বাংলাদেশে চলচ্চিত্রের যে অন্ধকার যুগ আজও চলছে তা থেকে উত্তরণের পথ আবিষ্কার করতে হলে আমাদের হলিউড-বলিউড-টালিউড সিনেমার আঙ্গিক অনুসরণ না করে বাংলাদেশের যুগোত্তীর্ণ সিনেমাগুলোর দিকে দৃষ্টিপাত করতে হবে। এর ভিতরেই লুকায়িত আছে বাংলা চলচ্চিত্রের সুফলা বীজ।
এই চলচ্চিত্রটির বিষয় নির্বাচন থেকে শুরু করে সর্বত্র যে ছাপ বিদ্যমান তা ব্যতিক্রমী। এছাড়া উপস্থাপনার ভঙ্গি এতোটা সাবলীল ও শৈল্পিক যেটাকে বাস্তবতা থেকে বিচ্ছিন্ন করা দূরুহ। পুরো সিনেমায় এগারো দফার উপস্থাপনা নির্দেশ করে চলচ্চিত্রটির চিত্রনাট্য ১৯৬৮-৬৯ এর গণঅভ্যুত্থানকে কেন্দ্র করে রচিত। মাতৃভাষার জন্য শহীদের দ্বারা উজ্জীবিত একটি জাতির সংগ্রামের গল্প এতো সুন্দরভাবে আর কোনো চলচ্চিত্রে উঠে আসেনি। এমনকি বিশ্ব চলচ্চিত্রের ইতিহাসে চলমান সময়ের রাজনৈতিক অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে এমন সাহসী ও শৈল্পিক উচ্চারণ আছে কিনা বলা মুশকিল। এখানে এমন এক সংগ্রামের কথা উঠে এসেছে, যে সংগ্রাম একটি জাতির মুক্তি সম্পর্কে ভবিষ্যৎ বাণী করেছে।
আমরা বিদ্রোহী কবিতার কথা শুনেছি, বিদ্রোহী কবির কথা শুনেছি; তবে বিদ্রোহী চলচ্চিত্রকাররাও যুগে যুগে সমাজের অনিয়ম, কুসংস্কারের বিরুদ্ধে লড়াই করে গেছেন। বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে যদি বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম হন, তাহলে নিঃসংকোচে বলা যায় বাংলা চলচ্চিত্রে বিদ্রোহী চলচ্চিত্রকার জহির রায়হান।
সিনেমাটির শুরুতেই রহস্যময় কয়েকটি বাক্যের আগমন আপনাকে সতর্ক করে দেবে, আপনি কী দেখতে যাচ্ছেন? তাই সচেতন হোন, মনোযোগী হোন। কেননা, শুরুর শ্লোগানটিতেই উল্লেখ করা আছে সিনেমাটির ভিতরে কী আছে।
একটি দেশ
একটি সংসার
একটি চাবির গোছা
একটি আন্দোলন
একটি চলচ্চিত্র...
