নোংরা, আবর্জনা, জঞ্জাল ও কোলাহলে নদী ও নগরের নাভিশ্বাস উঠেছে। ক্ষয় রোগীর মতো ক্লান্তি ও বিষণ্নতায় সতেজ-মানুষ ও সবুজ-প্রকৃতি পাণ্ডুর হয়ে গেছে কিশোরগঞ্জে।
জানি স্মৃতির শহরের ভীষণ সুন্দর প্রতিচ্ছবি কখনোই আর ফিরে আসে না! অতীতের উজ্জ্বল দিনগুলোর স্মৃতিচিত্রও ক্রমেই ঝাপসা আর মলিন হয়। যা আসে, তাতে বাহার ও জৌলুস থাকলেও ‘প্রাণ’ থাকে না।
হৃদয়হীন বিকাশের পথ ধরে বর্তমান সবেগে ধেয়ে চলে নিষ্ঠুর বাস্তবতা পেরিয়ে কঠোর ভবিষ্যতের দিকে। স্তব্ধ বিস্ময় নিয়ে আমরা দেখি ক্রান্তিকালের যান্ত্রিক পালাবদল।
কিশোরগঞ্জে এলেই আমার মন বর্তমানে নয়, অতীতের নস্টালজিয়ায় চলে যেতে চায়। টুইটুম্বুর নদীতে রঙিন পালের শত শত নৌকা। ঝুলন, রথের মেলা, শীতের সার্কাস, কৃষি-শিল্প প্রদর্শনীর আঙিনায় হানা দিয়ে খুঁজতে চাই প্রিয় মুখ ও প্রিয় স্মৃতি। কিন্তু চাইলেও সব কিছু আর আগের মতো পাওয়ার উপায় নেই?
প্রমত্তা নরসুন্দা নদীতে ঝাঁপ দিয়ে সাঁতার কাটার দিন আর নেই। ইসলামিয়া ছাত্রাবাসের খোলা চত্বর এখন মার্কেট। পুরনো স্টেডিয়াম, শিল্পকলা একাডেমি অব্যবহারে জীর্ণ। রথখলার মাঠে বিকেলের ভলিবল খেলার জায়গাটিও লুপ্ত হয়েছে। উত্তেজনা আর রোমাঞ্চের দিনগুলো পুরনো ক্যালেন্ডারের পাতায় হারানো তারিখের মতো অপসৃত।
আমাদের শৈশবে বিশ্বায়নের কথা আমরা শুনি নি। আমাদের জগৎ ছিল উত্তরের ময়মনসিংহ, দক্ষিণের ঢাকায় সীমাবদ্ধ। কখনো পূর্বের সিলেট বা কুমিল্লা কিংবা চট্টগ্রাম পর্যন্ত প্রসারিত। তাও সারাদিনে একটি কি দু’টি ট্রেন। দিনভর জার্নির আয়োজন শেষে গভীর রাত্রে কিংবা পরদিন গন্তব্যে পৌঁছার সুযোগ বিশ্বায়নের মতো বড় দিগন্ত তখনো আমাদের সামনে উন্মোচিত করে নি।
সত্তর-আশি দশকের শৈশব-কৈশোরে কিশোরগঞ্জের স্থবির দিনে নদী, পুকুর, পতঙ্গ, বিহঙ্গ ও পুষ্পময় জীবনে বিশ্বায়ন এসে হানা দেয় আরো পরে। আজহার চলে যায় স্পেনে। টুপন ভাই আমেরিকায়। খোকন মামা ইংল্যান্ড, হাম্মাদ ময়মনসিংহ, আমি চট্টগ্রামে। ঈসা খাঁ রোড, গৌরাঙ্গ বাজার, পুরান থানা দিয়ে হাঁটতে গেলে আজকাল ভাবি, আহ! এইখানে যারা ছিলাম, তারা এখন কে কোথায় ছিটকে গেছে!
