ঢাকা, সোমবার, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

শিল্প-সাহিত্য

নীল উড়াল: চতুর্থ পর্ব

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৫৫০ ঘণ্টা, আগস্ট ২৩, ২০১৭
নীল উড়াল: চতুর্থ পর্ব নীল উড়াল

নায়ক ম্যাকগিল ভার্সিটির অধ্যাপক-লেখক-অভিবাসী বাংলাদেশি। ফরাসি সুন্দরী মার্গারেট সিমোনের প্রণোদনায় দেশে মাদকচক্র নিয়ে গবেষণাকালে ঘটনা মোড় নেয় রোমাঞ্চকর বাঁকে। আসে ধুরন্ধর বন্ধু-অস‍ৎ ব্যবসায়ী এনামুল, সুন্দরী স্টাফ রোকসানা, মধুচক্রের জেনিফার-মলি-পরী, ক্লিনিকের অন্তরালের মিসেস খোন্দকার, রমনার শফি মামা ও ফুলি, ‘উড়াল যাত্রা’র সাইফুল, বিড়ালের কুতকুতে চোখের তরুণ সাংবাদিক ফরমানউল্লাহ এবং ছোটখালার রহস্যময় মেয়ে অন্তরা। প্রেম ও বেঁচে থাকার যুগল উড়ালে কাহিনী আবর্তিত হতে থাকে।

৪.
অফিসের খাতায় জমানো ছুটি ছিল। অনেক দিন বিশেষ ছুটি-ছাটা নিতে হয় নি।

অনেক ছুটি জমে আছে। খুব সহজেই পাওনা ছুটি থেকে ছ’মাস মঞ্জুর করা গেল। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ মাত্র একবার দীর্ঘ ছুটি নেওয়ার কারণ জানতে চাইল। আমি বললাম, ‘রিসার্সের ডাটা সংগ্রহ করব। ' তাতেই সব কাজ হয়ে গেল। ছুটির অনুমতির সঙ্গে একটি চিঠি পেলাম, ‘আশা করি তোমার গবেষণা কাজে বিশ্ববিদ্যালয় উপকৃত হবে। তোমাকে এ কারণে সবেতন ছুটি দেওয়া হচ্ছে। ’ ব্যাটারা খুব পজেটিভ। সব ব্যাপারেই আশা করে। ইতিবাচকভাবে কিছু সংযোজন করতে চায়।

নীল উড়াল: তৃতীয় পর্ব

বাংলাদেশে আমাকে যেতে হবে একা। পরিবার-পরিজন সঙ্গে নেওয়া যাবে না। আমার স্ত্রীর অফিস আছে। তিনি তার পেশা ও পরিবার নিয়ে ব্যস্ত। সন্তানদের ক্লাস। সবাইকে নিয়ে ড্রাগসের মতো ঝুঁকিপূর্ণ বিষয়ে কাজ করাও সম্ভব নয়। শত্রুপক্ষ আমাকে ঘায়েল করতে এসে ফ্যামিলিকে টার্গেট করবে। থাক তারা তাদের জগতে। আমার শেকড় বাংলাদেশে হলেও তাদের শেকড় এখানেই। এটাই তাদের নিজের দেশ। ওরাও আমাকে বাধা দেওয়ার চেষ্টা করে নি। করলেও খুব একটা লাভ হত না। ওরা জানে, সিদ্ধান্ত যখন নিয়েছি, আমি যাবই। ওরা এটাও জানে যে, পড়া আর লেখার একটি নিজস্ব জগতে আমি বাস করি। সে জগতেই আমি থাকব। সেখানেই আমি যাব।  
মার্গারেটকে একটি ইমেল করি:
‘আমি ছ’ মাসের জন্য বাংলাদেশে যাচ্ছি। তুমি যে কথাগুলো বলেছো, সেগুলো সরেজমিনে পরীক্ষা করব। আমি আরেকটি উপন্যাস বা গবেষণার অপেক্ষায় মাঠে নামছি। তখন যদি তোমার প্রোগ্রাম হয় সেখানে, তাহলে দেখা হতে পারে। ’

ঘণ্টা খানেকের মধ্যে মার্গারেটের উত্তর পেলাম। মেয়েটি কি সব সময় অনলাইন! অফলাইন বলে কিছু নেই! সে লিখেছে:
‘ব্র্যাভো! আমি খুব খুশি হয়েছি। আশা করি, তোমার দ্বারা নতুন ধরনের একটি কাজ পাবো। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে বিশ্ব পুঁজিবাদ, রাজনীতি ও নেশার মধ্যকার আন্তঃসম্পর্ক উন্মোচিত করতে পারবে তুমি। আমি অবশ্যই চেষ্টা করব, তোমার অবস্থানকালে দক্ষিণ এশিয়ায় আসতে। অপেক্ষা কর। ঢাকা, কলকাতা বা দিল্লিতে কোনও এক সন্ধ্যায় আমরা এক সঙ্গে কফি খেতে খেতে আলাপ করব। টেক কেয়ার। ’

মার্গারেটের চিঠি পড়ে মনে এলো জীবনান্দীয় কাব্যিক অনুভূতি:
        “জীবন গিয়াছে চলে আমাদের কুড়ি কুড়ি বছরের পার
        তখন হঠাৎ যদি মেঠোপথে দেখা হয় কখনো আবার। ”
কষ্ট করে একটি দীর্ঘশ্বাস গোপন করলাম। হায় জীবন! স্বপ্ন আর বাস্তবের খেয়া তরী। ভাসছে অলৌকিক বাতাসে। হীরন্ময় জলে। এই ভাসার, এই উড়ার শেষ নেই কোনো!

