দুপুর ধীরে ধীরে লালচে বিকেলে গড়ায়। টের পাই মানবীর সতর্ক চোখ অনবরত খেয়াল রাখছে আরেকটি বাচ্চার দিকে; মাঝে মাঝে কড়া গলায় শাসন করছেন, এই মিতালি, সাবধান, রিস্কি খেলা খেলে না; সহজ কিছু খেল মা।
বাইরে সন্ধ্যার আঁধার জমাট হয়; রাস্তায় দেখা যায় মলিন, ব্যস্ত নাগরিক জীবন; আমরা ধীরে ধীরে পাশ কাটিয়ে এগিয়ে যাই। আয়েশার বর সাইফ অফিসের কাজে দেশের বাইরে গিয়েছেন, ফিরতে কয়েকদিন লাগবে। সাইফ জাতিসংঘের শিশু তহবিল ইউনিসেফে কাজ করেন। আমাকে চমকে দিয়ে আয়েশা বলেন, সাইফের বাড়ি বাংলাদেশে, কুমিল্লায়! আমি বিস্তারিত কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই হাসপাতালে পৌঁছে যাই। গিয়ে দেখি, মিতালি বসে আছে, বিশেষজ্ঞ নার্স বলেছেন আপাত দৃষ্টিতে কী হয়েছে বোঝা যাচ্ছে না, নিশ্চিত হতে মাথায় এক্স-রে করা লাগবে; তারপর ডাক্তার দেখবেন। কতোক্ষণ বসে থাকতে হবে বলা যাচ্ছে না। তার উপর জরুরি বিভাগে দেখা যাচ্ছে অসংখ্য পেশেন্টের সমাগম, বোধকরি সারারাতও লেগে যেতে পারে। অগত্যা আয়েশা আমাকে বিনয় করে বলেন, আপনার উপকারের জন্য অনেক অনেক ধন্যবাদ। আমি বাকি দিকটা টেক কেয়ার করতে পারব। রাত হয়ে যাচ্ছে, আপনি প্লিজ চলে যেতে পারেন। আমি তাকে বিনীতভাবে বলি, না, না, ঠিক আছে, এভাবে আপনাকে রেখে যাওয়া যায় না। তাছাড়া আমরা তো কাছাকাছি নেইবারহুডে থাকি, আপনাকে বাসায় নামিয়ে দিয়ে যাব। আমি আসলে মনে-প্রাণে চাইছি তার সম্পর্কে আরও জানতে, মনে হচ্ছে তার কোনো উপকার করতে পারলে জীবন ধন্য হবে, শরণার্থীদের কষ্টও খানিকটা অনুধাবন করার আগ্রহ জাগে। কিন্তু আয়েশার এরকম নাজুক পরিস্থিতিতে আমি বিশদ কীভাবে জিজ্ঞাসা করি; জিজ্ঞাসা করা ঠিক হবে কি-না ভেবে ভেবে চুপ মেরে বসে থাকি। হাসপাতালের ওয়েটিং রুম অপেক্ষামান মানুষে জনারণ্য হয়ে আছে, আমরাও এক কোণায় চেয়ার ফাঁকা পেলে বসে পড়ি। তারপর আয়েশার কী হয়, মেয়ের জন্য উৎকণ্ঠা আর অপেক্ষায় ক্লান্ত হয়ে পড়লে আস্তে আস্তে নিজেকে আমার কাছে খোলাসা করেন; তার জীবনের একটা অমোচনীয় ঘটনা সবিস্তার বর্ণনা করেন। আমি তা আজকেই বলবে আশা করিনি। একটানা অপেক্ষা কী কখনও কখনও মানুষকে কথা বলায় আগ্রহ করে তোলে; সময়কে বয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য এরচে ভালো আর কী উপায় আছে। অথবা হতে পারে, মায়ানমারে রোহিঙ্গাদের নিয়ে সাম্প্রতিক পাশবিক ঘটনাবলী আয়েশাকে কাতর করে দেয়।
