ঢাকা, শুক্রবার, ৬ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২২ নভেম্বর ২০২৪, ২০ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

শিল্প-সাহিত্য

লেখালিখির প্রস্তুতিতে অনেক বেশি সময় যায় | কাজুও ইশিগুরো

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৩২৫ ঘণ্টা, অক্টোবর ৯, ২০১৭
লেখালিখির প্রস্তুতিতে অনেক বেশি সময় যায় | কাজুও ইশিগুরো লেখালিখির প্রস্তুতিতে অনেক বেশি সময় যায় | কাজুও ইশিগুরো

২০১৭ সালে নোবেল সাহিত্য পুরস্কার পেয়েছেন বর্তমান সময়ের প্রভাবশালী কথাসাহিত্যিক জাপানিজ বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ নাগরিক কাজুও ইশিগুরো। তিনি এ পর্যন্ত ৭টি উপন্যাস রচনা করেছেন। তার উপন্যাসগুলোর মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় ‘দ্য রিমেইন্স অব দ্য ডে’ ও ‘নেভার লেট মি গো’। উপন্যাস দু’টি অবলম্বনে চলচ্চিত্রও নির্মাণ করা হয়েছে। সাহিত্যে নোবেল জয়ের পর কাজুও ইশিগুরো তার প্রতিক্রিয়ায় জানিয়েছেন, ‘আমি হতবিহ্বল হয়ে পড়েছি’। নোবেল পাওয়ার আগে আরেক ইংরেজ সাহিত্যিক গ্রাহাম সুইফট কাজুও ইশিগুরোর একটি সাক্ষাৎকার নেন। সাক্ষাৎকারটির ভাষান্তর করেছেন তরুণ অনুবাদক ও গল্পকার মোস্তাফিজ ফরায়েজী।

গ্রাহাম সুইফট: আপনি জাপানে জন্মলাভ করেছেন এবং পাঁচ বছর বয়সে ইংল্যান্ডে এসেছেন আপনি আপনাকে কেমন জাপানিজ বলবেন?

কাজুও ইশিগুরো: আমি পুরোপুরি ইংরেজদের মতো নই, কারণ আমাকে আমার জাপানি মা-বাবা এখানে নিয়ে এসেছিলেন। আমাদের বাড়িতে সবাই জাপানিজ ভাষাতে কথা বলত।

আমার বাবা-মা মনে করছিলেন, আমরা ইংল্যান্ডে বেশিদিন থাকতে পারব না, এ কারণে তারা আমাকে জাপানি সংস্কৃতির সঙ্গে রাখতেন। আমার এক ধরনের স্বতন্ত্র অতীত রয়েছে। আমি সবকিছু ভিন্নভাবে ভাবি, আমার দৃষ্টিকোণ সবার থেকে আলাদা।

গ্রাহাম সুইফট: আপনার বাকিটুকু কি ইংরেজদের মতো? আপনি কি নিজেকে ইংরেজ ইংরেজ অনুভব করেন?

কাজুও ইশিগুরো: মানুষের দুই-তৃতীয়াংশ এক রকম আর বাকিটা অন্যরকম, এটা হতে পারে না। একজনের মেজাজ, ব্যক্তিত্ব অথবা চেহারা এভাবে বিভক্ত হতে পারে না। আসলে এটা এক ধরনের সমসত্ত মিশ্রণ। বর্তমান শতাব্দীর শেষের দিকে সংস্কৃতি ও বর্ণের মিশ্রণ একটা সাধারণ ব্যাপার হয়ে দাঁড়াবে। পৃথিবী সেই পথেই অগ্রসর হচ্ছে।

গ্রাহাম সুইফট: আপনার সময়ে কিছু ইংরেজি সাহিত্যের লেখক রয়েছেন যারা ইংল্যান্ডের বাইরে থেকে এসেছেনআপনি কি তাদের সম্পর্কে বলবেন? আমি টিমোথি মো, সালমান রুশদি, বেন ওকরির কথা বলছি

কাজুও ইশিগুরো: আমার অবস্থান থেকে তাদের অবস্থানের পার্থক্য অনেক। কেননা তারা ব্রিটিশ সাম্রাজ্য থেকে এসেছেন। যে ভারতে লালিত-পালিত হয়েছেন তার সঙ্গে ব্রিটিশদের বেশ শক্তিশালী সম্পর্ক আছে।

গ্রাহাম সুইফট: সাম্রাজ্যের কথা যখন বলছেন, আপনার প্রথম দু’টি উপন্যাস ‘আ পেইল ভিউ’, ‘অ্যান আর্টিস্ট অব দ্য ফ্লটিং ওয়ার্ল্ড’র কথা বলতে হয় দু’টি উপন্যাসকে আপনি জাপানিজ উপন্যাসও বলতে পারেনআপনি উপন্যাস দু’টিতে জাপানিজ সাম্রাজ্যের পতন নিয়ে লিখেছেনওগুলো অবশ্য যুদ্ধ-পরবর্তী প্রেক্ষাপটে অবলম্বনে লেখাআপনার উপন্যাস ‘দ্য রিমেইন্স অব দ্য ডে’, যেটা পঞ্চাশ দশকের প্রেক্ষাপটে রচিত, এটিও ইংল্যান্ডের যুদ্ধ-পরবর্তী একটি সময় 

