ক্যালেন্ডার জানাচ্ছে আজ ২০ আশ্বিন বৃহস্পতিবার মোতাবেক ৫ অক্টোবর। আর ক’দিন পরেই কার্তিকের শুরুতে আসবে বিষণ্নতার ঋতু হেমন্ত।
সকালের মুখে দাঁড়িয়ে থেকে আমি শিহরিত হচ্ছি এই ভেবে যে, ঠিক এইখানে, পাঁচ শ’ বছর আগে, একজন নারী কবি কাব্যচর্চা করেছিলেন। মধ্যযুগের অন্ধকার প্রকৃতিতে হয়ত মাটির প্রদীপ জ্বেলে তিনিও শিহরিত হয়েছিলেন বাংলা বর্ণমালার স্বর আর ব্যঞ্জণ ধ্বনিগুলোর মায়াময় স্পর্শে। তাঁর নাম চন্দ্রাবতী। তাঁকে বলা হয় বাংলা সাহিত্যের প্রথম নারী কবি।
কিশোরগঞ্জ শহর থেকে উত্তর-পূর্ব দিকের সরু ও প্রায়-নির্জন যে পথটি সদর উপজেলার নিভৃত জনপদগুলোকে মাড়িয়ে চলে গেছে তাড়াইল উপজেলা হয়ে দূরবর্তী নেত্রকোণা, সুনামগঞ্জ, হবিগঞ্জের হাওরে, সে পথেই মাইল পাঁচেক এগিয়ে গেলে পাতুয়াইল গ্রাম। পাটোয়ারি নামেও কোথাও কোথাও উল্লেখিত হয়েছে গ্রামটি। গ্রামটির কথা বলতে গিয়ে ‘ধারা স্রোতে ফুলেশ্বরী নদী বয়ে যায়...’ মর্মে একটি বর্ণনা চন্দ্রাবতী নিজেই দিয়েছিলেন। তাঁর মৃত্যুও হয়েছিল সে নদীর জলে। পাশাপাশি সেখানে ভেসে ওঠেছিল প্রেমিক জয়ানন্দের মরদেহটিও। ত্রি-সীমানায় এখন আর নদীর দেখা নেই। রেকর্ডে ফুলেশ্বরী নদীর খোঁজও পাওয়া যায় না। অনতিদূরে নরসুন্দা নদীর একটি ছোট্ট শাখা কোনক্রমে বয়ে চলেছে নীলগঞ্জ বাজারের পাশ দিয়ে। আর চন্দ্রাবতী রয়ে গেছেন স্মৃতির হীরন্ময় নায়িকা হয়ে ইতিহাসের বিবরণে ও পৌরাণিকতার লোকশ্রুতিতে।
৩২ বছর আগে চন্দ্রাবতীর ভিটায় প্রথম বার এসেছিলাম। সেটি ছিল ১৯৮৫ সালের শীতকাল। আমি তখন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালে ঢাকার দৈনিক ইত্তেফাক ভবনে নিউ নেশন, সাপ্তাহিক রোববার পত্রিকায় সাংবাদিকতা ও লেখালেখি করি। ইত্তেফাক তখন বাংলাদেশের প্রধান দৈনিক। ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক মরহুম আখতার-উল আলম একদিন বললেন, ‘তোমাদের এলাকায় যাবো। চলো। ’
সময়টি আজকের মতো আধুনিক আর যোগাযোগ এতোটা মসৃণ ছিল না। তখন টয়োটা পাবলিকা গাড়ির আমল। দুই দরজার ছোট্ট গাড়িতে কিশোরগঞ্জের এগারসিন্ধুর দুর্গ, জঙ্গলবাড়ির প্রাসাদ হয়ে আমরা গ্রামের মেঠো পথ আর কাঁচা রাস্তা ভেঙে এসে পৌঁছেছিলাম চন্দ্রাবতীর বাড়িতে। অনেকক্ষণ ছিলাম সেই প্রাঙ্গণে। ইতিহাস-অন্বেষী সাংবাদিক ও পরবর্তীতে রাষ্ট্রদূত আখতার-উল আলম ছিলেন দূরবর্তী উত্তরবঙ্গের রংপুর অঞ্চলের মানুষ। পূর্ববঙ্গের মানুষ আর প্রকৃতিকে তিনি গভীর মনোযোগের সঙ্গে পর্যবেক্ষণ করেছিলেন সেই সফরের সময়। এক সময় তিনি আমাকে বলেন, “জানো তো আমি ইত্তেফাকে ‘স্থান-কাল-পাত্র’ নামে একটি উপ-সম্পাদকীয় কলাম লিখি ‘লুব্ধক’ ছদ্মনামে?”