কান্নামিশ্রিত মুখ নিয়ে আয়েশা বলেন, এবারকার মতো নব্বই দশকের গোড়াতেও রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গা জাতির উপর উচ্ছেদ, অত্যাচার, ধর্ষণ ও হত্যাযজ্ঞ শুরু হয়। ধর্ম ও নৃতাত্ত্বিক ভেদের কারণ-অকারণ ছুতোয় বার্মিজ আর্মি আর স্থানীয় মগদের কী মর্মান্তিক, কী বিভৎস অত্যাচার চলে রোহিঙ্গাদের উপর। হাজার হাজার রোহিঙ্গা বিতাড়িত হয়ে কোনোরকমে জান নিয়ে ওপারে বাংলাদেশে চলে যায়। আমাদের গ্রামের মানুষরাও উৎকণ্ঠায় দিন গুনছি কবে যে শুরু হবে আক্রমণ। নিজেদের ভিটে-মাটি-শেকড় বড় না জীবন বড়, এই নিয়ে সংকট চলে, তর্ক চলে। বাবা-মা ভিটে-মাটি ছেড়ে যাবেন না; একমাত্র সন্তান হিসেবে আমার কিছু বলার থাকে না। আর আমি তখন সবে কৈশোর অতিক্রম করছি। বেশীরভাগ রোহিঙ্গাদের মতো আমার বাবা-মাও বাড়ির কাছের জমিতে কৃষিকাজ করে জীবিকা নির্বাহ করেন। একদিন বিকেলে আমি গিয়েছি জমিতে গাছপালায় পানি দিতে, জমি থেকে টের পাই, আর্তচিৎকার ভেসে আসছে; আমি ঝোপের আড়ালে লুকিয়ে পড়ি, তাকিয়ে দেখি আমাদের গ্রামে বার্মিজ আর্মি আক্রমণ করেছে, আমাদের বাড়ি থেকে আগুনের লেলিহান শিখা উঠতে দেখি। বাবা-মার জন্য ঊর্ধ্বশ্বাসে দৌড়ে যেতে থাকলে, আমাদের নিকট প্রতিবেশী খালার পরিবারকে দেখি জমির পাশ দিয়ে পালিয়ে যাচ্ছেন। আমাকে দেখে আমাকে থাবা দিয়ে থামিয়ে চিৎকার করে বলেন, সব শেষরে মা, সব শেষ! তোর বাবা-মাসহ তোদের ঘরবাড়ি সব পুড়িয়ে দিয়েছে ডাকাত আর্মিরা। ওদিকে যাইস না আর। খালার একথা শুনে আমি হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হয়ে পড়ে যাই। খালার পরিবারের কী মানবিকতা, এই দুর্যোগের সময়ও আমাকে ফেলে চলে যাননি। ততোক্ষণে সন্ধ্যার আঁধার আমাদের ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কান্নার আর্তনাদে জমাট হয়। যদি আর্মিরা দেখে ফেলে এই ভয়ে আমরা গলা ছেড়ে কাঁদতেও পারিনি। খালা আমাকে এক প্রকার টেনে হিঁচড়ে নেওয়ার উদ্যোগ নিলে আমি কিছুতেই বাবা-মা’র লাশটা অন্তত শেষবারের মতো না দেখে যাব না বলে গোঁ ধরি। আমার বিশ্বাস হয় না এভাবে বৃদ্ধ বাবা-মা’কে কেউ মেরে ফেলতে পারে। এভাবে কখন আমি বুক ভেঙে বিলাপ করে নেতিয়ে পড়ি জানি না। পাটক্ষেতের দীর্ঘ আড়াল আমাদের আশ্রয় দেয়; আমি ধীরে ধীরে ধাতস্থ হলে খালা মিনতি করে বলেন, ওপারে বাংলাদেশে যাওয়া ছাড়া আমাদের আর কোনো জায়গা নেই, আমাদের এক্ষুণি রওয়ানা দিতে হবে। আর কোনো উপায় নেই ভেবে আমি নিয়তিকে প্রশ্ন করে রাজি হই; আমরা সারারাত অজানা ও বিপদসংকুল দীর্ঘ পথ পাড়ি দেই, অবশেষে নাফ নদের তীরে পৌঁছাতে সক্ষম হই। এই পর্যন্ত বলে আয়েশা দীর্ঘ নিঃশ্বাস নেয়।
