হ্যাঁ, উপক্রমণিকাই বলবো। একটি সুলিখিত ও সুখপাঠ্য উপক্রমণিকা যেমন একটি বইয়ের প্রতি পাঠককে আকৃষ্ট করতে পারে, ‘একজন কমলালেবু’ও তেমনি পাঠকে আকৃষ্ট করে জীবনানন্দকে আরো গভীর ভাবে উন্মোচন করার জন্য।
জীবনানন্দ কি ‘রূপসী বাংলা’র কবি নাকি ‘বনলতা সেন’ এর কবি এই দ্বিধা অনেক পাঠকেরই হয়তো নিরসন হবার নয়। ‘একজন কমলালেবু’ পড়ার পরেও নয়। জীবনানন্দ কি এটিই চেয়েছিলেন, আমরা এই বিভ্রান্তির মধ্যে থাকি? বলতা সেনের মধ্যে রূপসী বাংলাকে কিংবা রূপসী বাংলার মধ্যেও কি তিনি বনলতা সেন কে দেখতে পাননি? পেয়েছিলেন হয়তোবা।
কবির কালজয়ী কবিতা ‘বনলতা সেন’ এর কিছুটা ব্যবচ্ছেদ আছে, কিন্তু শাহাদুজ্জামান কিছু সূত্র ধরিয়ে দিয়ে চুড়ান্ত বিশ্লেষণের দায়িত্ব ছেড়ে দিয়েছেন পাঠকের হাতেই। কবিতার প্রতিটি লাইন আমাদের দাঁড় করিয়ে দেয় রহস্যের মুখোমুখি। ‘পাখির নীড়ের মতো চোখ তুলে নাটোরের বনলতা সেন’। পাখীর নীড়ের উপমায় কবি চোখের বর্ণনায় পাখির নীড়ের বিশালত্ব বুঝিয়েছেন কী? নাকি বুঝিয়েছেন ‘আশ্রয়’? কী আশ্চর্য! আমরা এই উত্তর-আধুনিকতার যুগেও জীবনানন্দের কবিতার পাঠোদ্ধারে ব্যস্ত। তিনি যে তাঁর প্রজন্মের বা দ্বিতীয় প্রজন্মের চেয়ে তৃতীয় কিংবা তার পরবর্তী প্রজন্মগুলোর জন্যই লিখেছেন সেই অহংকারের যথার্ততা তো দেখাই যাচ্ছে। শাহাদুজ্জামান কবির এই অগ্রসরতা আর শক্তিমত্তাই আমাদেরনতুন করে মনে করিয়ে দিলেন। কেবল কবিতার শরীরই নয়, কবিতার বিষয় বা উপলক্ষ বনলতা সেন সম্পর্কে এতোদিনের ধারণায় একটু বাঁক নিলো। শাহাদুজ্জামানের উন্মোচনায় অন্য এক বনলতা সেনের ছায়া দেখা গেল। আমরা সেই ছায়াটিকে সত্যি মনে করলাম কি করলাম না সে ভিন্ন বিষয়। কেউ অনুসন্ধিৎসু হলে হয়তো নতুন করে নেমে পড়বেন রহস্য উন্মোচনে।
বইটির শুরু এবং শেষ একই প্রশ্ন দিয়ে। কবির মৃত্যু কি আত্মহত্যা, নিছক দুর্ঘটনা, নাকি হত্যাকাণ্ড?