কাজুও ইশিগুরো: আমি নির্দিষ্ট কারণে এটা করেছি। আমার চিত্রকল্পের সঙ্গে যুদ্ধ-পূর্ববর্তী কিংবা যুদ্ধ-পরবর্তী বিষয়গুলোর খুব শক্তিশালী সম্পর্ক রয়েছে। আমার তিনটি বইয়ের দিকেই খেয়াল করলে দেখবেন, তিনটিতেই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের উপস্থিতি রয়েছে।

গ্রাহাম সুইফট: দ্য রিমেইন্স অব দ্য ডে উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্রটি একটা বাড়ির প্রধান গৃহকর্মীএরকম চরিত্রের উপস্থিতি অনেক সময় গোয়েন্দা উপন্যাস কিংবা হাস্যরসাত্মক উপন্যাসে দেখা যায়, কিন্তু আপনি একজন গৃহকর্মীকে একটা গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রে পরিণত করেছেনআপনি এরকম একটি চরিত্র সৃষ্টি করলেন কীভাবে?

কাজুও ইশিগুরো: একজন গৃহকর্মী নিম্নবর্তী মানুষকে বুঝানোর জন্য দারুণ রূপক চরিত্র। আমরা বেশিরভাগ মানুষ সরকারকে পালিয়ে যাওয়ার জন্য অথবা সেনা অভ্যুত্থানের জন্য নেতৃত্ব দিই না।  

গ্রাহাম সুইফট: যদিও গৃহকর্মী চরিত্রটি এমন একটি চরিত্র যার প্রয়োজন অনুসারে নেতৃত্ব দেওয়ার গুণাবলীও রয়েছেএটা বেশ স্টাইলিশ একটি চরিত্র আত্মমর্যাদা চরিত্রটির একটি খুব গুরুত্বপূর্ণ দিকএই আত্মমর্যাদা, কার্যসাধন অথবা জীবন প্রণালীর ভিতর কি জাপানিজ সংস্কৃতির প্রতিচ্ছায়া রয়েছে? ফ্লটিং ওয়ার্ল্ড উপান্যাসটির কেন্দ্রীয় চরিত্র মাসুজি ওনো-ও তার আত্মমর্যাদা নিয়ে সচেতনযদিও স্টিভেনস একজন আত্মদর্শী ও হৃদয়স্পর্শী চরিত্র, সে তার নিজের সম্পর্কে অবচেতনতার কাছে শুধুমাত্র একটি জিনিসই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে, সেটা হলো তার আত্মমর্যাদাআপনি কি মনে করেন, আত্মমর্যাদা মানুষের একটি গুণ?

কাজুও ইশিগুরো: দেখুন, আত্মমর্যাদা কী সেটা আমি নিশ্চিত নই। এটা ‘দ্য রিমেইন্স অব দ্য ডে’ এর বিতর্কের বিষয়। স্টিভেনস এমন কিছু দ্বারা আবিষ্ট যেটাকে সে আত্মমর্যাদা বলে থাকে। সে মনে করে, নিজের অনুভূতি প্রকাশ করাটাই আত্মমর্যাদা নয়। আসলে তার মতে, অনুভূতি অপ্রকাশিত থাকাটাই আত্মমর্যাদা।

গ্রাহাম সুইফট: আত্মমর্যাদা বা মর্যাদার বিষয়ে আপনার ব্যতিক্রমী মতাদর্শ রয়েছেস্বতস্ফূর্তভাবে লেখার ভেতর এক ধরনের মর্যাদা রয়েছেকেউ একজন বলবে, আপনার নিজস্ব লেখনশৈলীর ভিতর মর্যাদাপূর্ণ ব্যাপার-স্যাপার রয়েছেওনো, অ্যান আর্টিস্ট অব দ্য ফ্লটিং ওয়ার্ল্ড উপন্যাসে একজন শিল্পীফ্লটিং ওয়ার্ল্ডে শিল্পের সৌন্দর্য ও ভঙ্গুরতা উঠে এসেছেওনো যখন রাজনীতিতে যোগ দেয়, তার জীবনের সবকিছু ভুলে ভরে যায়সে কি রাজনীতিতে যোগ দিয়ে ভুল করেছিল? শিল্পের কি রাজনীতির মাঠে যাওয়া খারাপ? শিল্পকে কি সামাজিক ও রাজনৈতিকভাবে সচেতন হতে হবে?

কাজুও ইশিগুরো: একজন শিল্পীকে এসব প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়। একজন চিত্রশিল্পী কিংবা লেখকের সমাজের প্রতি একটা দায়বদ্ধতা রয়েছে। তারা সেই দায়িত্ব পালন করবে নাকি করবে না, এটা কোনো প্রশ্ন হতে পারে না। প্রশ্ন হচ্ছে, কী মাত্রায় করবে? এরকম প্রশ্নের সম্মুখীন লেখক বা শিল্পীদের প্রতিনিয়ত হতে হয়।

গ্রাহাম সুইফট: আপনি কি এখন কোনো নতুন উপন্যাস লেখার চেষ্টা করছেন?