আমি চেয়ে দেখি তার মুখ ভীষণ কষ্টে থমথমে হয়ে আছে। ওয়েটিং রুম নানান জাতের মানুষে গমগম করছে, সবারই চোখমুখ উৎকণ্ঠা আর দুর্ভাবনার অভিঘাতে মিইয়ে যাচ্ছে; সবারই একমাত্র প্রার্থনা, তার রোগীটার যেনো খারাপ কিছু না হয়, ডাক্তার যেনো সুস্থতার সার্টিফিকেট দেন; তারা যেনো তাড়াতাড়ি রোগীকে নিয়ে আপন ঠিকানায় ফিরে যেতে পারেন। মনে হলো, বড় বাচ্চাটির এক্স-রে কখন হতে পারে খবর নেওয়া দরকার; আমি উঠে গিয়ে নার্স স্টেশনে যাই, কেমন সময় লাগবে জিজ্ঞেস করি। নার্স কোনো স্পেসিফিক টাইম দিতে পারছেন না। ঠিক আছে বলে, আমি ওয়েটিং রুমে রাখা পানির জার থেকে এক গ্লাস পানি নিয়ে আয়েশার দিকে এগিয়ে দেই। আয়েশা ধন্যবাদ বলে পানির গ্লাস হাতে নিয়ে ফের শুরু করেন, তারপর দালালের মাধ্যমে জীবনবাজি রেখে ছোট ট্রলারে করে নাফ নদ পাড়ি দেই; বাংলাদেশে আমাদের শরণার্থী ক্যাম্পে আশ্রয় মেলে। ক্যাম্পে অনেকদিন আমি ট্রমাটাইজড হয়ে পড়ি, সারাক্ষণ ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকি আর আমার খালি মনে হয়, বাবা-মা এখনও বেঁচে আছেন, এক সময় আমাকে নিতে আসবেন। প্রতিনিয়ত অপেক্ষা করি, বাবা-মা আসেন না। কয়েকমাস পর ক্যাম্পের জীবনযাত্রায় ধীরে ধীরে অভ্যস্ত হই; মেনে নিতে চাই না, তবুও মনে হয় মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে এসে বেঁচে তো আছি। বেঁচে থেকেও পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে, নিজ দেশের আলো-বাতাস থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে, কী বিষাদ বেড়ে উঠা।
আয়েশা একটু বিরতি নেন, চোখ মেলে সামনে রাখা অর্কিড গাছের দিকে তাকান, ম্রিয়মাণ কণ্ঠে বলেন, আহা, আমাদের উঠোনে লাল জবা গাছগুলো কি আজো ফুলে ফুলে ছেয়ে গেছে, নাকি বুলেটের আঘাতে সারা উঠোন লাল জবায় এখনও ভেসে আছে। নাকি বাবা আসলে বেঁচে আছেন; প্রতিদিন লাল জবার দিকে তাকিয়ে ব্যাকুল হয়ে আমাকে খোঁজেন। শেষদিন তো আমার পরনে লাল ফ্রক পরা ছিলো, বেণি দু’টো বাঁধা ছিলো লাল ফিতায়।
