আলাপচারিতা ১ম পর্ব: লেখক হতে গেলে ফাঁকিবাজি করে কিছু হয় না
আলাপচারিতা ২য় পর্ব: লেখকদের বিয়ে করা উচিত নয়
মেঘে মেঘে বেলা তো কম হলো না। দীর্ঘ জীবন যাপনের এই পর্বে এসে জীবন, মৃত্যু, প্রেম, সমাজচিন্তা, শিল্প, সাহিত্য, সংস্কতি প্রভৃতি নিয়ে বাংলানিউজের সঙ্গে এক একান্ত আলাপচারিতায় মেতে ওঠেন জননন্দিত এ লেখক।
বাংলানিউজ: মৃত্যু নিয়ে কী ভাবেন?
বুদ্ধদেব গুহ: ‘মরণ রে তুহু মম শ্যাম সমান’!
অনেক দৌড়েছি। সারা পৃথিবী ঘুরেছি, অনেক পেয়েছি, অনেক কাজ করেছি। এখন বিশ্রাম, শান্তির ঘুম পেতে ইচ্ছে করে। আমার আর কিছু চাইবার নেই, কোনো অভিযোগ নেই। তবে আমার লেখক জীবনে যারা আমার সঙ্গে অন্যায় করেছে সে লেখক হোক বা খবরের কাগজের সম্পাদক-মালিক যারাই হোক তাদের যেনো ঈশ্বর ক্ষমা করেন। এখন যদি মৃত্যুর পর জানা যায় ঈশ্বর কে বা কী!
বাংলানিউজ: আপনি তো মূর্তি বিশ্বাস করেন না তাহলে কী কোনো শক্তিকে বিশ্বাস করেন? কারণ আইনস্টাইন, নিউটন— বিশেষকরে নিউটন নিজে অতিপ্রাকৃত শক্তি নিয়ে কাজ করেছেন— আপনার কী মনে হয় এ ব্যাপারে? দেহ বা আত্মা কোনটা আপনার কাছে বেশী প্রভাবশালী?
বুদ্ধদেব গুহ: হ্যাঁ, সুপারন্যাচারাল কিছু আছে বলে বোধ করি। কারণ, এই এতো ভিন্ন মানুষ এতো অদ্ভুত সব সৃষ্টি, কে ঠিক করে দেয় এসব! আমি জানি না তবে মনে হয় একটা শক্তি আছে।
অবশ্য আত্মা বেশী প্রভাবশালী কারণ, দেখা যায় না। এই বিমূর্ত বোধের তো অনেক দিক, অনেক রহস্য তাই অনেক বেশী প্রভাব বিস্তারে সক্ষম।
বাংলানিউজ: বাংলাদেশের লেখা, বাংলাদেশ এসব নিয়ে কিছু মনের কথা বলুন?
বুদ্ধদেব গুহ: হুমায়ূন আহমেদ আমার ভালোলাগার লেখক, যদিও আমি খুব বেশী পড়ার সুযোগ পাইনি। তবে শুনেছি তিনি নাকি কাকে বলেছিলেন, “আমাকে বুধদেব গুহর একটা অটোগ্রাফ জোগাড় করে দিতে পারেন”! তারপর নির্মলেন্দু গুণের কবিতা আমার খুব ভালো লাগে। আসলে দেড়শোর ওপর উপন্যাস লেখা, তারপর চাকরি— আমি বই সেইভাবে পড়ার সময় পাইনি। তবে বাংলাদেশ নিয়ে আমার অনেক স্মৃতি আছে। ২০১৮ বইমেলায় নবকল্লোল হাউজ থেকে আমার একটা বই আসছে নাম “ছেঁড়া ক্যানভাস”, এর প্রাসঙ্গিকতাজুড়ে বাংলাদেশ। সেখানে আমি কিছু কথা লিখেছি যে, একটা গান আছে “তু হিন্দু বনেগা না মুসলমান বনেগা/ ইনসান কি অলাদ ইনসান বনেগা”। আরও লিখেছি, “হে মোর দুর্ভাগা দেশ, যাদের করেছ অপমান, /অপমানে হতে হবে তাহাদের সবার সমান!”
আমি আসলে নিজে চোখে দেখেছি ওখানকার গরির মুসলমানদের প্রতি হিন্দুদের খারাপ ব্যবহার। ভূমিকাতে আমি লিখেছিও। আমি দেখেছি, আমাদের রংপুরের বাড়িতে এক লম্বা-চওড়া মুসলিম ঘরামী কাজ করতে করতে হঠাৎ অজ্ঞান হয়ে দাওয়ায় পড়ে গিয়ে জল চাইল। আমার ঠাকুমা কিছুতেই জল দেবে না, পরে কেউ একজন এসে তাকে জল দিলো। সে জল খেয়ে চলে গেলো তারপর ঠাকুমা ওই জায়গা গোবর দিয়ে লেপে দিতে বলল, অথচ এই ঠাকুমাই দেশভাগের সময় বদলে গেলেন।
আমার সেজ কাকা যে আমায় প্রথম খাগের কলম দুধে ভিজিয়ে হাতেখড়ি দিয়েছিলেন তার কাছেই আমি বাংলা পড়তাম। তো কাকা এক ১৯-২০ বছরের একটি মুসলিম মেয়েকে নিয়ে এলো, সে কিন্তু ঠাকুমার ঘরে ঘুমাতো আর ঠাকুমা ঘরের কোণে যে হবিষ্যি রান্না করত তা তাকে দিয়েই খেত, ফলে কেন এই বদল কারণ, মানবিকতা ও মনুষ্যত্ববোধ। সেজ কাকাকেই এই বই উৎসর্গ করা। ফলে এইসব ভাগ সব ভুলভাল। শেষপর্যন্ত মানুষই সব।
বাংলানিউজ: এখন আলাদীনের প্রদীপ আপনাকে দু’টো বর দিতে চাইলে কী চাইবেন?