এই শ্লোগানটি সাদামাটা কিংবা খাপছাড়া মনে হতে পারে আপনার কাছে। কিন্তু চলচ্চিত্রটির একেকটি দৃশ্য ধীরে ধীরে গ্রন্থিমোচন করবে সবকিছুর। দর্শক মুগ্ধ হয়ে সিনেমাটি দেখা শেষ করবে। সুখের সমাপ্তি। তবে এতে করে কী সবাই খুশি হবে? সবাই আনন্দিত হবে? না, এখানে আনন্দিত হওয়ার কিছু নেই। চলচ্চিত্রটি উপভোগ করার পরে টগবগ করে ফুটে উঠবে রক্ত, সংগ্রামী আবেশে পতিত হবে মন, দেশাত্মবোধের মাত্রা এক লাফে আকাশ ছুঁয়ে ফেলবে। এটাই 'জীবন থেকে নেয়া' চলচ্চিত্রের শক্তি, এটাই জীবন থেকে নেয়ার বিশেষ বৈশিষ্ট্য। জীবন থেকে নেয়া শুধুমাত্র উপভোগের জন্য নির্মিত কোনো সাধারণ চলচ্চিত্র নয়, এটি একটি মুক্তি আন্দোলনের গতিসঞ্চারক চিত্রকল্প।
সিনেমার শুরুতেই একুশে ফেব্রুয়ারির প্রভাতফেরিতে উজ্জীবিত তরুণদের দাবি আপনাকে জানান দেবে কী হতে চলেছে সিনেমাটিতে। কিন্তু না, আপনি যা ভাবছেন তা নয়। তার পরেই এক স্বৈরাচারী নারীর আগমন আপনাকে জানান দেবে যা দেখছেন তা শুধু উপর থেকে দেখলে হবে না, ভিতর থেকে দেখুন। চলচ্চিত্রটিতে মুক্তি ও চাবির গোছার রূপকতা স্পষ্ট, শক্তিশালী ও রাজনৈতিক।
সিনেমাটির গল্পে উঠে এসেছে সেসময়ের ঢাকার মধ্যবিত্ত দু’টি পরিবারের চিত্র। এক পরিবারে দুই ভাই আনিস ও ফারুক, তাদের বড়বোন এবং তার স্বামী। আনিস ওকালতি করে, ফারুক ছাত্র ও রাজনৈতিক সচেতন সংগ্রামী যুবক, তাদের বড়বোন সংসারের চাবির গোছার মালিক এবং দুলাভাই আদালতের মুহুরি। পরিবারটিতে দজ্জাল বড়বোনের বেজায় দৌরাত্ম্য। তার প্রভাবের কারণে পরিবারের কেউ টু শব্দটি করতে পারে না।
আরেকটি পরিবারে দুইবোন সাথী ও বীথি, তাদের বড় ভাই ও গৃহকর্মী মধু। সাথী-বীথির ভাই রাজনৈতিক আন্দোলনের কর্মী, দেশের কথা চিন্তা করেই তার দিন পার হয়, দেশের কথা ভাবতে ভাবতে বিয়েও করা হয়নি তার।
এই দুই পরিবারের ভিতর গল্পের শুরুটা ফারুক-বীথির প্রেম দিয়ে হলেও ঘটনা জমে ওঠে যখন আনিস-ফারুকের দুলাভাই তার দজ্জাল বউয়ের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়। অতি গোপনে আনিস ও সাথীর বিয়ে হয়। কিন্তু এই বিয়ের পরে স্বৈরাচারী বড়বোন সাথীর উপর নির্যাতন করতে থাকে। এই নির্যাতনের প্রতিবাদ করার জন্যে ফারুক বীথিকে বিয়ে করে ঘরে তোলে। বাড়ির সবাই একজোট হয়। তবু স্বৈরাচারী বড়বোনের কূটচালের অভাব পড়ে না। চাবির গোছা ছাড়লেও দুষ্টু বুদ্ধিতে সাথীকে ফাঁসিয়ে দেওয়ার চক্রান্ত করে। তবে শেষমেষ কঠিন পরিণতি ভোগ করতে হয় তাকে।
জহির রায়হানের গল্পে ও পরিচালনায় "জীবন থেকে নেয়া" চলচ্চিত্রটি আমাদের জাতীয় স্বত্বার সাথে মিশে গেছে। জহির রায়হান অতি সচেতনভাবে তার উদ্দেশ্য সফল করতে সফল হয়েছে। কেননা পাকিস্তানি স্বৈরাচারী ও পক্ষপাতদুষ্ট শাসককে টেক্কা দিয়ে সিনেমাটি শেষপর্যন্ত মুক্তি পায় ১৯৭০ সালের এপ্রিলে। সিনেমাটি পরিচালনায় ও শক্তিশালী চরিত্র সৃষ্টিতে সে সফল। এক চরিত্রকেন্দ্রিক বৃত্ত অংকন না করে জহির রায়হান কয়েকটি চরিত্রকে খুব সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন।
