একটি ছবি আঁকার আগে খাতায় মার্জিন টানা হয়, হাত দিয়ে টেনে সমতল ও স্পষ্ট করা হয়। একটি মুখ প্রসাধনে সজ্জিত হওয়ার আগে ধৌত হয়।
দৈহিকভাবে অবশ্যই এই সময় যৌবনের তুলনায় অনেক দুর্বল। আর যেহেতু আমরা দেহ আর মন এই দুই এর যৌথ কার্যেই এগোতে অভ্যস্ত তাই দেহ দুর্বল হলে মনকে এগিয়ে নিতে অসুবিধে হয় বৈকি! অনেকে এটা অতিক্রম করেন হয়তোবা; তবু বয়স প্রতিবন্ধক হয়! বয়সকে খেলিয়ে জীবনের মুহূর্তে জিতে যাওয়ার চাবিকাঠি তাই কেবল মন ও মনন। বয়স তথা বার্ধ্যক্যের সবচেয়ে বড় শক্তি এই সময়ের ব্যক্তির স্বীকৃতি তার আশেপাশের জোরালো বন্ধন এইগুলি তীব্র হলে বৃদ্ধ ব্যক্তি নিরাপদ বোধ করেন। কিন্তু এর প্রতিকূলতায় তিনি আর যুবকের মতো বিরোধী হতে পারেন না সচরাচর, ঝুঁকে পড়েন— এখানেও সেই পূর্ববর্তী দেহ-মনের যৌথতা একটি কারণ।
তবে ব্যক্তি বোধনির্ভর হলে এই বয়সের ভারজনিত প্রতিকূলতা সাময়িকভাবে হলেও কমে।
বার্নার্ড শ’ বলেছেন, “you don’t stop laughing when you grow old, you grow old when you stop laughing”।
রবার্ট ফ্রস্ট বলেছেন, “The afternoon knows what the morning never suspected”।
ভিক্টর হুগো বলেছেন, “forty is the old age of youth/ fifty the youth of old age”।
গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া বলেছেন, “The secret of a good old age is simply an honorable with solitude”।
আসলে দেখতে গেলে আমরা জীবনের কেউ নয়, জীবন আমাদের অবশ্য কেউ। অর্থাৎ তারা আমাদের জন্য অর্থবহুল যদিও এটির শুরু এবং শেষে আমরা পুতুল ছাড়া কিচ্ছু নই তবু মাধ্যমের অবসরে আমাদের গোটা ভূমিকাই থাকে। বার্ধক্য জীবনের ফলাফল দেখার মঞ্চ কিংবা বলা যেতে পারে মানুষ এসময় তার পূর্ববর্তী সব মুহূর্তকে পরিশোধিত আঙ্গিকে দেখতে পারে। এখানে কিছু করার না থাকলেও অভিজ্ঞতার আদলে সে আগামী প্রজন্মকে পথ দেখাতে পারে, ফলস্বরূপ আমরা তাদের দিকে ছুটে যাই। আসলে বার্ধক্য যে একাকী থাকার মুহূর্তে আসে তার কারণ তার বিষয়, উপকরণ, দায়, ক্ষমতা সব শেষ হয়ে আসে, অনেকটা অভিযোজনের মতোই উদ্দেশ্য না থাকায় ব্যক্তি উদাসীন ও স্থির হয়ে নিশ্চল হয়ে পড়ে থাকে ফলে সে যেনো মৃত্যুকে প্রশ্রয় দেয়।
