ঢাকা, শুক্রবার, ৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২২ নভেম্বর ২০২৪, ২০ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

শিল্প-সাহিত্য

আয়না ভেঙে গেলে কাচ | তানিয়া চক্রবর্তী

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৬৫৯ ঘণ্টা, অক্টোবর ১৫, ২০১৭
আয়না ভেঙে গেলে কাচ | তানিয়া চক্রবর্তী আয়না ভেঙে গেলে কাচ | তানিয়া চক্রবর্তী

আমি বা আমরা নিজে কী— কী আছে এই আমি বা আমার মধ্যে, এই আমি কী ঘটাবে ভবিষ্যতে? এই আমির উদ্দেশ্যই-বা কোনটা? কেন আমরা এসেছি, এটা ভালো করে ভেবে দেখলে দেখবেন, একটা চেন বা শেকল যার উৎস বা সমাপ্তি না জেনেই আমরা অমূলক দৌড়ে যাচ্ছি। এই আমি যা করব বা যা করছি তা বোঝার আগেই আমিটাই শেষ হয়ে যাবে! তবু হয়তো কোথাও কোনো উন্নতির দরুন আমরা এখন ভবিষ্যতের দিকে তাকাতে পারছি। এরকমই নিজেকে খুঁজতে গেলে তো আগে নিজেকে দেখতে হবে। এই দেখার সূত্র ধরেই আয়নার আগমন। এই আয়না আসলে নিজের প্রতিকৃতি দেখার প্রতিফলনযুক্ত কাচ। 

সম্ভবত মানুষ প্রথমে জলে তার প্রতিফলন দেখত— সেটাই ছিলো প্রথম আয়না এবং মানুষ এটাকে জাদু ভাবত। প্রাথমিকভাবে মানুষ পাথর পালিশ করে এটি বানায়, সেখানে আগ্নেয়গিরির কালো অংশও ব্যবহৃত হতো।

এই ধরনের কাচ ৬০০০ খ্রিস্ট পূর্বে তুরস্কে দেখা গিয়েছিল। প্রাচীন মিশরের মানুষ তামা পালিশ করে বিভিন্ন গয়নায় সুসজ্জিত করে। চীনে অ্যালয় ধাতু থেকে আয়না বানানোর প্রথম প্রথা শুরু হয়। তাই প্রথমেই আয়নার ব্যবহারে কাচ আসেনি। পরবর্তীতে মিশর, জার্মানি, এশিয়াতে কাচ ব্যবহার করে আয়না বানানোর রীতি শুরু হয়।  

আয়নার আগমনের সময় এটা শুধু সমাজের শাসকরাই ব্যবহার করত। তবে ব্যাবিলন সভ্যতায় কপারের পালিশ করা আয়না আসে আজ থেকে প্রায় ৪০০০ খ্রিস্ট পূর্ব আগে। টিন-পারদ ধাতুর সংকর তথা অ্যামালগাম বানিয়ে তা থেকে আয়না তৈরি করে ষোড়শ শতাব্দীতে জনপ্রিয় ও সংখ্যাগুরু উৎপাদনের স্থান হয়েছিল প্যারিসের ভেনিস।

কুসংস্কার বা সংস্কার সে যাই হোক, আয়না ছিলো ভীষণ অন্যরকম কিছু ভাবনার সূত্র। মনে করা হতো, কাচ ভাঙা মানে আগামী সাত বছরের জীবন খারাপের দিকে যাবে। আসলে প্রথম মানুষ জলে তার প্রতিকৃতি দেখে এটাকে জাদুশক্তির প্রভাব মনে করত, যদি ছবি সুস্পষ্ট হতো তবে তা নিশ্চয় ভালো জীবনের প্রতীক, তাছাড়া ছবির আকৃতি ভিন্ন হলে তবে তা খারাপ। মিশর শহরের প্রাচীন মিথ অনু্যায়ী, এই কাচ জাদুশক্তি ধারণ করতে পারে, যেহেতু তারা মনে করত কাচ বা জল ব্যক্তির আত্মাকে দেখায় তাই এটি নিশ্চয় কোনো ঈশ্বরীয় প্রভাব সম্পর্কিত। এই খারাপ সাত বছরের পর জীবন আবার নতুন প্রবাহ নিয়ে আসে বলে মনে করত রোমানরা। এই ছবি বা প্রতিবিম্ব আসলে আয়নার মাধ্যমে দেখা ব্যক্তির আত্মা। কাচ ভাঙা মানে আত্মার ক্ষতি হওয়া। তাই ভাঙা কাচ রোমানরা মাটির গভীরে পুঁতে দিত এই খারাপ প্রভাব কাটানোর জন্য।  আয়না ভেঙে গেলে কাচ | তানিয়া চক্রবর্তীবলা হয়, প্রেতাত্মাদের প্রতিবিম্ব দেখা যায় না কারণ তাদের কোনো আত্মা নেই। কিছু জায়গায় দৃঢ়তার সঙ্গে এই ভাবনা পোষণ করে যে, শিশুর একবছর বয়স পূর্ণ না হলে তাকে আয়না দেখালে তার মৃত্যু হয়। মৃত্যু ও জীবনের পথ বা সেতু বলেও আয়নাকে মনে করা হতো কিছু সমাজে। ইহুদি সমাজে কোনো আত্মীয়র খুন বা দুর্ঘটনার খবর জানলে সঙ্গে সঙ্গে কাচ ঢেকে দেওয়ার প্রথা চালু ছিলো। মনে করা হতো, আয়না সেই মাধ্যম যার মাধ্যমে অতৃপ্ত আত্মা ফিরে আসার চেষ্টা করতে পারে। কোনো কাচ দেয়াল থেকে নিজে থেকে খসে পড়ার সংকেতকে মিশরের মানুষ মৃত্যুর কারণ হিসেবে ভাবত। পাশ্চাত্যে আবার বলা হতো, কোনো মেয়ে তার হবু স্বামীকে দেখতে চাইলে তাকে আপেল খেতে হবে আয়নার সামনে বসে এবং খোলা চুল আঁচড়াতে হবে— তাহলেই নাকি সে তার কাঁধের সামনে সেই প্রতিকৃতি দেখতে পাবে। আয়না ঘরের সজ্জার সঙ্গে লাগানোটা শুধু বিলাসিতাই নয় আসলে আয়নার প্রতিফলন কিন্তু মানসিক প্রভাবের ক্ষেত্রেও জরুরি যদি এই তথাকথিত মিথগুলোকে বাদ দিয়েও ভাবি। এটা কিন্তু ভাবা যেতেই পারে, এই আমিটাই তো সব কর্মের কর্তা তাই এর দৃষ্টি, এর ভঙ্গি এগুলো কোথায় কী প্রভাব ফেলতে পারে তরঙ্গের মাধ্যমে, সেটাও একটা বিষয়। দেহের সঙ্গে মন যে সবক্ষেত্রে জড়িয়ে তা বোধহয় বলাই বাহুল্য। বহু দেশেই ঘুমাতে যাওয়ার আগে আয়না ঢাকা দেওয়ার কথা বলা হয়।  