“নিশ্চয় জানি”, আমি উত্তর দিই, “কলামটি খুবই জনপ্রিয় এবং ‘লুব্ধক’ হলো একটি তারকার নাম। ”
তিনি হাসলেন। বললেন, “এটা কি জানো, ‘লুব্ধক’ নামটি আমাকে কে দিয়েছেন?”
“না। ” আমি আমার অপারগতার কথা জানাই।
“রাহাত খান। ইত্তেফাকের নির্বাহী সম্পাদক ও বিশিষ্ট কথাসাহিত্যিক। আমার সহকর্মী। এই যে রাস্তাটি তাড়াইল উপজেলায় চলে গেছে, সেখানে জাওয়ার নামের একটি গ্রামে তাঁর বাড়ি। বড় জোর ৮/১০ মাইল দূরে। ”
তিন যুগের বেশি সময় পর আবার এসে সেসব দিনের কথা মনে পড়ল। আখতার-উল আলম সাহেব আর নেই। রাহাত খান সাহেব বয়োবৃদ্ধ। সেদিনের শীর্ষ স্থানীয় ইত্তেফাকও আগের মতো নেই। ঢাকার ইত্তেফাকের মোড় বলে প্রসিদ্ধ জায়গাটি থাকলেও পত্রিকাটি আর সেখানে নেই। রয়ে গেছে কেবলই স্মৃতি।
আমারও স্মৃতি উছলে ওঠে চন্দ্রাবতীর ভিটায়, চন্দ্রাবতীর কথায়। এবার অবশ্য সে বারের মতো এতো কষ্টকর হয় নি যাত্রা। পাকা রাস্তা চলে এসেছে চন্দ্রাবতীর ভিটা পর্যন্ত। জালালপুর বাজার থেকে হাতের বায়ে পাতুয়াল হয়ে নীলগঞ্জ আসা যায়। তারপর কিশোরগঞ্জ বা তাড়াইল, যেখানে ইচ্ছা যাওয়া সহজ। ময়মনসিংহের নান্দাইল চৌ-রাস্তা থেকেও সহজেই চলে আসা যায় চন্দ্রাবতীর স্মৃতিধন্য অঙ্গনে।
এসেই প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের নোটিশবোর্ড দেখা গেলো। নোটিশ দিয়েই মনে হয় সব দায়িত্ব সেরেছে কর্তৃপক্ষ। অধিদপ্তরের তেমন কোন নজরদারি না থাকায় ইতোমধ্যে শিবমন্দিরের বহু মূল্যবান জিনিস চুরি হয়ে গেছে। জবর দখল হয়ে গেছে তার বসতবাড়িটি। চন্দ্রাবতীর স্মৃতিবিজড়িত শিবমন্দির ও সংশ্লিষ্ট এলাকাকে পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে ঘোষণার দাবি উত্থাপিত হলেও তা গ্রাহ্য করা হয় নি। আশপাশে অবক্ষয় ও ধ্বংসের ছাপ স্পষ্ট।
