কবি লিখছেন, “লাক্স সাবান যেভাবে তোমাকে ছুঁয়েছে/ আমি সেভাবে ছুঁইনি। মেডলিন লিপস্টিক যেভাবে তোমাকে চুমু খেয়েছে/ আমি সে সুযোগ পাইনি’’।
অতএব শুধু নারী নয়, পুরুষেরও মন কেড়েছে লিপস্টিক। তবে এই এই নির্দোষ সজ্জাবর্ধক ব্যাপারটিও কিন্তু খুব সহজে আসেনি। আজ থেকে প্রায় ৩৫ হাজার বছর আগে প্রাচীন ইরান ও কুয়েতে এর আগমন শুরু হয়। সুমেরিয়ান রানি সর্বপ্রথম লাল পাথুরে অংশ ও লেড দিয়ে লিপস্টিক বানানো হলে তা ব্যবহার করেন। তার প্রায় ৫শ বছর পর সিন্ধু উপত্যকার মেয়েরা শৈবাল থেকে লালচে-বেগুনি রঙের লিপস্টিক তৈরি করেন। আর সবথেকে বড় ব্যাপার, প্রাচীন মিশরের রানি ক্লিওপেট্রার লাল রঙের লিপস্টিক পরাটা ছিলো সে সময়ের একটা নিদর্শন। তিনি তার লিপস্টিক প্রস্তুতিতে মেরুন রঙের বিটল (পোকা), পিঁপড়ে, মাছের আঁশ, ছারপোকা, মধু, ফুলের পাপড়ি, মোম ইত্যাদি ব্যবহার করে অপূর্ব লাল রঙের লিপস্টিক বানানোর প্রথায় আগ্রহী ছিলেন।
এই শুরু হলো লিপস্টিকের প্রসার। কিন্তু কোথাও কোথাও মিশরে দেহব্যবসায়ীদের ট্রেডমার্ক হতে থাকল লিপস্টিক এবং প্রায় এটাকে সমাজে অপরাধমূলক চিহ্নিত করা হচ্ছিল। মধ্যযুগের মাঝামাঝি চার্চগুলোতে প্রচারিত হতে থাকল যে, ঈশ্বরের প্রদত্ত দেহে যেকোনো সাজসজ্জাই পাপ অতএব লিপস্টিকও এর মধ্যে দোষী। এবং সেই সময়ের কিছু চিত্রে দেখানো হতো, অপদেবতা বা রাক্ষস কোনো মেয়েকে লিপস্টিক দিচ্ছেন। তবে এই সব ভাবনাকে দূরে ঠেলে ষোড়শ শতাব্দীতে একরকম প্রতিবাদ এনে দিলেন ইংল্যাণ্ডের প্রথম রানি এলিজাবেথ। তিনি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতেন, লিপস্টিকের কোনো জাদু ক্ষমতা আছে যা মৃত্যু বা অসুস্থতাকে দূর করতে পারে। অথচ নিদারুণ পরিহাস, তার মৃত্যু হয় লিপস্টিকের লেড বিষক্রিয়ায়। মৃত্যুর সময় তিনি বারবার আরও বেশী করে লিপস্টিক ব্যবহার করতেন কী এক অপার্থিব বিশ্বাসে— এই সেই “কিস অফ ডেথ”। মুঘল রাজত্বেও মেয়েরা ঠোঁটের রং নিয়ে চিন্তিত হয়ে পড়ে। তারা অবশ্য পান খেয়ে ঠোঁট লাল করতো, ফলে দাঁতের ক্ষয় শীঘ্র শুরু হতো। রানি ভিক্টোরিয়া অবশ্য লাল রঙের লিপস্টিক ব্যবহারকে খারাপ অভ্যাস এবং শিষ্টাচারহীনদের অন্তর্গত করেছিলেন। কিন্তু বিংশ শতাব্দীতে বিষয়টা ব্যাপক হয়ে উঠল নিউ ইয়র্কে রাস্তায় মেয়েদের স্বাধীনতার প্রসঙ্গ এনে, ১৯১২ সাল নাগাদ মেয়েরা গাঢ় লাল রং লাগিয়ে রাস্তায় নামল লিপস্টিক ব্যবহারের জন্য। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ নাগাদ হিটলার জানিয়ে দিলেন, মেয়েদের লাল লিপস্টিক পরা তিনি পছন্দ করেন না, তার আশেপাশে যেনো এরকম মেয়ে না দেখা যায়! আর চার্চিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় লিপস্টিকের বিক্রি বন্ধ করেছিলেন কারণ, তার মনে হয়েছিল এটা মেয়েদের নীতিগতভাবে বদলে দিতে পারে। মধ্য পঞ্চাশের একটি পত্রিকা অবশ্য এর ভাবমূর্তি বদলে দিতে চায়। একে জোরালো, যৌন সংবেদন, প্রত্যয়ের চিহ্ন হিসেবে দেখা হতে থাকে। তবে মেরিলিন মনরো, এলিজাবেথ টেলরদের ব্যবহারের মাধ্যমে লিপস্টিকও সেলিব্রেটি হতে শুরু করে। বর্তমানে পপতারকা ম্যাডোনা লিপস্টিকের ধারাবাহিকতাকে ধারালো করার দলে। মেরিলিন মনরোর ব্যবহৃত সেই জোরালো মায়াময় লিপস্টিক এতোটাই প্রভাব ফেলেছিল যে, তাঁর মৃত্যুর প্রায় ৫৪ বছর পরে নিলামে তার দাম শুনলে চমক লেগে যায়।
