষুধায় পেট চোঁ চোঁ করছে আর ঘুমে চোখ বুজে আসছে, অতোক্ষণ অপেক্ষা করতে পারব না। অগত্যা মা কাঁচামরিচ ডলে লবণ দিয়ে পান্তাভাত মেখে মুখে তুলে খাইয়ে দিলেন। খেয়েই দিলাম লম্বা এক ঘুম। দুপুর দেড়টার দিকে ঘুম ভেঙে গেলে বাবার সামনে সবাইকে ডেকে খুশির খবরটা দিলাম। খুশিতে সবাই সবাইকে জড়িয়ে ধরল। আর বাবার চোখ বেয়ে নেমে এলো খুশির মুক্তোদানা অশ্রু। কিন্তু ছোটবোনটাকে কিছুটা মনমরা লাগছিল।
ওকে কাছে টেনে নিয়ে বললামÑ কী রে, মখা (মন খারাপ)? দুষ্টুমি করে আমরা ভাই-বোনেরা এভাবেই সংক্ষেপে কথা বলি। ও মুখ খোলার আগেই কলেজ পড়য়া বোনটা বলল, ‘বুঝতে পারছিস না ভাইয়া? ওর পরীক্ষায় যে হরতালের বিষগেঁরো লেগেছে!’ আমার আগেই এ ব্যাপারে ওকে সান্ত¡না দেওয়া উচিৎ ছিলো, কিন্তু খুশির উচ্ছ্বাসে এ সামান্যতম কাণ্ডজ্ঞানও লোপ পেয়েছিল। ওর কপালে একটি চুমু খেয়ে বললাম, কী করবি বল? আমরা সবাই ভীষণ এক দুঃসময় পার করছি। আর শুধু কি আমরা? ইরাক, সিরিয়া, লেবাননের কথা ভেবে দেখ! তুই তো তবু অনিশ্চয়তার ভেতরেও পরীক্ষা দিতে পারছিসÑ ওসব দেশের ছেলে-মেয়েরা তো হাতের মুঠোয় জীবন নিয়ে দৌড়ে পালাচ্ছে। সেদিন খবরের এক ভিডিও চিত্রে দেখলাম, বারো বছরের এক শিশুকে দিয়ে একজন জিম্মিকে হত্যা করানো হচ্ছে; সভ্যতার প্রাচীন নিদর্শনগুলো কী নির্মম নিষ্ঠুরতায় ভেঙে গুঁড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে!
‘আমাদের দেশের পরিস্থিতি তো ওসব দেশের মতো নয়!’ কলেজ পড়–য়া বোনটা ফোঁড়ন কাটল। একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললামÑ হতে কতোক্ষণ? যা সব চলছে! এর ভেতরে বাবার বিছানার সামনে রাখা টেবিলের ওপর টেলিভিশনে একটি চ্যানেলে খবর শুরু হলো। বাবার সময় কাটানোর জন্য সস্তায় সেকেন্ডহ্যান্ড এই টেলিভিশনটা আমিই কিনে দিয়েছিলাম।
একটা খবরে হঠাৎ স্তম্ভিত হয়ে গেলাম। মোহাম্মদপুরে একটি বাসে পেট্রল বোমা মারা হয়েছে। দশ-বারোজন দগ্ধ হয়েছে। তাদের ভেতর কোনো এক কলেজের এক ছাত্রীর অবস্থা গুরুতর। আরও কয়েকজনের সঙ্গে তাকেও ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে নেওয়া হয়েছে। সংবাদ পাঠক তার নামটা উচ্চারণ করতেই আঁতকে উঠলাম। আমার সুখবরটা ওকে কি জানাতেও পারব না। কেউ যেনো হৃৎপিণ্ডটা খামচে ধরল। অনেক কষ্টে নিজেকে সামলে একটু সময় নিয়ে বললামÑ বাবা, মা, আমাকে এক্ষুনি ঢাকা রওনা হতে হবে। দুজনেই প্রায় একই সঙ্গে বলে উঠলেন, ‘এতদিন পরে এলি, একটি দিনও কি থাকবি না?’
না মা, কালকের ভেতরে কাগজপত্র জমা না দিলে চাকরিতে জয়েন করা যাবে না। মা সম্ভবত বুঝতে পারছিলেন আমি মিথ্যে বলছি। বাবা খসখসে গলায় নিজের হতাশা সামলে নিয়ে বললেন, ‘তা হলে যাও। কিন্তু খুব সাবধানে যেও। পথঘাটের যা অবস্থা!’ মা ছুটলেন আমাকে খাবার বেড়ে দিতে।
ফিরতি পথে দৌলতদিয়া পর্যন্ত একটি লোকাল বাস পেয়ে গেলাম। ভাগ্য ভালোই বলতে হবে। পদ্মা পার হয়েও গাবতলীর একটি লোকাল বাসে ঠাঁই হলো। তবে সিট পেলাম না। রড ধরে দাঁড়িয়ে যেতে হলো। এসব কোনো কষ্টই তখন আর আমাকে ছুঁতে পারছিল না। যত দ্রুত সম্ভব বার্ন ইউনিটে যেতে হবে। ওকে বাঁচানো যাবে তো? ঢাকার দিকে যতোই এগুচ্ছি শঙ্কাটা ততই চেপে ধরছে কলজেটা।
রড ধরে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে কখন ঝিমুনি এসেছে বুঝতে পারিনি। সম্ভবত ততক্ষণে সাভার পেরিয়ে এসেছি। হঠাৎ এক প্রচণ্ড শব্দের পরই দাউ দাউ করে জ¦লে উঠল গোটা বাস। হাজার হাজার সূর্যের গনগনে আগুনের ভেতর দিয়ে বেরুনোর পথ খুঁজতে লাগলাম। আমাকে ঘিরে ধরল রাক্ষুসে আগুন। পুড়তে পুড়তে কয়লা হওয়ার আগেই চিরদিনের মতো জ্ঞান হারালাম। হারিয়ে গেলাম স্বপ্নসমেত। সাধ মেটানোর অতৃপ্তি নিয়েই।
বাংলাদেশ সময়: ১২৩৯ ঘণ্টা, মে ১৯, ২০১৭
এসএনএস