বিশ্বায়নের দূরত্বের যাতনা অবশ্য প্রযুক্তি কমিয়ে দিয়েছে। বিচ্ছেদ ও যোগাযোগহীনতার প্রকোপ হ্রাস করেছে।
ইন্টারনেট, মেসেঞ্জার, স্কাইপে, মোবাইলে প্রায়ই সবার সাথে কথাবার্তা হচ্ছে। ফেসবুকে দেখতে পাচ্ছি, কে কোথায় আছে, কি করছে। বছরে, দুই বছরে দেখা সাক্ষাতও হচ্ছে। সবাই একসঙ্গে না হলেও বিচ্ছিন্নভাবে সংযোগ থাকছেই। যে যেখানেই থাকুক, জন্মস্থানের প্রতি টান ও মমতা সুযোগ পেলেই উপচে পড়ছে। এবং জীবনও এভাবে এগিয়ে চলছে স্মৃতির লাল-নীল দিনগুলোকে হৃদয়ে ধারণ করে।
জানি, অনাগতকালে ছেলে-মেয়েরা এতোটা স্মৃতিকাতর হবে না। নস্টালজিয়া নামক শব্দটির অর্থই হয়ত তাদের কাছে অন্য রকম হবে। তারা হবে বিশ্বের নাগরিক। স্থানীয়ভাবে কোনো অঞ্চল বা দেশের সন্তান হয়েও তাদের প্রধান পরিচয় হবে বিশ্ব-নাগরিক। আজ ইউরোপ তো কাল অস্ট্রেলিয়ায় জীবন কাটাবে তারা। পড়বে আমেরিকায়, চাকরি করবে কানাডায়, শেষ জীবনের অবসর উপভোগ করবে ইতালির পাশে চমৎকার কাপ্রি দ্বীপে।
আরো পরে, কেউ কেউ হয়ত বিশ্বের পরিবর্তন ও গতির টানে পা বাড়াবে চাঁদে কিংবা মঙ্গলে কিংবা মহাশূন্যে খুঁজে পাওয়া কোনো মায়াবী নক্ষত্রে। ম্যাগিলানের স্বিগ্ধ ছায়ায় কাটবে তাদের জীবন। সুপারনোভার অতুজ্জ্বল আলোকছটায় ভেসে যাবে তারা অনন্ত নক্ষত্রবীথির পথে-প্রান্তরে। প্রতিবেশী হিসাবে তারা পাবে একখণ্ড নিটোল চাঁদকে; তারাভরা পুরোটা আকাশকে টেনে নেবে নিজের আয়ত্তে। মহাবিশ্বের রহস্যঘেরা বিবরে
আলগোছে মিশে যাবে তারা। থেকে যাবে মহাজাগতিক অস্তিত্বে।
বিশ্বায়নের মাতাল সমীরণে কিশোরগঞ্জে ফিরে এলে আমরা নস্টালজিয়ার কাছে চলে যাই। অনাগত প্রজন্মের সামনে এগিয়ে যাওয়ার পথরেখা দেখতে দেখতে আমরা খুঁজি ফেলে আসা পথচিহ্ন আর স্মৃতির সরণি। প্রিয় নদী, প্রিয় ফুল, প্রিয় মাঠ, উদাসী বাতাস, প্রিয়তম পাখিটির দেখা পেতে আমরা হারিয়ে যেতে থাকি অতীতের হীরন্ময় প্রকোষ্ঠে। স্মৃতি-সত্ত্বা-ভবিষ্যতকে সঙ্গী করেই মানুষ এভাবে এগিয়ে যায় জীবনের অনিবার্য
পথে। কখনো সামনে, কখনো পেছনের দিনে ঘুরে ঘুরে মনে হয়, সত্যিই সার্থক এই মানবজনম।
আহ! বেঁচে থাকা কতো সুন্দর! পাওয়া আর না পাওয়ার মাঝখানে অনিন্দ্য-আনন্দ এক ঝলক অদেখা বাতাসের মতো জড়িয়ে রাখে আমাদের। আমরা ছড়িয়ে যাই মহাবিশ্বের অলিন্দে অলিন্দে; প্রিয়তম জন্মমাটিতে। নাড়ি-পোঁতা মাটির সঙ্গে এই অচ্ছেদ্য সম্পর্কই মানুষকে শেষ পর্যন্ত ধরনীর সন্তানরূপে বাঁচিয়ে রাখে!
ড. মাহফুজ পারভেজ: কবি-কথাশিল্পী- গবেষক। প্রফেসর, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
বাংলাদেশ সময়: ১০০০ ঘণ্টা, নভেম্বর ৯, ২০১৭
এমপি/জেডএম