রাতটা যেনো ঝিম ধরে থাকে, গুমোট অশান্তিতে ওয়েটিং রুমের বাতাস ভারী হয়ে আসে। একজনকে দেখি হাসপাতালের রিসেপশানে গিয়ে অধৈর্য হয়ে চেঁচামেচি শুরু করে দিয়েছেন; কর্তৃপক্ষ তাতে ভ্রুক্ষেপ করলেন না, মোলায়েম স্বরে বললেন, জনাব আপনি যখন এসেছেন তখন আমাদের অভিজ্ঞ নার্সরা প্রাথমিকভাবে আসেসমেন্ট করে আপনার রোগের সেভেরিটি অনুযায়ী আপনাকে সিরিয়ালে ফেলেছেন, ওই মোতাবেক দেখা হবে। কাজেই দয়া করে অপেক্ষা করুন, যথাসময়ে আপনার ডাক আসবে। এরই মধ্যে দেখি হঠাৎ করে দীর্ঘ অপেক্ষায় থাকা এক বৃদ্ধ রোগী মূর্ছা যান, মুহূর্তে নার্স এসে পরিচর্যায় লেগে পড়েন; স্ট্রেচারে করে বৃদ্ধকে ভেতরে ডাক্তারের চেম্বারে নিয়ে যান। বৃদ্ধটি নিশ্চয়ই পাঞ্জাবি শিখ হবেন; পরনে শিখদের মতো লম্বা পায়জামা-পাঞ্জাবি, হাতে ব্রেসলেটের মতো স্টিলের চুড়ি আর মাথায় শিখ পাগড়ি পরা।
কী পবিত্র ব্যাপার দেখেন, ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে মানুষকে বাঁচাবার জন্য কী অবিরাম মানবিক চেষ্টা চলছে এখানে, অথচ বাইরের পৃথিবীটা কেন এতো ধর্ম আর বর্ণবৈষম্যে বিভক্ত! প্রশ্নটি বাতাসে ছুড়ে দিয়ে আয়েশা এবার ওয়েটিং রুমের চারপাশে তাকান; অপেক্ষারত প্রতিটা মানুষের মুখ পড়ে দেখেন। তার মনে হচ্ছে, শরণার্থীর প্রবল ঢলে ওয়েটিং রুমটা নাফ নদের তীরের মতো ভেঙে পড়ছে, ওয়েটিং রুমটা যেনো হয়ে উঠছে একেকটা শরণার্থী ক্যাম্প। আয়েশা আমার দিকে তাকিয়ে ক্লান্ত মন নিয়ে অং সান সু চিকে কাঠগড়ায় দাঁড় করান; ভাষণের স্বরে বলেন, ‘অং সান সু চি তুমি তো শান্তিতে নোবেল পেয়েছ, তা আমাদেরকে একদণ্ড শান্তি দিতে তোমার আর কতো রক্ত দরকার, আর কতো শরণার্থী দরকার। একটা ন্যায্য সমাজ গড়তে তোমার কেন এতো রাজনীতি, কেন এতো ধর্মীয় অন্ধত্ব’।
খেয়াল করি দেখি আয়েশার চোখের কোণে অসহায় কান্নার জল টলমল করছে। আমি একাত্ম হয়ে জিজ্ঞেস করি, আচ্ছা, তোমাদের কি নেলসন মেন্ডেলা বা শেখ মুজিবের মতো কোনো নেতা আসেনি? আয়েশার করুণ উত্তর, শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে আমাদের দাবিয়ে রাখা হয়েছে, বঞ্চিত করা হয়েছে নাগরিক অধিকার থেকে, নেতা কেমন করে আসবে; নেতা হওয়ার আগেই গুম হয়ে যান অনেকে নতুবা অন্যায়ভাবে মেরে ফেলা হয়।
ছোট বাচ্চাটি এতোক্ষণ দারুণ লক্ষ্মী আর চুপচাপ ছিলো, বোধহয় বুঝতে পারছিল তার মা আজ খানিকটা নির্ভার হতে চাইছেন। হঠাৎ ছোট বাচ্চাটি কেঁদে উঠে, বোধহয় খিদে পেয়েছে; বিরক্তি তার চোখে-মুখে। আয়েশা বাচ্চাটিকে বুকের দুধ দেওয়ার জন্য প্রাইভেসি রুম খোঁজেন। হাসপাতালের ম্যাপ অনুযায়ী প্রাইভেসি রুম একটু দূরে, আয়শা বেবি স্ট্রলার ঠেলে সেদিকে দ্রুত হাঁটতে থাকেন; ততোক্ষণে বাচ্চাটি অনবরত চীৎকার করে কেঁদে যাচ্ছে।
বাংলাদেশ সময়: ১৮৫৮ ঘণ্টা, নভেম্বর ০৯, ২০১৭
এসএনএস