ঢাকা, শুক্রবার, ৬ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২২ নভেম্বর ২০২৪, ২০ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

শিল্প-সাহিত্য

মানবতাবাদী কবি বিমল গুহ | শ্যামসুন্দর সিকদার

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১২১৫ ঘণ্টা, অক্টোবর ২৬, ২০১৭
মানবতাবাদী কবি বিমল গুহ | শ্যামসুন্দর সিকদার মানবতাবাদী কবি বিমল গুহ

জন্ম-জন্মান্তরে উত্তম স্বজন-প্রাপ্তি এবং সুজনে বন্ধুলাভ কয়জনের ভাগ্যে হয়? জন্মান্তরের সাধারণ বিশ্বাস যাদের আছে, তাদের জন্য কবি বিমল গুহকে সামনে দাঁড় করিয়ে এমন প্রশ্ন করতে চাই আনন্দের আতিশয্যে! কারণ, তিনি একজন ভাগ্যবান ও সফল মানুষ যিনি সমৃদ্ধ ও সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্মলাভ করেছেন এবং ইমেরিটাস অধ্যাপক আনিসুজ্জামান ভাষায়, ‘কবি হিসেবে তিনি সমাদৃত, মানুষ হিসেবে সম্মানিত, কর্মজীবনে প্রতিষ্ঠিত, পারিবারিক জীবনে শ্রদ্ধেয়’। তাই বলি, এমন ভাগ্য কয়জনের হয়!

কবি বিমল গুহ সত্তর দশকে কবিতা লিখতে শুরু করেছিলেন। হয়তো  নিতান্তই শখের বশে।

তবে কবিতার প্রতি ভালোবাসার টান ছিলো প্রতিদানহীন ও অকৃত্রিম। কিছু প্রাপ্তির আশায় তিনি কবিতা লেখেননি। তার কবিসত্তার মাঝে ছিলো স্বতন্ত্র এক পৌরুষদীপ্ত চেতনা, যেখানে তাকে কর্মের সঙ্গে সাংঘর্ষিক কোনো প্রতিরূপ মনে হয়নি। বরং কর্মক্ষেত্রের অভিজ্ঞতা এবং সমকালীন সামাজিক জীবনোপলব্ধিতে সমৃদ্ধ হয়ে তিনি মানবতা, দেশপ্রেম, প্রকৃতি ও ন্যায়নীতির ভাবনাকে কবিতায় পরিস্ফুটিত করেছেন। এজন্য তার সব কবিতাই হয়েছে জীবনঘনিষ্ট এবং বাস্তব উপযোগের সমম্বয়ে ঋদ্ধ। তার কবিতায় শব্দ সংশ্লেষে লক্ষণীয় যে, ভিন্নমাত্রিক দক্ষতায় শব্দ প্রয়োগ, উপমা ব্যবহার, রূপক চিত্রকল্প সৃষ্টি, অনুপ্রাসের দ্যুতি এবং ছন্দ সচেতনায় তিনি সিদ্ধহস্ত। আর একটি বিশেষ বৈশিষ্ট লক্ষ্যণীয় তা হলো, তার অধিকাংশ কবিতা ‘আমিত্ব’ প্রভাবমুক্ত। অর্থাৎ কবিতার বিষয়বস্তুকে তিনি শুধু তার নিজের বলে প্রকাশ করেননি, তার বিষয়বস্তুর মাঝে সহজেই খুঁজে পাওয়া যাবে সর্বজনীনতা। পাঠক যখন তার কবিতা পড়বেন, তখন মনে হবে এটা যেনো তার কথাই। কবির কবিতায় এটাই হলো বড় সার্থকতা।
 
কবি বিমল গুহ কবিতা ছাড়াও সাহিত্যের অন্যান্য বিষয়েও অবদান রেখেছেন। গবেষণা, সম্পাদনা, ভ্রমণগ্রন্থ রচনা এবং বহু প্রবন্ধ তিনি রচনা করেছেন, যা বহুজন প্রশংসিত। তার প্রকাশিত গ্রন্থ সংখ্যা চব্বিশটি। তার স্বীকৃতিস্বরূপ তিনি পেয়েছেন দেশি-বিদেশি অনেক পুরস্কার।
 
তিনি কবিতার বিষয়বস্তুতে নানামাত্রিক সংযোজন ঘটিয়েছেন। তার কবিতা সম্পর্কে সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম লিখেছেন, “ ‘অহংকার, তোমার শব্দ’ বেরুবার পর সমাজ ও আত্মসচেতন কবি হিসেবে বিমল গুহ যে পরিচিতি লাভ করেছিলেন, ‘সাঁকো পার হলে খোলাপথ’ গ্রন্থের মধ্য দিয়ে তা বিস্তৃত লাভ করবে। বিমল গুহ স্বকালকে এবং স্বকালে নিজের অবস্থানকে খুঁটিয়ে দেখেছেন। প্রেম, যুদ্ধ, অহংকার, পলায়ন এইসবের মধ্যে বেড়ে ওঠা মানুষের চরিত্র বিশ্লেষণ করেছেন, যন্ত্রণাদগ্ধ মানুষ আর স্বদেশের মধ্যে যোগসূত্র খুঁজতে  চেয়েছেন। তিনি মানুষের পতনে ব্যথিত হয়েছেন, মানবিক সব সম্পর্কের ভাঙন দেখে শঙ্কিত হয়েছেন। কিন্তু সংকলনের শেষ কবিতা ‘আগামী উৎসব’-এ একটি বিশ্বাসী প্রত্যয়কেও প্রতিষ্ঠিত করেছেন। জীবনকে তিনি বাস্তবতার চোখ দিয়ে দেখেছেন, তার সব প্রকাশকে মেনে নিয়েছেন; যদিও আমোঘ কোনো নিয়তি হিসেবে নয়। ... বিমল গুহ সচেতন কবি, তবে তার সচেতনতা মানবতাভিত্তিক। তিনি মানবতাবাদী কবি। এ কারণে তার কবিতায় যে আবেদন প্রচ্ছন্ন তা সার্বজনীন”।
 