বেশীক্ষণ ভাবালুতায় আচ্ছন্ন থাকা সম্ভব হল না। যাত্রার আয়োজন করতে হবে। টিকিট কাটতে হবে, ব্যাঙ্কে যেতে হবে। কানাডায় স্থায়ী হওয়ার পর এতো দীর্ঘ দিনের জন্য আর কখনও দেশে যাই নি। অতএব, ভালো করে গোছগাছ করতে হবে। প্রয়োজনীয় জিনিস-পত্র, রসদ সঙ্গে নিতে হবে। জরুরি আরেকটি কাজ করতে হবে। ঢাকায় যোগাযোগ। এবার আমি আত্মীয়-স্বজনের বাসায় থাকতে চাই না। আত্মীয় বলতে তো এক ছোটখালা। তাকে ডিস্টার্ব করা উচিত হবে না। বয়স হয়েছে। আমার জন্য তার চিন্তা বাড়বে। বিপদও হতে পারে। থাক! তাকে এর মধ্যে টেনে আনার দরকার নেই। আমি বরং ইনডিপেন্ডলি থেকে কাজ করতে চাই। এতে চলা-ফেরা সহজ ও মুক্ত হয়। যখন ইচ্ছে তখন মুভমেন্ট করা যায়। আত্মীয়-স্বজনের বাসায় থাকলে খুবই নিয়ন্ত্রিত থাকতে হয়। হোস্টের সুযোগ-সুবিধা বুঝে কাজ করতে করতে নিজের কাজ গৌণ হয়ে যায়।

আমার অবশ্য একাকী থাকার অভ্যাস আছে। একা থাকতেই বরং আমার বেশি ভালো লাগে। হোটেলে বা মাঝে-মাঝে নিজে রান্না করে খেয়ে নিলেই চলবে। এখন গুরুত্বপূর্ণ কাজ হলো ঢাকায় একটি ফ্ল্যাট ছ’ মাসের জন্য ভাড়ার ব্যবস্থা করা। কাকে দিয়ে করা যায়? আত্মীয়দের কাউকে বললে রাজি হবে না। নিজের বাসায় থাকতে বলবেই। এমন কি, আমার জন্য বাসা ঠিক করে দিয়েছে, এটা আত্মীয় মহলে চাউর হলে বেচারার আত্ম-সম্মানের সমস্যা হবে। এনামুলের কথা মনে পড়ল। স্কুল জীবনের বন্ধু। ঢাকার প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী। প্রথম প্রথম কানাডায় বেড়াতে এলে আমার এখানেই থাকত। এখন এখানেই নিজের বাড়ি হয়েছে। নাগরিকত্ব পাওয়ার ব্যাপারটাও প্রায়-গুছিয়ে এনেছে। ওকে দিয়েই বাসার ব্যবস্থা করতে হবে। ওর অনেক লিঙ্ক, অনেক স্টাফ। ঠিকই ব্যবস্থা করে দেবে।

এনামুলকে সহজে ফোনে পাওয়া গেল না। প্রথমে ওর সেক্রেটারি রোকসানা ফোন ধরল। মোলায়েম কণ্ঠ মেয়েটির। যথেষ্ট লাস্যময়ী। দেখতেও নিশ্চয় তম্বী তরুণী। সুন্দরী হবে অবধারিত। আমার কথা মেয়েটিকে বলা আছে মনে হলো। এনামুলের লাইন পেতে দেরি হলো না। সব শুনে খেপে গেল সে:
-বাসা নিবি কি ব্যাটা! আমার এখানে থাকবি। আর যে কাজে আসছিস, সেটা বড় জটিল। ডেঞ্জারাস। তোকে বিপদে একাকী ছাড়া যাবেই না।

আমি ওর আন্তরিকতায় আপ্লূত হলেও বাস্তবতা মেনে বললাম:
-আমাকে একা কিছু কাজ করতে হবে। আলাদাভাবে থাকার প্রয়োজন আছে।

এনামুল তার কথাতেই অটল। সে বললো:
-ঠিক আছে, ঠিক আছে। লালমাটিয়ায় আমার একটি ফ্ল্যাট খালি পড়ে আছে। ফুল ফারনিশড। ওখানেই তুই থাকবি। পাক্কা।

আমি শেষবারের মতো ওকে আমার চয়েজের কথা জানিয়ে দিই:
-আমি কিন্তু একদম নিজের মত থাকতে চাই। নিজের খাওয়া-দাওয়া, চলা-ফেরা, সব কিছুতেই স্বাধীনতা ও নিয়ন্ত্রণহীনতা লাগবে।

তবুও নাছোড় এনামুল:
-হবে হবে। ছ’ মাসের জন্য তুই-ই ফ্ল্যাটের মালিক। আমি মাঝে মাঝে বেড়াতে যাব। হলো তো?