কবি ও নারী হিসাবে রোমান্টিক চন্দ্রাবতীর জন্মস্থান ও তাঁর শিবমন্দিরের দৈন্যদশা পীড়াদায়ক হলেও এর সংরক্ষণে তৎপরতা নেই বললেই চলে। ষোড়শ শতাব্দির স্থাপত্যশৈলীর নিদর্শন চন্দ্রাবতীর বাড়িটি পরগাছা, আগাছা ও উদ্ভিদের বাসস্থানে পরিণত হয়েছে। ক্ষয়ে যাচ্ছে ইট, দেয়াল। বসতবাড়িটি জবর দখল হয়ে যাওয়ায় কথাও বললেন আমাদের দেখে এগিয়ে আসা কয়েকজন স্থানীয় যুবক। কলেজ ছাত্র আহমদ রিফাত সিজান এগিয়ে এসে সব কিছু ঘুরিয়ে দেখায়। তার কথায় ক্ষোভ ও হতাশা। বলল, “বাড়িটিতে দর্শনার্থীদের প্রবেশাধিকারও সংরক্ষিত পর্যায়ে চলে গেছে। প্রায় ১০ একর জায়গা নিয়ে চন্দ্রাবতীর বাড়িটির অবস্থান হলেও অনেক জায়গা বেহাত হয়ে গেছে। তার বাড়িতে রয়েছে একটি বিশাল দোতলা ভবন। এ ভবনেই চন্দ্রাবতী বসবাস করতেন। ভবনটি এখন স্থানীয় এক প্রভাবশালী কব্জা করে সপরিবারে বসবাস করছেন। বিশাল এ বাড়িটির চারিদিকে নির্মিত প্রতিরক্ষা দেয়ালের অনেক জায়গায় ফাটল দেখা দিয়েছে। দেয়ালের অনেক জায়গার ইট-পাথর দুর্বৃত্তরা লুট করে নিয়ে গেছে। ”
তবে চন্দ্রাবতীর স্মৃতিবিজড়িত বাড়িটি সংরক্ষণের জন্য প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর উদ্যোগী হওয়ায় এবং প্রাঙ্গণে চন্দ্রাবতীর নামে একটি প্রাথমিক বিদ্যালয় থাকায় কিছুটা খুশি এলাকাবাসী। তারা চান, আরো নিরাপত্তা ও সংরক্ষণের ব্যবস্থা গ্রহণ করে ঐতিহ্যটিকে ধ্বংসের কবল থেকে রক্ষা করা হোক। নামে মাত্র প্রত্ন বা সাংস্কৃতিক সম্পদ বলে ঘোষণায় সন্তষ্ট নন এলাকার লোকজন।
দেখতে পেলাম মন্দিরসংলগ্ন স্থানে স্থাপিত হয়েছে কবি চন্দ্রাবতী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। জানা গেল, এই বিদ্যালয় মাঠে প্রতি বছর বৈশাখ মাসের এক তারিখে মেলা অনুষ্ঠিত হয়। কবি চন্দ্রাবতীর স্মৃতিকে ধরে রাখার উদ্দেশ্যে এলাকার তরুণদের উদ্যোগে গড়ে তোলা হয়েছে চন্দ্রাবতী স্মৃতি সংসদ। অতীতের দিনে, চন্দ্রাবতী কে? সেটা ব্যাখ্যা করে বুঝাতে হতো। এখন আর সেই দিন নেই। কিশোরগঞ্জ শহরেও দেখা গেলো চন্দ্রাবতী নামে একটি রেস্টুরেন্টের সাইনবোর্ড। বলা বাহুল্য, বাজার অর্থনীতির বিশ্বায়নের যুগে কালচারাল আইকন থেকে চন্দ্রাবতী এখন ব্র্যান্ডিং-এ পরিণত হয়েছেন!