রোমের রাজা ও রানি উভয়ই ব্যবহার করতেন লিপস্টিক এবং সেখানে কেবল উঁচুস্তরের ব্যক্তিরাই তা ব্যবহার করতে পারতেন। জর্জ ওয়াশিংটনও লিপস্টিক ব্যবহার করতেন। শিকাগোর এক সিরিয়াল কিলার উইলিয়ম হেইরেন্স “লিপস্টিক কিলার” নামে পরিচিত ছিলো। খুন করে খুনের জায়গায় লিপস্টিক দিয়ে দেয়ালে লিখতেন, “ FOR HEAVEN’S SAKE, CATCH ME BEFORE I KILL MORE— I CANNOT CONTROL MYSELF”। ১৯১৫ সালে এরকম একটা আইনি প্রস্তাবনা আসে যে, ৪৪ বছরের নিচের নারীরা লিপস্টিক পরতে পারবেন না। যা হোক সেই আইন পাশ হয়নি। সপ্তদশ শতাব্দীতে অবশ্য পেনসেলভেনিয়ায় এরকম আইন হয় যে, সেটি বিয়ে হিসেবে গণ্য হবে না যেখানে বিবাহযোগ্য কনে যদি সেজে আসে বিশেষত সে যদি লিপস্টিক ব্যবহার করে। কারণ, মনে করা হতো এই লিপস্টিক নারীর মোহময় রূপ সৃষ্টি করে সম্ভবত বা এটা কোনো ডাকিনীবিদ্যার উপাদান যা দিয়ে পুরুষদের ক্ষতি হতে পারে (পুরুষতন্ত্রের চূড়ান্ত চপেটাঘাত)।
এখনকার বিজ্ঞান অবশ্য অন্যগল্প বলে যে, পুরুষ ও নারীর সুন্দর সম্পর্ক বজায় রাখতে নাকি লিপস্টিক অনুঘটক। পরীক্ষা করে দেখা গেছে, লাল লিপস্টিক পরা কোনো নারীর সঙ্গে যতো সহজে একটি পুরুষের সম্পর্ক তৈরি হয় অন্যক্ষেত্রে সেটা নয়। রং আসলে জীবনের প্রতিমাত্রার যে বদল তার সংকেত, আবহাওয়ার মতো। রং তো মানুষের মনের হদিশও দিয়ে দেয়... সেই রঙে রাঙানো মানেই নিজেকে তুলে আনা বা আলোড়িত যাপনের গ্লাসে চামচ নাড়িয়ে দেওয়া। আমাদের মনের যেমন নানা রূপ আছে, এই প্রকৃতিরও তাই। আমরা তো বাইরে থেকে কিছু ধার নিতে পারি না। এখানেই দেখি এখানেই অনুকৃতি করে। ভাবুন সামান্য এই প্রসাধন দ্রব্য তা কত অশান্তির মধ্য দিয়ে এসে করতলগত হয়েছে প্রায়। তা নিয়ে নারীদের চরিত্রও বিচার হচ্ছে। অথচ জিনিসটা কিছুই না আমাদের সাদামাটা জীবনকে যেমন আমরা মরে যাব জেনেও কাজে-কর্মে স্বপ্নে ভোলাই, এটা তার একটা ছোট প্রক্রিয়া। হয়তো-বা ব্যক্তির নিজেকে মূর্ত করার আলো। এই লিপস্টিকের ব্যবহারের জন্য বাণিজ্য কীভাবে ফুলে–ফেঁপে উঠেছে সমস্ত দুনিয়ায় তা ভাবলে অবাক লাগে বৈকি ।
ব্রিটিশ অভিনেত্রী অড্রে হেপবার্ন বলেছেন, “I BELIEVE IN MANICURES. I BELIEVE IN OVERDRESSING. I BELIEVE IN PRIMPING AT LEISURE AND WEARING LIPSTICK”।
লেডি বার্ড জনসন (ফার্স্ট লেডি অব ইউএস) বলেছেন, “FLOWERS IN THE CITY ARE LIKE LIPSTICK ON A WOMAN— IT JUST MAKES YOU LOOK BETTER TO HAVE A LITTLE COLOR”।
১৭৭০ সালে যখন লিপস্টিকবিরোধী আইন লাঘু করা হয় তখন এর বিরুদ্ধে প্রধান কারণ ছিলো, এটি কোনো জাদুবিদ্যা বা ডাকিনীবিদ্যার উপকরণ। অবশ্য বিদেশে অনেক নারী তন্ত্রবিদ রয়েছেন যারা স্বঘোষিত, তারা বলেছেন লিপস্টিক তাদের শক্তির অংশ, আত্মস্থ বা মূর্ত অস্তিত্বকে জানান দেওয়ার প্রকাশভঙ্গি।
মোট কথা সে যাই হোক এই লিপস্টিক বোরখার বাইরে বা ভেতরে যেখানেই থাকুক তার প্রকাশভঙ্গি কিন্তু তুমুল। একে এড়িয়া যাওয়া নারী-পুরুষ কারোর পক্ষেই খুব সহজ নয়। আসলে যা সুন্দর যার রহস্যের হাতছানি আছে তাকে এড়ানো এতো সহজ নয়।
পৃথিবীর উপাদেয় সম্পর্ক, নারীর আত্মস্থ হওয়া, নিজেকে নিজের প্রিয় করে তোলা যদি এই লিপস্টিক হয় তবে তা দীর্ঘজীবী হোক...
বাংলাদেশ সময়: ১২২২ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ১৭, ২০১৭
এসএনএস