বুদ্ধদেব গুহ: এক, যেনো ভায়োলেন্ট ডেথ না হয় কারণ, যন্ত্রণাকে আমি খুব ভয় পাই! আমার হাতে নাকি আছে আমার ভায়োলেন্ট ডেথ হবে, যদিও অ্যাস্ট্রোলজি বিশ্বাস করি না তবে যিনি বলেছেন তার সব কথা যেহেতু সব সত্যি হয়েছে ফলে ভয় হয়! তিনি বলেছিলেন, আপনি টাকার উপর দিয়ে হেঁটে যেবেন, না চাইলেও টাকা আপনার কাছে আসবে; প্রচুর মেয়েরা আপনাকে ভালবাসবে; যোগ্যতা অনু্যায়ী যশ কম হবে, সবই মিলেছে। আর আমি রক্ত, ইনজেকশন খুব ভয় পাই। যখন শিকার করতাম, পাহাড়ে ঘুরতাম, জিপ চালাতাম তখন হতেই পারত। তারপর অনেক কারণে অনেক মনোমালিন্যে অনেক সময় মরে যেতে ইচ্ছে করেছে খুব, তখন হয়নি তাই এখন ভয় পাই! তাই ওটা যেন না হয়।
আর যতোদিন বাঁচি যেনো মানুষের জন্য করে তাদের ভালোবেসে যেতে পারি। এই আমার গৃহকর্মীরা জানে, তাদের জন্য যা পারি করি। তাদের সঙ্গে মিশে যেনো থাকতে পারি। আসলে গাছপালা, প্রকৃতিই তো ঈশ্বর! বিশ্বাস করি, “জীবে প্রেম করে যেইজন সেইজন সেবিছে ঈশ্বর”
বাংলানিউজ: কী খেতে খুব ইচ্ছে করে এখন?
বুদ্ধদেব গুহ: হুইস্কি খেতে খুব ইচ্ছে করে। তারপর ঘি দিয়ে জমিয়ে মাটন রেঁধে দিলে খুব ইচ্ছে করে খেতে। এরা সব বারণ করে রেখেছে, খেতে দেয় না। বারণ যেগুলোতে নেই সেগুলোর মধ্যে ওই কচুশাক, আলুপোস্ত ভালো লাগে। মুসলমানি খাবার খেতে খুব ভালো লাগে আমার।
বাংলানিউজ: লেখা, গান, আঁকা এই তিনটে মাধ্যমেই আপনি আছেন, কোনটার কাছে বেশী করে আপনার যেতে ইচ্ছে করে এখন?
বুদ্ধদেব গুহ: আঁকা, আঁকতে খুব ইচ্ছে করে। ক্রিয়েটিভিটির শীর্ষ হচ্ছে আঁকা। এখন তো চোখে ভালো দেখি না ফলে আর আঁকা হয় না কিন্তু খুব ইচ্ছে করে।
বাংলানিউজ: লেখক বা কবি হিসেবে কাদের লেখা ভালো লাগে সমসাময়িকের মধ্যে?
বুদ্ধদেব গুহ: কবি তো অনেকেই আছেন। শক্তি চট্টোপাধ্যায় খুব শক্তিশালী। আর বাকি যাদের খুব নামডাক তাদের লেখা আমায় অতো টানেনি। আর গদ্যে সতীনাথ ভাদুড়ি। আমাদের পরবর্তীতে দু-একজনের লেখা ভালো লাগে। যেমন স্বপ্নময় ভালো লিখছে এখন!
বাংলানিউজ: প্রথম কবিতা দেশ পত্রিকায় বেরিয়েছিল আপনার, তারপর এখন আর সেভাবে কবিতা লিখতে ইচ্ছে করে না?
বুদ্ধদেব গুহ: হ্যাঁ, এখন আমার কবিতা লেখা আর ছবি আঁকতেই ইচ্ছে করে। আসলে কবিতা তো আতর আর গদ্য হলো পারফিউম। আর গান তো ভেতরে থাকেই। ঋতুরও (লেখকের স্ত্রী) তাই ছিলো। ঈশ্বরপ্রদত্ত গলা, কখনও গলা সাধতে দেখিনি। অনুষ্ঠান থাকলে আগে একটু স্বর লিপিতে চোখ বুলাতো। ব্যাস, ওই।
বাংলানিউজ: প্রিয় অভিনেতা বা অভিনেত্রী?
বুদ্ধদেব গুহ: রেখা খুব প্রিয়। আর বাংলায় অপর্ণা সেন। আর নায়কদের মধ্যে উত্তম কুমার। আমির খানকে খুব ভালো লাগে। কদিন আগে ওর একটা আবৃত্তি শুনলাম রবি ঠাকুরের; অসাধারণ! খুব প্রতিভাবান ছেলে। আর ওই অমিতাভ বচ্চনকে আমার ভালো লাগে না!
বাংলানিউজ: বাংলানিউজের পক্ষ থেকে আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।
বুদ্ধদেব গুহ: বাংলানিউজকেও আমার শুভেচ্ছা
বাংলাদেশ সময়: ১৬০০ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১৩, ২০১৭
এসএনএস