কবি কামাল চৌধুরী এমনটাই লিখেছেন কবি ফরিদ কবিরকে নিয়ে। আর এই আলোড়ন তোলা কবির ৬০তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে শনিবার (২৬ জানুয়ারি) সন্ধ্যায় রাজধানীর শাহবাগের পাঠক সমাবেশকেন্দ্রে অনুষ্ঠিত হলো ‘কাঠগড়ায় কবি ফরিদ কবির’ শীর্ষক আড্ডা।
কবি ফরিদ কবিরের বড় পরিচয় তিনি কবি। তাই কবিতা লেখার সেই সূত্র ধরে পরিচয় কবিতার স্বপ্নরমণীদের সাথে। নাম আছে সাংবাদিকতাতেও। আর কবিতা লেখার মতো ভালোবাসেন গানও। সবকিছুর ঊর্ধ্বে আছে একটা নিজস্ব জীবন। আড্ডায় কবির জীবনের এসব নানান অধ্যায় উঠে আসে কবি এবং তাঁর স্বজনদের কাছ থেকে। নির্দিষ্ট পরিসীমার একেকজন মহারথী নিজেদের আপন ভঙ্গিমার সঞ্চালনে তুলে ধরেন সেসব দিক। কবিকে কাঠগড়ায় দাঁড় করান বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম’র সম্পাদক কবি জুয়েল মাজহার, সাংবাদিক জ ই মামুন ও অভিনেত্রী মেহের আফরোজ শাওনসহ বিশিষ্টজনেরা।
পাঠক সমাবেশকেন্দ্রে সন্ধ্যাবাতি জ্বলতেই গান ভালোবাসা ‘গানের বন্ধু’ দলের পরিবেশনার মধ্য দিয়ে শুরু হয় আয়োজন। শুধু গিটারের সঙ্গ আর খোলা কণ্ঠে ‘আবার এলো যে সন্ধ্যা’ গানটি এ সময় মন জয় করে সবার। ততক্ষণে হাজির হয়ে গেছে কবির অন্যান্য বন্ধু আর স্বজনেরাও।
অসংখ্য বইয়ের গল্প আর শব্দ পেছনে নিয়ে প্রথমেই কবির সঙ্গে মঞ্চে আসেন অভিনেত্রী ও গায়িকা মেহের আফরোজ শাওন। তিনি এ সময় সঞ্চালনা করেন ‘ফরিদ কবিরের নারী’ শীর্ষক পর্ব। সে পর্বে সঞ্চালকের কাছ থেকে প্রথম যে প্রশ্ন আসে, সেটিকে কবির বন্ধুরা বেশ স্বাগতই জানান সানন্দচিত্তে। ‘কবি তার স্ত্রীকে কত সুন্দর উপমাতেই না ডাকতে পারেন, কিন্তু তিনি ‘রুমমেট’ ডাকেন কেন?’
কবি বেশ হাসেন! উৎসুক হন একটু দূরে বসে থাকা কবিপত্নী ঝর্ণা ইয়াসমীনও। কবি ঠোঁটের কোণে হাসি এনে ছোট্ট করে উত্তর দেন— সকলের সঙ্গে এক করবো না, একটু ভিন্ন রাখবো বলে!
শুধু নাম-ডাকের ক্ষেত্রেও নয়, কবি একটু আলাদা হতে চান অন্য কবিদের থেকেও। তাইতো নিজের স্ত্রীকে নিয়ে লিখেন না একটিও কবিতা, অভিযোগ স্বয়ং তার স্ত্রীর। তাই প্রশ্ন ওঠে, এতো কবিতা কার জন্যে তবে?
কবি বলেন, নারীদের জন্যে। তারা কবিতার মতো সুন্দর বলে কবিতা বেশি ভালোবাসে। আর পুরুষদের জন্য আমার গল্প!