সিনেমাটির সংগীত পরিচালনা করেছে খান আতাউর রহমান। স্বাধীনতার পূর্বে বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত সর্বপ্রথম এই সিনেমাটিতে একটি সাধারণ গান হিসেবে ব্যবহৃত হয়। এছাড়া বিখ্যাত ভাষা আন্দোলনের গান, স্বৈরাচার বিরোধী গান, নজরুলের সংগ্রামী গান সিনেমাটিতে স্থান পেয়েছে। প্রতিটি গানই এখনও দেশপ্রেমিকদের উৎসাহ দান করে যাচ্ছে। খান আতাউর রহমান সিনেমাটিতে শুধু সঙ্গীত পরিচালনা করেছেন তা নয়। সিনেমাটির একটি গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রে অভিনয়ও করেছেন। আনিস-ফারুকের দুলাভাই হিসেবে নিজের অভিনয় দক্ষতাকে স্বার্থকভাবে উপস্থাপনা করেছেন খান আতাউর রহমান। এমনকি সিনেমার শেষ পেঁচানো দৃশ্যকে সোজা করেছে এই সংগ্রামী কিন্তু ভীতু চরিত্রটি। এছাড়া সবাইকে অবাক করে বাড়িতে নিজের বউ রওশন জামিলের বিরুদ্ধে পোস্টার লাগানোর দৃশ্যটি চলচ্চিত্রের রূপকতাকে গভীর করেছে।
ফারুক-বীথি চরিত্রে চলচ্চিত্রটিতে অভিনয় করেছে রাজ্জাক ও সুচন্দা। রাজ্জাক একজন টগবগে যুবক। মিছিলেই তার সঙ্গে পরিচয় সুচন্দার। সেখান থেকেই প্রেম। প্রেমিক হিসেবে তার অবস্থান যেমন স্পষ্ট, তেমনি দেশে চলমান সংগ্রামে সে অনড়। তার যুদ্ধ শুধু বীথির ভাইয়ের মতো বাইরে নয়, সে যুদ্ধ করেছে গৃহে তার দজ্জাল বড়বোনের সঙ্গে কিংবা তার স্ত্রী বীথির সঙ্গেও। তবে সিনেমাটিতে সবচেয়ে প্রভাবশালী সংগ্রামীর ভূমিকাটিতে অভিনয় করেছেন আনোয়ার হোসেন। রাজনীতির সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত তিনি, এ কারণে তাকে মাঝে মধ্যেই জেলে যেতে হয়। আনোয়ার হোসেনের মুখ থেকে চলচ্চিত্রটিতে সবচেয়ে শক্তিশালী সংলাপগুলো উচ্চারিত হয়েছে।
সিনেমাটিতে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র মধু। সে আনোয়ার হোসেনকে বার বার দেশের কথা ভাবতে নিষেধ করেছে। অথচ, সে নিজেই একদিন সংগ্রামীদের সঙ্গে মিছিলে যোগ দেয়। অবশ্য সে মিছিল থেকে মধুকে ফিরিয়ে আনা গেলেও চলচ্চিত্রে আর ফিরতে পারেনি।
সাথী চরিত্রে রোজি সামাদকে একজন সর্বংসহা, কুসংস্কারে বিশ্বাসী নারী হিসেবে দেখা গেছে। অন্যদিকে বীথি চরিত্রে সুচন্দাকে রোমান্টিক, বিদ্রোহী, আত্মত্যাগী স্বভাবসুলভ নারী হিসেবে দেখা গেছে। এই দুই বোনের ভিতর রসায়ন জমে ওঠে চলচ্চিত্রের শেষের দিকে। চক্রান্তের স্বীকার হয়ে শেষপর্যন্ত এক বোন আরেক বোনকে বিষ খাওয়ে দেওয়ার মাধ্যমেই ঘটনার সূত্রপাত হয়। অন্যদিকে, আনিস চরিত্রে শওকত আকবর শেষ মুহূর্তে সংগ্রামী হয়ে উঠে জানান দিয়েছেন, স্বৈরশাসকের অধীনে থাকা সবচেয়ে নিরীহ এবং ভীতু মানুষটিও সংগ্রামী হয়ে উঠতে পারে।
বাংলাদেশ সময়: ০৯২৩ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ০১, ২০১৭
এসএনএস