পাশের লোকের কথায় চিন্তায় ছেদ পড়ে। পচিশ-ছাব্বিশ বছরের যুবক, চেহারায় কিছুটা রুক্ষতার ছোঁয়া।
-বুধে যাবো।
-মানে! লোকটা ভ্রু কুচকায়।
- মানে আর কী, সব মানুষ তো মঙ্গলে যায়, বুধকে নিয়ে কারও আগ্রহ আছে! কারও কোনো মাথা ব্যথা নেই। আমার আছে। আমি বুধে যাচ্ছি। বুধ গ্রহ।
যুবকটা ফ্যালফ্যাল করে তাকায়। হাসানের আগামাথা, ওপর থেকে নিচ ভালো করে তাকিয়ে দেখে। একটু সময় পরই বলে ওঠে, স্যার, এ ট্রেন তো ঢাকার ট্রেন।
-হ্যাঁ, ঢাকার ট্রেন।
-বুধে যাবেন কীভাবে?
-ঢাকা থেকে ইন্ডিয়া যাবো। ইন্ডিয়া স্যাটেলাইট পাঠাবে মহাকাশে, সেই স্যাটেলাইটে ঝুলে যতোদূর যাওয়া যায় যাবো,তারপর বুধ গ্রহের কোনো যান পেলে সেখান থেকে চলে যাব সরাসরি বুধে। বুঝলেন।
-জ্বি, বুঝেছি। ঘাড় নাড়ে যুবক ছেলেটা।
কথা শেষ হয় না একজন ভদ্রলোক বেশ ভিড় ঠেলে হাসানের পাশে এসে দাঁড়ায়। মাঝারি গড়ন। হালকা শরীরের চল্লিশোর্ধ্ব মানুষ। ট্রেনে সাধারণত এতো ভিড় হয় না, আজ কেন জানি অনেক ভিড়। অনেক মানুষ।
-দেখি টিকিট দেখান? হাসান টিকিট খোঁজে। পকেটেই ছিলো। নাহ পকেটে টিকিট নেই।
-স্যার, টিকিটটা হয়তো পড়ে গেছে।
-মানে!
-বাথরুমে পড়ে যেতে পারে।
-ফাজলামি বাদ দিন, টিকিট দেখান না হলে টাকা দিন।
এদের সঙ্গে কথা বলে কোনো লাভ হবে না। হাসান পকেট থেকে টাকা বের করে দেয়। কিন্তু টিকিটটা যাবে কোথায়। বাথরুমে খোঁজা দরকার। যদি টিকিট দেখিয়ে টাকাটা ফেরত নেওয়া যায়। নিজের আসন ছেড়ে বাথরুমের দিকে ছোটে। বাথরুমের সামনে যেতেই হাসান ভড়কে যায়। ভুল দেখছে না তো সে! চোখ কচলায়, আবার তাকায়, হ্যাঁ, তাপসীই। ঠিক চার বছর আগে বাসস্ট্যান্ডে দেখা, আজ চার বছর পর দেখা ট্রেনের ভেতর। মাঝখানে চারটা বছর। বছর কী! কে বানিয়েছে? হয়তো মানুষ তার নিজের প্রয়োজনে সময়ের স্তূপকে সাজিয়েছে বছর, মাস, সপ্তাহ, দিন দিয়ে। সেগুলো কখনও সুখের, কখনও দুঃখের বা তিক্ত অভিজ্ঞতায় ভরা। সময় কী? হাসানের মাথাটা ঘুরে ওঠে। এতোসব আজেবাজে প্রশ্ন আজকাল মাথায় আসে, কেন আসে!
হাসানের জীবনটা তো ভালোই চলছিল। একটা ছোট চাকরি। বাবা-মা, ভাই-বোনের সংসারে অনেক কিছু প্রাপ্তির অভাব থাকলেও সেগুলো নিয়ে ভুগতে হয়নি। বুকের ভেতর ক্ষত হয়নি। জীবনটা ওলট-পালট হয়নি। তাপসী একটা মেয়ে, কেন এসেছিল? প্রথম দেখাতেই-বা কেন ভালো লেগেছিল ঠিক ওরকম। হাসান তো জানতো না তার বাবার অনেক ক্ষমতা, অনেক ধনী।
-ম্যাডাম। পেছনের ডাক শুনে ভড়কে পেছনে ফেরে মেয়েটা।
হাসান হাসে। আমি হাসান।
-জ্বি, আপনি হাসান। কিছু বলবেন?
বাসস্ট্যান্ডে অনেক মানুষের আনাগোনা। সবাই ছুটছে, ভিন্ন ভিন্ন, প্রতিটি মানুষের ভিন্ন ভিন্ন কাজ।
-আপনি না অনেক সুন্দর।
তাপসী কেন যেনো রাগ করে না। মুখে হাসি টেনে বলে, তাই নাকি?
-জ্বি।
-তা এ কথাটা এ পযর্ন্ত কতোজনকে বলেছেন?