আড্ডা চলতে থাকে। তার মাঝেই আয়োজনে আগত সাহিত্যনুরাগীদের মধ্যে কবিকে প্রশ্নের জন্য দেওয়া হয় পোস্টকার্ড। তাতে প্রশ্ন আসে কবির কাছে। আসে কবিপত্নীর প্রশ্নও! পাঠ করেন শাওন— ‘তোমার মধ্যে কি কোনো পরি বাস করে?’ কবি হাসেন, সাথে অন্য সকলেও। তারপর খুনসুটিতে উত্তর দেন কবি— পরি তো থাকেই। নইলে কি আর কবিতা হয়! কোনো পরির নাক সুন্দর, কোনোটার গাল সুন্দর, কোনোটার চুল তো কোনোটার চোখ। আর এসব নিয়েই তো কবিতা!
মঞ্চে আসেন প্রখ্যাত সাংবাদিক জ ই মামুন। ‘ফরিদ কবিরের সাংবাদিক জীবন’ সেশনটি হবে তার সঞ্চালনায়। ঠাট্টা করে বলেন, শাওন কে ধন্যবাদ আমাকে সঞ্চালনা করতে দেওয়ার জন্য। ইদানীং তো কেউই তার নিজের জায়গা ছাড়তে চায় না!
‘প্রায় প্রত্যেক সাংবাদিকই একটু না একটু কবিতা লিখে থাকেন, আবার কবিরা সাংবাদিকতা করেন; এক কথায় প্রশ্ন করলে কবিরা সাংবাদিক কেন?’ প্রশ্ন করেন সঞ্চালক।
কবি উত্তর দেন, কবিরা লিখতে পছন্দ করেন। তারা এমন একটি কাজ চান যেখানে স্বাধীনতা থাকে। তাই কবিরা সাংবাদিকতা করেন।
প্রশ্ন আসে—আপনি কবি থেকে কেন সাংবাদিক হলেন?
কবি উত্তর দেন, আমি চেয়েছিলাম সাংবাদিকতায় থাকতে, কিন্তু সাংবাদিকতা আমাকে থাকতে দেয়নি। তাই কবি হয়ে গেছি!
প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব কবি, অনেকে আছেন যারা দৈনন্দিন ব্যস্ততা, নানান মিটিং আর কাজের মধ্যে থেকেও কবিতা লিখে চলেছেন। এমন কর্পোরেট সময়ে কবিদের নিয়ে কী বলার আছে? জানতে চান জ ই মামুন।
প্রকৃতি ও প্রেমের কবির উত্তর আসে, ‘কর্পোরেট এ ক্ষেত্রে অনেক বড় একটা বাধা হয়ে দাঁড়ায়। কবি তাঁর কবিতা নিয়ে যেখানে পৌঁছাতে পারতো, সেটা সে আর পারে না। সেভাবে কবি মনের মতো করে নিজের কবিতা লেখার ভুবনটা পায় না। ’
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কবিতার ছড়াছড়ি নিয়ে কথা উঠলে ফরিদ কবির বলেন, এটার ভবিষ্যৎ আছে। আগে চিঠি লিখে যেমন আরেকটা চিঠি লিখতে হতো, উত্তর কবে পাবো তা জানার জন্য; এখন সেই আবেগের সময়টা কমে গেছে। মুহূর্তেই আধুনিক চিঠির উত্তর চলে আসে। বলা যায়, চিঠি নয়—আবেগটা দ্রুত হয়ে গেছে।
কথা শেষ হতেই গানের বন্ধুরা হাজির হন ‘আহা আজি এ বসন্তে’ গান নিয়ে। তারপর আয়োজনে ‘ফরিদ কবিরের কবিজীবন’ নিয়ে মঞ্চে আসেন বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম’র সম্পাদক ও কবি জুয়েল মাজহার। শুরুতেই তিনি শোনান কবির কবিত্বের কথা।