কিন্তু দেখা গেছে, বার্ধক্যেও ব্যক্তি যদি উদ্দেশ্য প্রণোদিত যাপন করে সে উজ্জীবিত হয়ে ওঠে কারণ এটা প্রবৃত্তি যা অভিযোজনের মতো ব্যক্তিকে পরিব্যক্তির কাছাকাছি আনার চেষ্টা করে। এই প্রসঙ্গে একটি অসাধারণ গল্পের মুহূর্ত মনে পড়ে যায়— যেখানে গল্পটি নিজেই বয়স ও উদ্দেশ্য, অমূলক জীবনের মৈত্রী স্থাপন করে। গল্পটি উর্দু গল্প লেখক কৃশন চন্দরের লেখা “জঞ্জাল বুড়ো”। গল্পের ব্যক্তি এখানে ব্রাত্য, সুন্দর স্বপ্ন ভরা সংসারে পত্নী হারানো এক পাক খাওয়া ফেলনা জীবনের মানুষ, যার সব আছে অনুভূতির কিন্তু উপকরণ বলে কিছুই নেই। তবু এই প্রতিবন্ধী জীবনের সব আছে, সে প্রকৃতির সবটুকু চায়— সেরকমই চেয়েছিল এই জঞ্জাল বুড়ো। বড় কিছু ইমারতের পিছনে ছিলো একটি জঞ্জালের টব, সেখানে আবর্জনা, এঁটো খাবার স্তূপ হয়ে পড়ে থাকে।
দুর্বল, সামর্থহীন দেহের ভেতর থেকে খিদে জেগে ওঠে একটা সময়ের পর সে রাক্ষস হয়ে যায়। এই লম্বা চওড়া জঞ্জালের টব রুটির টুকরো, বাচ্চার ময়লা কাপড়, শাক-সবজির পচা পাতা থেকে কোথাও উদয় হয়, আধখাওয়া কিছু পুরি ও আলুর তরকারি, ঘ্রাণ তার খাদ্যের ক্ষেত্র তৈরি করে; সে ঝাঁপিয়ে পড়ে খেতে থাকে। এভাবে এক এক দিন এক এক আধখাওয়া, আধপচা থেকে তার ক্ষুধানিবৃত্তি হতে থাকে। উৎসব শুরু হলে উৎসবের স্পর্শ ওই টবে এসেও পড়ে। সে ওই টবের জায়গীরদার, টবের রাজা। ওই টবের খাদ্যচরিত্র তার দিন রচনা করে। এভাবে কেবল খাদ্য, কিছু মৌলিক খিদে এক বার্ধক্য বাঁচিয়ে রাখে কিন্তু একদিন এই টবে এক অনাদরের শিশুর আগমন হয়, জঞ্জাল বুড়ো প্রথমে সে শিশু নিয়ে মহাবিপদেই পড়ে, কিন্তু এই খাদ্যযোগের দেহতে তো মন আছে; হয়তোবা লুকিয়ে সে বন্ধন চায়, সে নিজে নিজেই বেঁধে যায়। অযাচিত শিশুটিকে কোলে তুলে নেয় এক অবাঞ্ছিত বার্ধক্য আর তার মুখে পড়ে থাকা আমের খোলা থেকে একফোঁটা রস শিশুর মুখে ভরে দেয়। অযাচিত শিশুর কান্না বন্ধ হয়। বার্ধক্য শৈশবকে ফেলে দিতে চায়, পারে না। পরদিন সকাল থেকে বার্ধক্য খাঁটি দুধের তাগিদে ইঁট বইতে থাকে আর জঞ্জালের টবের দিকে তাকায় না জঞ্জাল বুড়ো। এই বার্ধক্য শৈশবের আলোতে বেঁধে গেছে কৃষ্ণচূড়ার ছায়ায়, লেখক তাই লিখেছেন। এই গল্পের অংশ তুলে ধরার প্রাসঙ্গিকতা এই যে, এই বার্ধক্যের জীবন এমনি যেমন-তেমন কারণ, সে দায়হীন মৃত্যুমুখী কিন্তু বন্ধনকে সেও ছাড়াতে পারে না— তার অমূলক অভিব্যক্তি মূলকের কাছে এসে জীবনকে খেলিয়ে দেয়। মৃত্যু জেতে কিন্তু তা জীবনের মহিমায় হেরে যাওয়ার মতোই।
তাই বার্ধক্য কোনো প্রতিকূলতা নয়— এটা একটা নির্মেদ পর্ব যা ছাঁকুনির মতো জীবনকে মসৃণ পথের দিক বলে দিতে পারে। ছুটি হওয়ার আগে পড়া শেষ করে ঘণ্টা বাজলে ছুটি উপভোগের যে আনন্দ হয়, বার্ধক্য সেই মুহূর্ত যা জীবনের থুতনি নেড়ে বলে দেখ, আমি কতো বড় হয়ে গেছি...
বাংলাদেশ সময়: ১৪০১ ঘণ্টা, অক্টোবর ২২, ২০১৭
এসএনএস