পাঁচ শত বছরের পর আজ আর ফুলেশ্বরী নদীর কোন চিহ্ণ নেই। নেই সেদিনের আবহ। পালাবদলের টানে অনেক গ্রামই এখন বদলে যাচ্ছে। উন্নয়ন, নগরায়ন ও আধুনিকায়নের প্রতাপে তছনছ হচ্ছে প্রকৃতি, পরিবেশ, ইতিহাস ও ঐতিহ্য। বহু আঘাতেও টিকে থাকা কালের সাক্ষী চন্দ্রাবতীর স্মৃতিবিজড়িত শিবমন্দির ও বাড়িটি রক্ষা করা অপরিহার্য। এ কথা শুধু এলাকাবাসীরই নয়, ঐতিহ্য সচেতন প্রতিটি মানুষেরই।
আনুমানিক হিসাবে চন্দ্রাবতী মন্দিরটি ষোড়শ শতকের শেষ পাদে নির্মিত এবং এটি অষ্ট কোণাকৃতির। উচ্চতা ১১ মিটার। আটটি কোণার প্রতিটি বাহুর দৈর্ঘ ১.৭ মিটার। নিচের ধাপে একটি কক্ষ ও কক্ষে যাবার জন্য একটি দরজা রয়েছে। ভেতরে হয় শিবপূজা। নিচের সরলরেখায় নির্মিত অংশটি দু’টি ধাপে নির্মিত। নিচের ধাপের চারদিকে প্রায় অর্ধ বৃত্তাকার খিলানের সাহায্যে নির্মিত প্রশস্ত কুলুঙ্গী রয়েছে। নিচের ধাপে কার্নিশ পর্যন্ত উচ্চতা ২.৭০ মিটার। কক্ষের ভেতরে সাতটি জানালা সদৃশ কুলুঙ্গি রয়েছে যার প্রস্থ ৫২ সেন্টিমিটার এবং দৈর্ঘ্য ৯৯ সেন্টিমিটার। কিছু কারুকাজও আছে। কক্ষের ব্যাস ২.৩৫ মিটার। এর কার্নিশ বরাবর অনুচ্চ ছাদ রয়েছে। দ্বিতীয় ধাপটিও সরলরেখায় নির্মিত। এই পর্যায়েও অর্ধবৃত্তাকারের খিলানের সাহায্যে নির্মিত প্রশস্ত কুলুঙ্গি রয়েছে। কুলুঙ্গির ভেতরে একদা পোড়ামাটির অসংখ্য চিত্র ফলকের অলংকরণ ছিল যা আজ আর অবশিষ্ট নেই।
প্রথমবার এসে মন্দিরটি প্রায় ভগ্ন অবস্থায় পেয়েছিলাম। সে সময় প্রখ্যাত সাহিত্য সাময়িকী ‘শৈলী’তে আমি একটি সরেজমিন প্রতিবেদন লিখেছিলাম। এবার দেখতে পেলাম, আশেপাশে অযত্নের ছাপ থাকলেও মন্দিরটি নতুনের মতো ঝকঝক করছে। কিছুদিন আগে প্রত্নতাত্ত্বিক বিভাগ সংস্কার করায় এর প্রাচীন আমেজ আর নেই। এই ধরনের সংস্কার কতটুকু যুক্তিযুক্ত, সে প্রশ্নও আসে। প্রত্ন সম্পদের সংস্কার ও রক্ষণাবেক্ষণ অবশ্যই করতে হবে ঐতিহ্য ও অতীতের মেজাজকে ধরে রেখে। সাম্প্রতিক সময়ে চুনকাম করে এটিকে রাঙানো হয়েছে বলে এর প্রাচীনত্ব ম্লান হয়েছে। এতো কিছুর পরেও মন্দিরের শিবলিঙ্গটিও চুরি হয়ে গেছে বলে জানা গেলো। জাদুঘর ও প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের পক্ষ থেকে ‘মন্দিরটি প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের সম্পত্তি’ এই মর্মে ঝুলানো একটি মাত্র নিথর সাইনবোর্ড রক্ষণাবেক্ষণ এবং নিরাপত্তা জন্য মোটেও যথেষ্ট নয়।
