বার্নার্ড শ-এর এই নাটকটিকেই ১৯৭১-এ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পটভূমিতে ফেলে ‘শয়তানের ছাওয়াল’ নামে চমৎকার বঙ্গীকরণ করেছিলেন বিশিষ্ট নাট্যকার নারায়ণ সান্যাল। ‘নাটকওয়ালা কলকাতা’র প্রযোজনায় শ্যামলকুমার চক্রবর্ত়ীর নির্দেশনায় মঞ্চস্থ এই নাটকটি মুক্তিযুদ্ধের এতোগুলো বছর পরেও মানুষ আগ্রহ ভরে দেখে বলে জানা যায়।
কেন নাটকটির প্রতি সকলের এতো আগ্রহ? আসলে মানুষ যেমন গৌরবের কথা জানতে চায, তেমনি দুঃখের কথাও শুনতে চায়। মানুষ ইতিহাসের পথ ধরে অতীতের আলো ও অন্ধকারের ছায়াচিত্র দেখতে উৎসুক। তবে, সেসব বিবরণ শৈল্পিক আবহে নান্দনিক আয়োজনের মাধ্যমেই মানুষ দেখতে পছন্দ করে। এ কারণেই এইসব ঐতিহাসিক নাটক বা সিনেমা পুরাতন হলেও আবেদন হারায় না।
মূল নাটকে কাহিনির গুরুত্বের কারণে যথাসম্ভব আড়ম্বরহীন হওয়ার পরেও এই নাট্য-প্রযোজনাটি দাঁড়িয়ে আছে দু’টি মাত্র উপাদানের উপরে ভর করে, এমন দাবি করেছেন বিশেষজ্ঞরা। যা বাংলায় রূপান্তরিত হওয়ায় আরও প্রবল ও সমকালীন হয়েছে। গুরুত্বের দিক থেকে প্রথম হল নাট্যকাহিনি: খান সেনার অত্যাচার নেমে আসছে বাংলাভাষী হিন্দু-মুসলমানের উপরে। মার্শাল ল বসিয়ে গ্রামের একজন একজন করে মুরুব্বি-প্রতিবাদীকে ফাঁসিতে ঝোলাচ্ছে। নাটকে বর্ণিত আহমদনগরে আহসান আলিকে ফাঁসিতে ঝোলানোর পর তারা মোতিগঞ্জ গ্রামে এসে ভিড়েছে। গ্রামের মৌলানা হাজি সাহেবকে ফাঁসিতে ঝোলানো তাদের পরবর্তী লক্ষ্য।
এ দিকে মোতিগঞ্জের ‘শয়তানের ছাওয়াল’ নামে পরিচিত হাসান আলি, ছোটবেলা থেকেই দুষ্ট, মানুষ যাকে শয়তান বা বদলোক বলেই জানে। নানা অপকর্মের মাঝেই কাটে তার কারবার। আইন-কানুন সে মানে না। আপাতভাবে গ্রামের মানুষের চোখে এই শয়তানের ছাওয়ালই বীরদর্পে ঝাঁপিয়ে মৌলানা হাজিকে পাষণ্ডদের কবল থেকে বাঁচালেন। নিজেই হাসি মুখে ফাঁসির দড়ি গলায় নিতে গেলেন। তার পর খান সেনাদের আত্মসমর্পণ এবং পুরো স্বাধীনতার লড়াইতে মিত্র বাহিনি ও মুক্তিযুদ্ধের অবদান, শয়তানের ছাওয়ালের ‘হিরো’ হয়ে ওঠা এবং পরিশেষে ‘আমার সোনার বাংলা’ গানে সমবেত ভাবে গলা মেলানো-সরলভাবে ঘটে যাওয়ায় দর্শক খানিক হাঁপ ছেড়ে বাঁচলেন। বিদেশি নাটকটিকে দেশজ আবহে পেয়ে উপভোগও করেন দর্শকরা।
যারা বাংলাকৃত নাটকটি দেখেছেন, তারা জানেন, প্রযোজনার একমাত্র আকর্ষণ শয়তানের ছাওয়াল চরিত্রে গৌতম হালদারের চিরাচরিত অভিনয়। সেই তিন দশক আগের একই ম্যানারিজম, সেই সার্কাসের ক্লাউনবৎ অঙ্গসঞ্চালন, সেই যাত্রাসুলভ উচ্চারণ শেষে দন্তব্যাদান হাসি-টানা আড়াই ঘণ্টা দর্শক উপভোগ্য মনোরঞ্জনের সমস্তই তিনি একা দিয়ে গেলেন। সহ-অভিনেতারাও আপ্রাণ চেষ্টা করেছেন। হঠাৎ বিউগল বেজে ওঠা, ক্বচিত দু’-একটা আলোর বিচ্ছিন্ন বিচ্ছুরণ, এ সমস্ত দেখে দর্শক চিন্তামুক্ত নিরাপদ নিশ্চিন্তে ক্ল্যাপ দিতে দিতে বেরিয়ে এলেন। এমন প্রশংসা বহু বছর ধরেই এই নাটকটি নিয়ে বিশ্বের নানা দেশের দর্শকদের মাঝে পরিলক্ষিত হয়েছে।
১৯৫৯ সালে ‘দ্য ডেভিল’স ডিসাইপল’ নাটকের ভিত্তিতে আমেরিকা ও ইংল্যান্ডের যৌথ প্রযোজনায় চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছিল। সাড়া জাগানো সেই ছবিতে লরেন্স অলিভার, মেরি গ্র্যান্টের মতো প্রখ্যাত শিল্পীরা অভিনয় করেছিলেন। নিউ হ্যাম্পশায়ারের একটি গ্রামের পটভূমিতে নির্মিত ছবিতে যে নিপীড়নের কথা বলা হয়েছে,তা নাটককে আরও মূর্ত করে। এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো, নিপীড়নের অধ্যায়গুলোকে বার বার মনে করিয়ে দেয়। বিশ্বের যেকোনও দেশের শোষণ নিপীড়ন এই নাটকের কাঠামোতে তুলে ধরা সম্ভব। এখানেই নাট্যকার হিসাবে বার্নার্ড শ-এর কৃতিত্ব।
এমন নিপীড়ন এখন বিশ্বের দেশে দেশে চলছে। মিয়ানমার যার জলন্ত প্রমাণ। বাংলানিউজে প্রকাশিত রোহিঙ্গাদের অবর্ণনীয় নির্যাতনের কাহিনি পড়ে বার বার বার্নার্ড শ-এর ‘দ্য ডেভিল’স ডিসাইপল’ নাটকটির কথা মনে পড়ে। নাটক যখন ইতিহাসের নির্মমতার প্রতিচিত্রে পরিণত হয়, তখন মানুষ সেই নির্মমতার স্বাক্ষী হয়ে থাকে। কিছুই ভুলতে চায় না।
বাংলাদেশ সময়: ১৭৩০ ঘণ্টা, অক্টোবর ২৯, ২০১৭
এমপি/জেডএম