কবি বিমল গুহ অত্যন্ত সমাজ সচেতন মানুষ হিসেবে বিদ্যমান সমাজের দুঃসময়ে তিনি ব্যথিত হন, অনুভব করেন এবং মুক্তির পথ অনুসন্ধান করেন - পথ দেখাতে চান অন্যদেরকেও। এজন্য তিনি লিখেছেন, 
 
শরীরে শরীর নয়, রৌদ্রের সংসার গেছে
তমসায় ঢেকে কালরাতে -
দুর্বিনীত সাহসের ফণা
তুলে আছে বিষাক্ত ছোবল
চারিদিকে কেউ ঘুমে নেই।
এখনো একাকী রাতে শানবাঁধা পুকুরের জলে
উলঙ্গ চাঁদের দোল দেখি,
তোমারও সংসার আজ জলজ স্বপ্নিল মাছরাঙ্গা
ঠোঁটে করে তুলে আনে কেলিপরায়ণ যুবমাছ
ভেঙে দেয় জলের সংসার।
 
কিছুকাল গুণ্ঠনে আচ্ছন্ন ছিল বৃষ্টিসম্ভবা কালোমেঘ
কিছুকাল পৃথিবী দেখেনি বৃষ্টি, শস্য-শ্যামলিমা
কিছুকাল রমণীয় অহমিকা রৌদ্রচির হয়ে আছে ঠোঁটের ডগায়
কিছুকাল ফলেনি ভূমিতে শস্য
ফোটেনি বাগানে লাল ফুল
কিছুকাল ছিলো অসময় - কালবেলা।
 
আমার সংসারজুড়ে শকুনেরা পাখা ঝাপটায়
ভাগাড়ে মিছিল নামে রৌদ্রে-দুপুরেও
...    ...     ...    ...
জীর্ণ শরীর থেকে
মৃত্যুর দুর্গন্ধ ভেসে আসে -
কৃষকেরা দেয়নি জমিনে চাষ বহুদিন
রৌদ্রতপ্ত মাটি চৌচির
ভ্যাপসা দুর্বিসহ তাপে জর্জর
তাতে গেছে পুকুরের জল
...     ...     ...     ...
এখন শরীর নয় - কর্মবিলাসী এইদিনে
বৃষ্টির জন্যে শুধু প্রার্থনায় থাকা ।
(সাঁকো পার হলে খোলাপথ: এখন শরীর নয়, কর্মবিলাস)
 
সুতরাং চরম দুঃসময়েও বেঁচে থাকার জন্য অর্থাৎ উত্তরণের জন্য কবির প্রার্থনা হলো মুক্তির অভিপ্রায়ে এবং সেখানেই পথের অনুসারীগণ খুঁজে পাবে আলোর সন্ধান। তাই পরিণতি হতাশায় নয়, উত্তরণে - একথাই কবি বলতে চেয়েছেন।
 
আমাদের কবি বিমল গুহ অন্যান্য কবিদের মতই অহিংস মতবাদে বিশ্বাসী, অসাম্প্রদায়িক চেতনায় উদ্বুদ্ধ এবং সর্বোপরি মানবতাবাদী। এজন্য তিনি বিশ্বমানবতার উদার মঞ্চে দাঁড়িয়ে প্রতিবাদ করেন বর্ণবাদের বিরূদ্ধে। সাদা কালো রঙের সহজ বিভিন্নতায় তিনি মোটেই আস্থাশীল নন, তার আস্থা রক্তলাল ঐক্যের বিনিসুঁতোর মালায় আবদ্ধ হয়ে মানুষের জন্মগত অভিন্নতায়। সেখানে বর্ণ খুবই ঠুনকো বিষয়, জাতি ও শ্রেণি সেখানে প্রাধান্য পায় না। তাই তিনি কবিতায় সোচ্চার হয়ে সেই মতবাদ প্রচার করেন, 
                         
মানুষ - নামের মধ্যে কতদূর এগোলো মানুষ?
শতাব্দীর এই প্রান্তে
আমরা নিমগ্ন শুনি একবিংশ শতকের গান
ব্যস্ততম যৌথ কনসার্ট দিকে দিকে।
হ্যালো, আফ্রিকাবাসী
তিনভাগ জলেধোয়া পৃথিবীর একপ্রান্তে
উত্তর-দক্ষিণ ব্যস্ত একখণ্ড ভূমি…
 
বাংলাদেশ সময়: ১৭১৪ ঘণ্টা, অক্টোবর ২৬, ২০১৭
এসএনএস

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।