হাসান শব্দ করে হাসে। হা হা হা। আশেপাশের চলন্ত মানুষগুলো চলার ফাঁকে ঘাড় ফিরিয়ে তাকিয়ে দেখে।
-আমার বন্ধুরা আমাকে হিজড়া বলে। কেন বলে জানেন?
-কেন? প্রশ্ন করে তাপসী।
-প্রেম করি না তাই।
-আমার সঙ্গে প্রেম করবেন? তাপসীর প্রশ্নে অবাক হয় হাসান।
বুকের ভেতর মোচড় দেয়। কিছু ব্যথা, কিছু আনন্দ একসঙ্গে মিশে হঠাৎ হাসানকে শান্ত আর নির্জীব করে দেয়। – হ্যাঁ, করবো। ঘাড় নাড়ে হাসান।
-বিয়ে করবেন?
-হ্যাঁ।
-তাহলে চলুন।
সত্যি সত্যিই হাসান আর তাপসীর বিয়ে হয়! বিষয়টা মাস খানেক গোপন থাকেনি। তাপসীর ধনী বাবা হাসানের মতো মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তানকে কীভাবে জামাই হিসেবে মেনে নেন? তাপসীকে আর দেখা যায় না, ফোন বন্ধ। হাসান দিগ্বিদিক পাগলের মতো ঘুরে বেড়ায়। রাতের বেলা রাস্তা ধরে হাঁটে, যেনো এক নিশাচর উন্মাদ। জোছনা রাতে সেদিন খোলা মাঠে বসেছিল হাসান, চাঁদের ভেতর কি তাপসী বসা! আবছা কালো কালো! একটা গাড়ির কড়া ব্রেকের ক্যাচ ক্যাচ শব্দে হাসান রাস্তার দিকে ফিরে তাকায়। কায়েকজন লোক তার দিকে জোর পায়ে হেঁটে আসে।
–আপনি হাসান? সব ক’জন পুলিশ।
-জ্বি।
-তাপসীকে বিয়ে করেছেন?
-হ্যাঁ। হাসান ঘাড় নাড়ে। কথা শেষ হতেই কয়েকজন হাসানকে শক্ত করে ধরে। যেনো একটা চোর ধরছে। চোর পেয়েছে।
হাসানকে থানা-পুলিশ থেকে জেল-হাজত, আদালত সব মাড়াতে হয়। তার অপরাধ, তাপসী প্রাপ্তবয়স্ক নয়। সার্টিফিকেটের বয়স ষোল বছর। কিছু দিন পর পর হাজিরা দিতে হয় আদালতে। টাকা দিতে গিয়ে বাবার রোজগারের চারকাঠা জমিও বিক্রি করতে হয়েছে। দু’বছর পর আজ জামিনে ছাড়া পেয়ে যখন নতুন কিছু করার সন্ধানে ছুটছে, সেখানে তাপসী! মনের অজান্তেই বুকের ভেতর থেকে বের হয় একটা ডাক, আতর্নাদ- তাপসী।
তাপসী তাকায়।
-আমার তাপসী, তুমি কীভাবে পারলে এমন…?
-প্রলাপ বকবেন না প্লিজ। অনেকটা ধমকের সুর তাপসীর কণ্ঠে।
-না, তাপসী না, তুমি এমন বলতে পরো না। হাজার চড়াই উৎরাই পেরিয়ে আজ যখন তোমায় পেয়েছি ঠিক সে সময় তুমি বলছো!
-এটা নতুন কিছু নয়, আমি কোনোকালে আর কোনোদিন আপনাকে ভালোবাসিনি।
-বাহ! যাক, আমি তো বেসেছিলাম।
-সেটা আপনার ব্যাপার। আমার স্বামী আছে।
-আমি তো তোমাকে তালাক দেইনি, আমিই তো তোমার স্বামী।
তাপসী হনহন করে হেঁটে যায়। একবারের জন্যও পেছন ফেরে না। এই মেয়েটাই একদিন বলেছিল, আমি শুধু তোমার। সারা জীবনের জন্য তোমার। জীবনের সংজ্ঞা কী? সারা জীবনের? হাসানের মাথাটা ঘুরে ওঠে। সঙ্গে সঙ্গে কেউ পেছন থেকে ধাক্কা দেয়। চলন্ত ট্রেন থেকে ছিটকে পড়ে হাসান। রাতের অন্ধকারটা শেষবারের মতো দেখে নেয়। মাথায় প্রচণ্ড একটা আঘাত, হাত-পা, গোটা শরীর কাটাছেড়ার অনুভূতি। রক্তের কণিকাগুলো কাঁপে, তীর তীর করে। লাফায়, দাপায়। চোখ দু’টো বুজে আসে। হাসান অবচেতন মনেই বলে, জীবন কী?
বাংলাদেশ সময়: ১২৫৩ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ২৬, ২০১৭
এসএনএস