মোমবাতি নিয়ে নিজের প্রতিবিম্ব আয়নায় দেখা নিয়ে বেশকিছু তথ্য কথিত রয়েছে। বহু সভ্যতা আয়নাকে যেমন সৌন্দর্য জানার অপার চাবিকাঠি ভেবেছে, তেমনই সতর্কবাণীও জানিয়েছে। “ব্লাডি মেরি” নামক আয়না কাহিনী বেশ জনপ্রিয়। অনেক সময়ই আয়নাকে অন্য জগতের সেতু ভাবা হয়।  

মেসোমেরিয়ান সভ্যতায় কাচ প্রাথমিকভাবে জাদু, মায়া, ঈশ্বর, অতিপ্রাকৃত শক্তির ধারণায় আচ্ছন্ন থাকায় তা দিয়ে বহু নিয়ম পালন করা হতো। প্রথম লোহার খনিজমল থেকে তারা আয়না বানায়। আসলে এই আয়না তাদের কাছে জল, আগুন, মুখ, মাকড়সা বা সূর্য এইসব ভাবনা ও তার প্রভাবে আচ্ছন্ন হয়ে বাস্তবিক রূপ নিত। এবং তারা “MIRROR SUN”  এই নামে বিশেষ ধরনের আয়না ব্যবহার করত।

আয়না তথা মিরর কবিতায় সিলভিয়া প্লাথ জীবনের তীব্র অংশ দেখিয়েছেন,
“I am silver and exact. I have no preconceptions./Whatever I see I swallow immediately/Just as it is, unmisted by love or dislike./I am not cruel, only truthful ‚/The eye of a little god, four-cornered./Most of the time I meditate on the opposite wall./It is pink, with speckles. I have looked at it so long/I think it is part of my heart. But it flickers./Faces and darkness separate us over and over”।
 
“আয়না দেখেই চমকে বলে/ মুখ যে দেখি ফ্যাকাশে/ বেশীদিন আর বাঁচব না তো/ বলছে বসে একা সে”

জীবন কোন দিক দিয়ে বাস্তবিক কোথায় এসেছে আমরা তার বিন্দুমাত্র কিছু বুঝি না— আর এই চামড়ার খেলাটাও অজানাই থেকে যেতো যদি না আয়না আসত।

যা খুব সহজ ও স্বাভাবিক তার উল্টো দিকও যে সবসময় সেরকম হবেই এটা না ভাবাই ভালো। আবার বিজ্ঞান যা আবিষ্কার করেনি সেই জায়গাতেও বিজ্ঞান নিয়ে আসতে এলে যথাযথ যুক্তি প্রদর্শন করতে হয়। স্বাভাবিকভাবেই যে আয়না রূপের ক্যানভাস তুলে ধরে সেই আয়নার ভাঙা কাচ দিয়ে পৃথিবীর কতো নারকীয় খুনও হয়েছে। আবার এই জীবন তার যতোটুকু জানি তা নিয়ে অজস্র তর্ক করি আর যা জানি না তার দিকে হাঁ করে তাকিয়ে থাকি।

তাই এই সংস্কার ও কুসংস্কার সব এই পৃথিবীর— যতোক্ষণ না তার সততা প্রমাণিত হয় ততোক্ষণ অবধি এই পুলক অব্যাহত থাক। আমরা না হয় একটু সামাজিকভাবে আয়নায় মুখ দেখি, নিজের দিকে তাকাই...
 
বাংলাদেশ সময়: ১২৫৭ ঘণ্টা, অক্টোবর ১৫, ২০১৭
এসএনএস

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।