ইলশেগুঁড়ি বৃষ্টিতে কাকভেজা হওয়ার বদলে আমি
ঘেমেছিলাম তীব্র ভাদুরে উত্তাপে, হাওয়ায় মিলিয়েছিল
আমার হারিয়ে যাওয়া কবিতা-অপেরার সকল প্রত্যুদ্ধার প্রচেষ্টা।
একটি কদমস্পর্শের সন্ধানে উজানে পাল জুড়তেই
ভর করেছিল জুবিলি রোডের পুরনো সেই আবছায়া ছবি;
একগুচ্ছ তাজা কদম হাতে ভর সন্ধ্যেবেলায় একা পথে হেঁটে যাওয়া;
হুডতোলা রিকশার টুংটাং, স্যাঁতসেঁতে ক্যামবিস;
যতদূর মনে পড়ে, শেষপর্যন্ত বিরহোৎসুক কদমগুলো ছুড়েছিলাম
বর্ষার অপার জলরাশিতে।
একদা আমাকে কাঁপিয়েছিল দণ্ডায়মান ল্যাম্পপোস্টগুলো।
অথচ অদ্ভুতুড়ে শহরের এ পোস্টগুলোর সাথেই ছিল
আমার সকল নীরবতার ভাগাভাগি, কাব্য-সখ্যতার মেলবন্ধন।
তবে বৃষ্টির ক্যানভাসে অনাকাঙ্ক্ষিত উপযোগ হয়েছিল-
ক্রমাগত বর্ষোপল। অতএব, অনেকটা বাধ্য হয়ে
শহরের ক্যারিকেচারে কিছুটা পরিমার্জন করেছিলাম।
আমি ছুটেছিলাম যাদুবৃক্ষের সন্ধানে - অমরত্বের পিছুপিছু,
অমরত্বের ছোঁয়ায় বাঁধা হয়ে দাঁড়ান দেবতা গিলগামেশ
আমাকে ফেরত পাঠায় কবিতাশহরে; বৃষ্টিশহরে সিক্ত হতে
আমি ফিরে আসি হেলেদুলে, বাধ্য হয়ে আবারও ফিরে আসি
আমার জীবনবোধের চৌরাস্তায়।
কোন পথে যাবো আমি?
সিদ্ধান্ত নিতে গিয়েই বেলা পার;
ফিরতি পথে কবিতা শহরের সাঁকোটি ভেঙে গিয়েছিল,
সাথে অবরুদ্ধ হয়েছিল তীর্থে পৌঁছানোর সকল দরোজা;
জলাঞ্জলি দিয়ে ফিরে চলেছিল রাতের হাজারো নিশীথ-কুটুম
আমি থমকে যাই, খোঁজ করি খেয়া নৌকার মাঝিকে-
এই অবেলায় খেয়াঘাটের মাঝি নাই, শুনি হাহাকার কোরাস,
মাঝি নাই! মাঝি নাই! বৈঠা হারানো কিরন মাঝির
আজ কোনো প্রক্সিও নাই।
একদা আমি ডুব সাঁতারেই পার হতাম
জীবনবোধের নদী। পারাপারের জন্য আমার প্রয়োজন হয়নি
কোনো কেতাবি যানের, পা-হড়কানো রাস্তায়
আমাকে সতর্ক করেনি কোনো ‘পদ্ম-সাইরেন’
যজ্ঞ যাত্রায় আমাকে পথ দেখিয়েছিল
শুধুমাত্র কতিপয় দেয়াসিনী।
আমি অবাক হইনি; হইনি কিংকর্তব্যবিমূঢ়, মুগ্ধ হয়ে
আবারও সতেজ স্পর্শের দিকে হাত বাড়িয়েছিলাম,
ডাহুকের সাথে আমার বাড়ানো হাতের ছোঁয়ায় চমকে উঠেছিল
একগুচ্ছ কচুরিফুল।
আমার কবিতাযজ্ঞে ছাপ ছিল নিঃসঙ্গতার;
ছাপ ছিল কুহেলিকার, আমি অবারিত তৃণভূমিতে