চন্দ্রাবতীর পিতা দ্বিজ বংশীদাসও ছিলেন সহজিয়া-কবি। মধ্যযুগের স্বভাব অনুযায়ী রচনা করেছিলেন ধর্মকাব্য ‘মনসা মঙ্গল’। এ কথাটিও ইতিহাসে গুরুত্বের সঙ্গে উল্লেখিত হয়েছে। কন্যাও শুরু করেছিলেন ধর্ম-সাহিত্য। হাত দিয়েছিলেন ‘রামায়ণ’ রচনায়। হিন্দু সমাজের সেই মধ্যযুগে একজন নারীর হাতে ধর্মকথা লিপিবদ্ধ হওয়ার তথ্যটি কেবল ঐতিহাসিকই নয়, বৈপ্লবিকও বটে। তবে তিনি কাজটি শেষ করতে পেরেছিলেন বলে জানা যায় না। অবশ্য লোককাহিনী ‘মলুয়া’, ‘দস্যু কেনারামের পালা’ ইত্যাদির রচয়িতা রূপে চন্দ্রাবতীর কবিত্ব ইতিহাসের পাতায় লিপিবদ্ধ রয়েছে। ‘পূর্ব মৈমনসিং’ গীতিকা নামে পূর্ব বাংলার অপার লোক-সাহিত্যের ভাণ্ডারে এই নারী কবি সংযোজন করেছেন সাহিত্যের বহু মণি-মাণিক্য। নিজের জীবনের ট্র্যাজেডির জন্যও হয়ে আছেন ত্যাগ ও প্রেমের প্রতীক। কাব্য-সাধনার পাশাপাশি প্রেম-সাধনাতেও তিনি ইতিহাস-স্বরূপ। প্রেমের জন্য জীবন বিলিয়ে দিয়ে হয়েছেন বিরহের নায়িকা।
ষোড়শ শতকের কবি-কন্যা চন্দ্রাবতীকে বলা হয়ে থাকে বাংলা ভাষার প্রথম নারী কবি। ঐতিহাসিক ভাষ্য মতে, কিশোরগঞ্জ জেলার সদর উপজেলার মাইজকাপন ইউনিয়নের একদার ফুলেশ্বরী নদী তীরের পাতুয়াইল গ্রামে জন্মগ্রহণকারী কালজয়ী এই কবির লেখা পৃথিবীর একাধিক ভাষায় অনুদিত হয়েছে। তাঁকে নিয়ে রচিত হয়েছে নাটক, পালা।
চন্দ্রাবতীর মায়ের নাম ছিল সুলোচনা। মৈমনসিংহ গীতিকা অনুযায়ী, ১৫৫০ সালের দিকে তাঁর জন্ম, আর মৃত্যু ১৬০০ সালে। চন্দ্রাবতী একাধারে কবি এবং সাহিত্যের নায়িকা। বাংলা সাহিত্যের একজন সার্থক ট্রাজিক নায়িকা হিসেবে তিনি কিংবদন্তী হয়ে রয়েছেন। রোমান্টিক মনের অধিকারী চন্দ্রাবতীর বাস্তব জীবনে ঘটে যাওয়া প্রেমের বিয়োগান্তক ঘটনার বিবরণ পাওয়া যায় নয়নচাঁদ ঘোষ রচিত ‘চন্দ্রাবতী’ পালায়। ১২টি অধ্যায়ে ৩৫৪টি ছত্রের এ লোকগাঁথাটি চন্দ্রাবতীর জীবনীর তথ্যভিত্তিক লিখিত প্রামাণ্য দলিল।
নয়নচাঁদ ঘোষের বর্ণনায় বলা হয়েছে যে, সুন্দরী চন্দ্রাবতীর সাথে তাঁর বাল্যসখা জয়ানন্দের বন্ধুত্ব গভীর প্রেমে পরিণত হয়। দুই পরিবারের সম্মতিতে জয়ানন্দ ও চন্দ্রাবতীর বিয়ে ঠিক হয়। সে বিয়ের আয়োজনও শুরু হয়ে যায়। কিন্তু হঠাৎ ঘটে যায় আরেক ঘটনা। আসমানি নামে এক মুসলমান মেয়ের রূপে মুগ্ধ হয়ে তাঁকেই বিবাহ করে চঞ্চলমতি জয়ানন্দ। এই মর্মান্তিক খবরে চন্দ্রাবতী স্তম্ভিত হয়ে নাওয়া-খাওয়া ত্যাগ করেন। নিদারুণ আঘাতে মুষড়ে পড়া চন্দ্রাবতীকে বিপর্যয়কর অবস্থা থেকে উদ্ধারের জন্য বংশীদাস একমনে শিবের নাম জপ করতে আর রামায়ণ লিখতে উপদেশ দিলেন। এসময় চন্দ্রাবতী পিতা দ্বিজ বংশীদাশের কাছে দুটি প্রার্থনা করেন। একটি ফুলেশ্বরী নদীর তীরে মন্দির প্রতিষ্ঠা করা এবং অন্যটি চিরকুমারী থাকার ইচ্ছা। দ্বিজ বংশীদাশ তাঁর দু’টি প্রার্থনাই মঞ্জুর