কাজুও ইশিগুরো: আমি চেষ্টা করছি। আমি লাইব্রেরি থেকে মাত্র বই বের করেছি। একটি উপন্যাসের আসল খসড়া করতে আমার অনেক সময় লাগে। মূল লেখালিখি বা শব্দের গাঁথুনি তৈরি করতে আমার প্রায় এক বছর সময় লাগে, কিন্তু লেখালিখি শুরুর আগের প্রস্তুতিতে আরও অনেক বেশি সময় চলে যায়। যেখানে আমি প্রবেশ করতে যাচ্ছি সেটা সম্পর্কে আমাকে পরিচিত হতে হয়। উপন্যাসের চিত্রকল্প আমাকে কম-বেশি জানতে হবে, বইটিতে কীসের উপর জোর দিতে যাচ্ছি এটা জানতে হবে, আবার আমাকে চরিত্রগুলো সম্পর্কেও জানতে হবে।

গ্রাহাম সুইফট: কাগজ-কলম নিয়ে বসার আগেই এগুলো করবেন?

কাজুও ইশিগুরো: হ্যাঁ, লেখক হিসেবে এই বিষয়ে আমি খুব সতর্ক। আমি টাইপ রাইটারে একটা সাদা পৃষ্ঠা ঢুকিয়ে মাথার ভিতর ঝড় তুলে কিছু বের করে আনার ভেতর নেই। আমার সামনে লেখাটির একটা সুস্পষ্ট পরিকল্পনা বা নকশা থাকতে হবে।  

গ্রাহাম সুইফট: আপনি কি কাজ করার সময় আপনার পরিকল্পনা অনুযায়ী সব করতে পারেন?

কাজুও ইশিগুরো: হ্যাঁ, অনেক ভালো পারি। আমার প্রথম উপন্যাসে অবশ্য কম করতে পেরেছি। আমি আমার প্রথম ও দ্বিতীয় উপন্যাস থেকে শুধুমাত্র একটা জিনিস শেখার চেষ্টা করেছি সেটা হচ্ছে, চিত্রকল্প নির্মাণের নিয়মানুবর্তিতা। একটা নির্দিষ্ট উপন্যাসের খসড়া তৈরি করা আকর্ষণীয় কিন্তু লেখার সময় আপনি হোঁচট খেতে পারেন। আমার প্রথম উপন্যাসে আমি কিছু বিষয় পরিষ্কার করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু এখন আমি কিছু বিখ্যাত অগোছালো লেখকের দিকে মনোযোগী হচ্ছি, তারা উপন্যাস লেখার ক্ষেত্রে কোনো নকশা বা পরিকল্পনার সঙ্গে লেগে থাকেননি।

গ্রাহাম সুইফট: তাদের অনুসরণ করছেন?

কাজুও ইশিগুরো: আমি দুইজন মহান লেখকের বই পড়েছি, একজন চেখভ ও আরেকজন দস্তয়ভস্কি। আমার লেখক জীবনে আমি চেখভ দ্বারা উৎসাহিত। চেখভের শব্দবাহুল্যবর্জিত ও সুনিয়ন্ত্রিত ভাব আমার খুব পছন্দ। কিন্তু আমি মাঝে মাঝে দস্তয়ভস্কির অগোছালো, বিশৃঙ্খল ভাবের হিংসা করি। তিনি এমন কিছুতে পৌঁছেছেন যেখানে আপনি সেটা বাস্তবে না করে পৌঁছাতে পারবে না।

গ্রাহাম সুইফট: আপনি কি এটা পরিকল্পনা দিয়ে ছুঁতে পারেন না?

কাজুও ইশিগুরো: হ্যাঁ, এই অগোছালো ভাবের ভিতর মহামূল্যবান কিছু লুকায়িত থাকে। জীবনটাই অগোছালো। আমি মাঝে মাঝে ভাবি, একটা বইকে কি সবসময় পরিষ্কার, পরিচ্ছন্ন কিংবা সুশৃঙ্খল হতে হবে? বইটি গোছালো ও সুগঠিত, এটি কি প্রশংসা? বইটিতে সবকিছু বিক্ষিপ্ত অবস্থায় আছে, এটা কি সমালোচনা?

গ্রাহাম সুইফট: আমি মনে করি, কোনটা টিকে থাকবে আর কোনটা থাকবে না এটা পাঠকদের ব্যাপারএসব প্রশ্নের উত্তর পাঠকেরা দিতে পারবে

কাজুও ইশিগুরো: আমি পরিবর্তন অনুভব করি। স্বতঃস্ফূর্তভাবে লেখার আরেকটা দিক রয়েছে যেটা বলা প্রয়োজন— অগোছালো, বিশৃঙ্খলার দিক। যেটাকে অন্যভাবে বলা যেতে পারে, মর্যাদাহানিকর দিক।

বাংলাদেশ সময়: ০৯২৫ ঘণ্টা, অক্টোবর ০৯, ২০১৭
এসএনএস

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।