তিনি বলেন, কবির প্রথম কাব্য ‘হৃৎপিণ্ডে রক্তপাত’ ও ২য় কাব্য ‘ওড়ে ঘুম ওড়ে গাঙচিল’ এর মধ্যে পার্থক্য অনেক। কবিতায় এ সময় কবি তাঁর পটপরিবর্তন এনেছেন। অন্তত আশির দশকে হাততালির আশা, উচ্চকণ্ঠ বা স্লোগানের কবিতা থেকে বের হয়ে যেসব কবি মানুষের ভেতরের কথা, অন্তর্জগতের কথা বলার চ্যালেঞ্জ নিয়েছিলেন, কবি ফরিদ কবির তাঁদের অন্যতম। ছন্দের ওপর আগ্রহী এ কবি বিচিত্র ছন্দে পরিশীলন, দ্যোতনা এবং ব্যঞ্জনা সৃষ্টিতে বেশ পারঙ্গম।
কবিবন্ধু ঠাট্টা করে বলেন- এই কবি বামপন্থি নন, বলা যায় বামাপন্থি। তাঁর কবিতায় নারীদের সরব উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়। ’
মঞ্চে আসেন কবি ব্রাত্য রাইসু। এগিয়ে চলে আড্ডা, আসরের মধ্যমণি পাঠ করেন কবিতা— ‘বৃষ্টিকেও আমার মানুষ বলেই মনে হচ্ছে, সে যখন ঝরে/ মনে হয়, মাটি নয়, ভিজে যাচ্ছি আমিই, তোমার ফোঁটায়, স্পর্শে...’
রাইসু প্রশ্ন করেন, আপনার কবিতা বোঝা যায়, এতে বেশ হিসাব আর পরিকল্পনা থাকে। এটা কিভাবে আয়ত্ত করলেন? ফরিদ কবির বলেন, কবিতার দু’টি ধারা আছে। একটি হলো পাঠককে বুঝিয়ে দেওয়া আর আরেকটি হলো কী বোঝাতে চাইছেন তা নির্দিষ্ট না করে পাঠককে নিজেকেই বুঝে নিতে দেওয়া। এই বিষয়টিই সব। রবীন্দ্রনাথ বা জীবনানন্দের মতো নয়, একটু ভিন্ন ধারার, একটু মুঠোয় আবদ্ধ করে রাখার।
কবিকে নিয়ে স্মৃতিচারণ করে মজার গল্প শোনান সাহিত্যিক মঈনুল আহসান সাবের। কবিকে নিয়ে প্রদর্শিত হয় ‘কবি ফরিদ, এক কবির গল্প’ শীর্ষক প্রামাণ্যচিত্র। এতে দেখা যায় আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন চিত্রশিল্পী মনিরুল ইসলাম কবির পোর্ট্রেট আঁকেন। এছাড়া শুভাকাঙ্ক্ষীদের নানান কথাও উঠে আসে ওই প্রামাণ্যচিত্রে।
কবি শিমুল সালাহউদ্দিনের তত্ত্বাবধান ও স্নিগ্ধ বাউলের সঞ্চালনায় কবি ফরিদ কবিরের জন্মদিনের আড্ডায় আরও উপস্থিত ছিলেন ডা. এ কে আজাদ খান, নাইমুল ইসলাম খান, খালেদ মহিউদ্দিন, আহমেদ মুস্তফা কামাল, সাখাওয়াত টিপু, আশরাফ জাহান, নাসরীন জাহান, আব্দুর রব, তানিম কবির, হিজল জোবায়ের, তুষার দাস, কুমার চক্রবর্তী, সুজিত মোস্তফা, নজরুল কবির, মাজহারুল ইসলামসহ কবি-সাহিত্যিক-শিল্পীরা। তারা সবাই কবির জন্মদিনের কেক কেটে সমাপনী টানেন সান্ধ্য আড্ডার। প্রকাশ করা হয় জন্মবর্ষ উদযাপন স্মারক ‘গণিত বড়ই রহস্যময়’।
বাংলাদেশ সময়: ০০০১ ঘণ্টা, জানুয়ারি ২৬, ২০১৯
এইচএমএস/এমজেএফ