আবিষ্কার করেছিলাম জড়বদ্ধ হয়ে থাকা চরণগুলোকে,
বিক্ষিপ্ত হয়ে থাকা মেটাফিজিক্যাল কবিতাগুলোকে,
সময়ের পালকিতে বিক্ষিপ্ত হয়ে থাকা কবিতাগুলোই হয়ে উঠেছিল
একেকটি কাব্যস্তম্ভ; আমার আশ্রয়ের দেরাজ।
বিষণœ শহর হতে আমি মুক্তি চেয়েছিলাম।
তাইতো আমি ভজেছিলাম অন্ধ-বাউলের সাথে;
তার দোতারায় শুনেছিলাম কীর্তনের সুর
বাউলা-বেশে অবশেষে আমি খুঁজে পেয়েছিলাম
আমার আত্ম-চেতনাকে, আহ, মুক্তি।
বিষণœ সন্ধ্যায় কবিতার মরফোলজিতে ডুবে যায়
ঊর্মিমালার সাজসজ্জা, আমার অন্দরমহলে সলজ্জ হাসি দিয়ে
রাতের শেষ ট্রেনের শিকল টানেন রাজাধিরাজ! বর্ষবলয়ে ঘুরেফিরে
কাছে চলে আসে বৃষ্টি-নগর, কবিতা-নগর... ক্রমান্বয়ে
আরও কিছুটা দূরে উঁকি দেয় আবছায়া ভালবাসা-নগর
সে নগরে রাত ফুরোয়, গান ফুরোয়,
একসময় বুঝি ভালবাসাও ফুরোয়;
শেষঅব্দি যাত্রামঞ্চে আবির্ভূত হয় সাতপ্রহর।
নিঃসঙ্গতার কফিন মুচড়িয়ে প্রথম প্রহরে সেরা কুশীলবরা
একে একে উপস্থিত! সময়ের ঘণ্টা বাজিয়ে আমাকে জানান দেন
কবিতা-মঞ্চ ত্যাগ করার; তবে যাওয়ার আগে আমি আশ্রয় খুঁজি
প্রকৃতির কাছে, ত্রাতা হয়ে সম্মুখে দণ্ডায়মান হয় রাতের আমব্রেলা-
আসে হিমায়িত প্রহর, কালো ঝুঁপড়ির আড়ালে জমাটবদ্ধ হয়ে
কেটে যায় নিষ্ফলা কয়েকশো বছর!
আমাকে জাগিয়ে তোলেন নিঃসঙ্গতার রাজা!
তাইতো পুনর্জীবনে ওয়ার্ডসওয়ার্থেই যুঝেছিলাম,
ছিনিয়েছিলাম তার নিঃসঙ্গতার সংজ্ঞা; তবে
ঘুরেফিরেই কাটতে থাকে ম্যালাপ্রপিজমের রোশনাই!
মাঝের প্রহরগুলো কিছুটা অস্পষ্টই থেকে যায়।
সমস্ত শহর চষে আমি থমকে দাড়িয়েছিলাম
না, কোনো নারকোটিক্সের প্রাবল্যে এ থমকে যাওয়া নয়।
আমাকে থামিয়েছিল কেবলই বৃষ্টি-শহরের উপপাদ্য।
কাঁটা-কম্পাস নিয়ে আমি মত্ত হয়েছিলাম ফেলে আসা শহরের
আদি-অন্তের হিসেব কষবার; উৎসমুখ খুঁজে বের করবার
হিসেব বরাবরের মতোই এক অসমাপ্ত, ইনফিনিটির গল্প!
আজ কবিতার ডালাপালায় গজিয়ে উঠা আষাঢ়ে ঝড়ো হাওয়া
সময়ের-পন্টুনে এসে একদম পাল গুটিয়ে বসে থাকে।
বুনন-বর্ণনে বর্ষণসিক্ত সময় হয়ে উঠে চিরবসন্তের পুঞ্জি।
বাংলাদেশ সময়: ১৯৫৪ ঘণ্টা, নভেম্বর ০৮, ২০১৭
এসএনএস