করলেন। এভাবেই এক সময়ের খরস্রোতা নদী ফুলেশ্বরীর তীরে স্থাপিত হয় চন্দ্রাবতীর শিবমন্দির। বিরহী প্রেমের স্মৃতিময় সে জীবন চন্দ্রাবতী কাটিয়ে দিয়েছেন সাহিত্যের ভেতর দিয়ে। কিছুকাল পর জয়ানন্দ অনুতপ্ত হয়ে আবার তার কাছে ফিরে এলেও চন্দ্রাবতী আর তার সাথে দেখা করেন নি। এতে অভিমানে জয়ানন্দ বাড়ির পাশেই ফুলেশ্বরী নদীতে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করেন। জয়ানন্দের মৃত্যু থামিয়ে দেয় চন্দ্রাবতীকেও। নিজের আবেগ ধরে রাখতে না পেরে ফুলেশ্বরীতে ঝাঁপ দিয়ে জয়ানন্দের শেষ যাত্রায় সঙ্গী হন তিনিও। অন্যমতে, জয়ানন্দের মৃত্যুর অল্প কিছুদিন পরই শোকাভিভুত চন্দ্রাবতীও দেহত্যাগ করেন। ফলে রামায়ণে সীতার বনবাস পর্যন্ত লেখার পর আর লেখা হয়নি। এভাবেই চন্দ্রাবতী একটি বিয়োগান্ত চরিত্র হয়ে বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে স্থান করে নিয়েছেন।
ইতিহাস থেকে বাস্তবে ফিরে চারপাশে তাকিয়ে দেখি, কোন ফাঁকে বিকেলের সঙ্গে সঙ্গে শুরু হয়ে গেছে শরতের সন্ধ্যামাখা মায়াবী আবহ। দ্রুতই আলো নিভে চারপাশ সোনালী আভায় পূর্ণ হচ্ছে। গাছে গাছে এখন আর সকালের সতেজতা নেই। বিদায়ী সূর্যের রক্তিভ আলোয় টলমল করছে চরাচর। এখনই আঁধার ঘনিয়ে উন্মোচিত হবে রাতের দরোজা। পৃথিবীর নানা রহস্য খেলা করবে বসুন্ধরায়, বাতাসে, প্রকৃতিতে, আকাশের তারায় তারায়। আমারও ততক্ষণে দিন শেষে ফিরে আসার সময় হয়েছে।
ফিরতি পথে চলতে চলতে ভাবছি চন্দ্রাবতীর কথা। অনেক কিছুই লিখে যেতে পারেন নি চন্দ্রাবতী। শেষ করতে পারেন নি সাহিত্যকর্ম। রচনা করতে পারেন নি প্রেম ও বিরহের আত্মজৈবনিক ভাষ্য। সাধারণ জীবনও তিনি যাপন করতে পারেন নি সাহিত্য ও প্রেমের কারণে। মধ্যযুগের সাদামাটা নারী চরিত্রের সামনে অনন্য মনে হয় তাঁকে। অনেক বেশি আধুনিক, স্বতন্ত্র, সংগ্রামী ও দ্রোহী।
জীবন বিলিয়ে দিয়ে যিনি বেদনার আখরে লিপিবদ্ধ হয়ে আছেন সাহিত্য ও ইতিহাসের অমোচনীয় পাতায় পাতায়, মানুষের স্মৃতিতে ও লোকগাথায়, তিনি নিজেই তো একজন স্বর্ণালী নায়িকা। তাঁর সান্নিধ্যের অপরূপ স্পর্শ সহজেই মুছে যায় না আমার চৈতন্য থেকে। সারা পথ সঙ্গী হন চন্দ্রাবতী এবং তাঁর কর্ম, কীর্তি ও কাহিনী। আকাশের দিনে তাকিয়ে মনে হলো, দিনের শেষে চন্দ্রাবতীর স্মৃতি নিয়ে এখনই উঁকি দেবে একটি চাঁদ। অনিন্দ্য চাঁদ আর রূপসী চন্দ্রাবতীতে আমার কাছে মনে হয় জন্মান্তরের সখা।
ড. মাহফুজ পারভেজ: কবি-কথাসাহিত্যিক-গবেষক। অধ্যাপক, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
বাংলাদেশ সময়: ২০৩০ ঘণ্টা, অক্টোবর ৫, ২০১৭
জেডএম/