লেখক সে প্রশ্নটি উস্কে দিয়ে আর ময়নাতদন্তের কাজটি করেন নি। সে এক অপার রহস্য। ময়না তদন্তের ঔৎসুক্য না থাকলেও বিষয়টির একটু গভীরে যাওয়ার চেষ্টা অন্য কেউ করে দেখতেই পারেন।
তবে কবির মৃত্যু-পুর্ববর্তী দুই এক দিনের ঘটনা বিশ্লেষণ করলে কারো কারো মনে হতে পারে আত্মহত্যার বিষয়টি তাঁর মাথায় এসেছিল। কিন্তু তা নিয়ে তিনি দ্বিধা দ্বন্দ্বে ভুগছিলেন। যাদের মধ্যে আত্মহত্যা নিয়ে দ্বিধা থাকে বা সাহসিকতার (!) অভাব থাকে, তারা অনেক সময় আত্মহত্যা থেকে যাতে তার চারপাশের লোকজন তাকে নিবৃত রাখে সে রকম কিছু পরোক্ষ ইঙ্গিত দেয় (ওয়ার্নিং সাইন)।
জীবনানন্দ কি সে রকম কোন ইঙ্গিত দিতে চেয়েছিলেন? যদি তাই হয়, তাহলেও বলতে হয়ে সে ক্ষেত্রেও তিনি ছিলেন তাঁর প্রজন্মের চেয়ে অনেক এগিয়ে। কারণ, আমরা ডিপ্রেশন, আত্মহত্যা এবং তার বাহ্যিক এবং অভ্যন্তরীণ উপসর্গ সম্পর্কে যা জানি, সে সময় তা তেমন করে আমাদের সমাজে জানা ছিলো না।
আরেকটি বিষয় ভাবা যেতে পারে। মৃত্যু-পূর্ববর্তী দুই এক দিনের ঘটনা সে রকম কিছু না হয়ে এটি একটি অডিটরি এবং ভিজুয়্যাল হ্যালুসিনেশনের স্বাক্ষরবাহীও হতে পারে। তবে কি সিজোফ্রেনিয়ার শুরু? কিংবা ডিপ্রেশনের গভীরতম তলদেশ? তাহলে তো আত্মহত্যার মঞ্চ তৈরি হয়েই গেল। পটভূমি তো আগেই ছিল।
অবশ্য অন্য কোন পাঠক হয়ত অন্য ভাবেও দেখতে পারেন বিষয়টিকে। জীবনানন্দ দাশ তার পরিণত বয়সের প্রায় পুরোটাই ডিপ্রেশনে ভুগছিলেন – একথা নির্দ্বিধায় বলা যায়। তবে বইটি পড়তে গিয়ে প্রশ্ন জাগলো - তাঁর ‘এস্পারজার্স সিনড্রোম’ ছিলো না তো? হয়তো কোন মনোবিজ্ঞানী এ নিয়ে আরো গবেষণা করবেন এক সময়। সেই মনোবিজ্ঞানীর উদ্দেশ্যে একজন সাধারণ পাঠক হিসেবে আমার এই প্রশ্নটি তোলা রইলো।
লেখক তার এই বইটির ‘একজন কমলালেবু’ নাম দিলেন কেন এই প্রশ্নটি উঠতে পারে। কমলালেবু কবিতার ৮টি লাইনে জীবনানন্দ দাশ নিজের জীবন, আগামীর আকাংখা, বিষন্নতা ও এক ধরনের অসহায়ত্ব প্রতিবিম্বিত করেছেন। এই একটি কবিতার পুনপৌনিক পাঠ হতে পারে জীবনানন্দকে চেনার সোপান।
শাহাদুজ্জামানের বইটি মনে হবে এই কবিতার সম্প্রসারিত সংস্করণ। হয়তো সেখানেই নামকরণের সার্থকতা।
জীবনানন্দকে আবারো পড়তে হবে, আরো পড়তে হবে – এই তাগাদা নিয়েই পাঠক এই বইটি পড়া শেষ করবেন। যারা ব্যক্তি জীবনানন্দকে বা তাঁর কবিতা, গল্প ও উপন্যাসকে জানতে চান শুধু তাদেরই নয়, যারা আধুনিক বাংলা কবিতার নবযুগের উন্মেষকে জানতে চান তাদের জন্যও এই বইটি আবশ্যিক পাঠ। বইটির ম্যূল সাড়ে ৪শ’ টাকা।
জীবনানন্দকে এভাবে আমাদের সামনে, বিশেষ করে নতুন প্রজন্মের সামনে তুলে ধরার জন্য শাহাদুজ্জামানের প্রতি অভিবাদন।
বাংলাদেশ সময়: ১৩৪০ ঘণ্টা, জুন ৪, ২০১৭
জেডএম/