এরপর আর কথা বাড়ানো যায় না। এনামুল বড্ড আগ্রহ দেখাচ্ছে। বাল্যবন্ধুর টান। একদিক দিয়ে ভালোই হল। একাকী থাকলেও যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন থাকতে হচ্ছে না। এনামুল আশেপাশে আছে ভাবলে আস্থা পাওয়া যায়। প্রশাসন, পুলিশ বা অন্য কোনও ঝামেলা হলে সে এক লহমায় মুশকিল আসান করে ফেলবে। বাংলাদেশের বাস্তবতায় এনামুল খুবই চোস্ত ও কাজের আদমি। ঢাকার ব্যবস্থা পাকাপাকি করায় নিশ্চিন্ত হওয়া গেল। এখন শুধু গুছিয়ে চলে যাওয়াটাই বাকী। আরেকটি গভীর উপন্যাসের মধ্যে ডুবে যাওয়ার অপেক্ষা। মনে মনে এক ধরণের তারুণ্যময় রোমাঞ্চ অনুভব করছি। পুরো ব্যাপারটিই বেশ চ্যালেঞ্জিং লাগছে।  

সারা দিন এখানে ওখানে ছুটতে ছুটতে বিকেল শেষ হয়ে গেল। সন্ধ্যার মুখে বাসায় পৌঁছে জানালায় সামনে বসে উত্তর আমেরিকার বিখ্যাত সামারের রোদ দেখছি। আলো আস্তে আস্তে মেপল বীথির আড়ালে মরে যেতে দেখা যাচ্ছে। দামাল বাতাস সারা দিনের আলোর বাগানকে রাতের ঠিকানায় ভাসিয়ে নিচ্ছে। এখন ছায়া গাঢ় হতে হতে ঘোলা পৃথিবী। পৃথিবীর শরীর চুঁইয়ে বেরুনো অন্ধকারকে এই সময় অনুভব করা যায়। প্রকৃতির পালাবদল দেখতে দেখতে অদ্ভুত বিষণ্ন আরামে চারপাশ ছেয়ে গেল। ধীরে ধীরে আকাশে চাঁদ উঠল। আর তখনই পৃথিবীটা অন্য রকম হয়ে গেল। গাছগাছালি, পার্ক, ঘাস-মাঠ আর অপূর্ব নীল আকাশকে জোছনায় স্নান করাতে সোনার থালার মতো চাঁদ পৃথিবীর সামান্য ওপরে গুঁড়ি মেরে উঠে এসেছে। একদম নিটোল নারীর মতো চাঁদ। এই মুহূর্তে নিজের শরীরের আলোয় সে আলোকিত। এমন উদাসীনা নারীর খবর একমাত্র শুক্লপক্ষই দিতে পারে। ক্রমশ সেই তিরতিরে জোছনায় ভেজা অলৌকিক প্রকৃতির দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে একটা তীব্র আকর্ষণ বুকে পৌঁছে গেল। মার্গারেটের কথা মনে পড়ল। এমন এক মায়াময় ভুবন নিয়ে পৃথিবীতে তার জন্য কেউ কি কোথাও অপেক্ষা করছে? কে জানে!

আসলে সবাই তো নিজের বিবরে আবদ্ধ। মানুষ শত চেষ্টা করলেও এক জীবনের বেশি বাঁচতে পারে না। যা কিছু প্রয়োজন তা যত জরুরিই হোক সেই জীবন শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই ফুরিয়ে যায়। এটাই নিয়ম। নিয়ম ভাঙার ক্ষতির জন্য তোয়াক্কা করে করেই জীবনে অনেক কিছু করা হয় না। আমি সেই ভয়ে থেমে থাকব না। জীবনের আড়ালের জীবনকে বুকে টেনে নেব। নিয়মবিহীন কোনও অপূর্বের দ্বারে হাত পেতে দাঁড়াব। দেখব আলোকের উল্লাস। এই তো বেঁচে থাকার নেশা। যারা ভুল নেশায় সহসা হারিয়ে যাচ্ছে ঝাপসা সুদূরে কিংবা ধূসর মাঠের মধ্যে বিলীন হয়ে যাচ্ছে পান্থপাদপের মতো; একটি পাখির শিস হয়ে ওদেরকে বলতে হবে, ‘ফিরে এসো, যেও না, যেও না। দেখে যাও, তোমাদের নীল-রঙা চির-নিরুদ্দেশে যাওয়ার আগে অনেক বসন্তখেলা বাকি রয়ে গেছে...। ’ (চলবে)

বাংলাদেশ সময়: ১১৪৫ ঘণ্টা, আগস্ট ২৩, ২০১৭
জেডএম/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।