মানুষ যেখানে বাদামের খোসার ভেতর থাকা দানার মতো, একই ছাদের নিচে থেকেও আলাদা। এই নিঃসঙ্গতার বোধই মূর্ত হয়েছে তরুণ কবি হিমু মোহাম্মদের প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘অনামিকা আততায়ী হও’ এর প্রায় প্রতিটি কবিতায়-
‘আমাদের যৌথ কোন গান নেই।
নাগরিক মানুষ তাঁর কাছে নিঃসঙ্গ কবুতরের মতো, যে ঘুরে ঘুরে ক্লান্ত হয় আর বিচ্ছেদী গায়, সাঁতার কাটে নিজস্ব সমুদ্রে। অথচ, সে মানুষও একদিন মিশেছিলো জনস্রোতে-
‘জনস্রোতে ভালোবেসে মিছিলে গিয়েছি একদিন। এখন জন ও স্রোত দুটোই অসহ্য মনে হয়। ঘুমাবো এমন নেই নিস্তরঙ্গ বিন্দুসম স্থান। ’ (২৮)
প্রত্যেকে পৃথক বটে, তাই বলে একেবারে বিচ্ছিন্ন নয় নাগরিক মানুষ। কারণ নিজস্ব জীবন নৌকা নিয়ে প্রত্যেককে ভিড় করতে হচ্ছে অভিন্ন বন্দরে-
‘দৃশ্য শেষে পড়ে থাকা ঢেউ তীরে এসে বলে চল যাই। ফিরতে হবে সংসারের জোয়ালের টানে। ভেসে যাবো সে উপায় নাই। ’ (২০)
একক অথচ বিচ্ছিন্ন নয়- এমন পরিস্থিতি সংকটাপন্ন করে তুলে মানুষকে। দ্বিধার ঘোরে কাটে সময়, রপ্ত করে ঘুমের অভিনয়। কবির কাছে মানুষ হয়ে যায় কল্পিত সেই মাছ যে ভুল স্রোতে আটকা পড়ে কখনও নিজেকে নিজেই গিলে খাচ্ছে, কখনও আবার উগরে দিচ্ছে।
২.
কাব্যগ্রন্থের বেশীরভাগ কবিতায় ‘অনামিকা’কে ঘিরে বিকাশ হয়েছে কবির রোমান্টিক চেতনার। এই অনমিকা কি প্রেয়সী নাকি অন্যকিছু তা নিয়ে বিভ্রান্ত হওয়ার মতো যথার্থ কারণ কবিতায় রয়েছে। তবুও মোটা দাগে অনামিকাকে কবির মানস প্রিয়া বলে ধরে নেয়া যায়। যার ওপর পরম নির্ভর তিনি-
‘অনামিকা, আমাকে খুন করে যাও দীর্ঘ চুম্বনে। মুছে দিও না দাগ- দায়মুক্তির অধ্যাদেশ রেখে যাবো সংবিধানে। মানুষ জানুক তোমার ওষ্ঠ ছুঁয়ে পেয়েছি নির্বাণ। ’(৩৩)
এই নির্ভরতা এতোটাই যে পুরো কাব্যে কবি ‘প্যাসিভ’। কবি ২৭ নম্বর কবিতায়ও অনামিকাকে আততায়ী হয়ে বিস্তর অপেক্ষা ফুরানোর আহ্বান করেছেন। অথচ, নিজেই দীর্ঘ চুম্বনে খুন করতে পারতেন অনামিকাকে।
‘খুন করো, ভালোবাসো, মেঘ হয়ে ভাসো,’ অনামিকার উদ্দেশ্যে এ রূপ নির্দেশনা বারবার আসলেও কেবল একটি কবিতায় কবিকে ‘অ্যাক্টিভ’র ভূমিকায় দেখা যায়। যেখানে তিনি বলেন- ‘এ সমস্ত শীতল শরীরে একদিন এঁকে দেবো উষ্ণ চুম্বন। ’ (৪৬)
কাব্যগ্রন্থে অবাক করে তরুণ কবির মৃত্যু চেতনা। অনামিকাকে ভেতরে না মরে আমৃত্যু বেঁচে থাকা আর আয়নায় সাজার যতোই উৎসাহ দিক তিনি জানেন মৃত্যুই সত্য। হৃদয়ের ব্যথার ভার বইতে না পারলেও মৃত্যু অপেক্ষাকৃত নির্ভার। তবে, মৃত্যুও অনেক প্রশ্ন জাগিয়ে যায় মনে-
‘মরে গেলে কিছুটা দৈর্ঘ্য বাড়ে লোকে। কিছু আলাপের পর যাই হোক বলে যতি টেনে দেয় মানুষ… মরে গেলে আমার দৈর্ঘ্য বাড়বে। একটা কবরের মাপে বড় হতে হতে আমি এই কথা ভাবি। ’ (৯৭)
৩.
‘অনামিকা আততায়ী হও’ কাব্যগ্রন্থের কবিতাগুলোর কোনো নাম নেই। কেবল ধারাক্রমে বর্ণনা করা। ১০৫টি কবিতার সবগুলোই আকারে ছোট। গ্রন্থের পাতায় দেখে কবিতা কিনা সংশয়ও হতে পারে। সবগুলোই গদ্যের ঢংয়ে লেখা।
তবে শব্দ আর বাক্যে অলংকারের কমতি নেই। দক্ষতার সাথে উপমা, লুপ্তোপমা আর অনুপ্রাস সৃষ্টি করে গেছেন। তবে সবচেয়ে কৃতিত্ব দেয়া যায় চিত্রকল্প তৈরিতে-
‘কোন বৃষ্টির দুপুরে আমি মরতে চাই না। ক্লান্ত গোরখোদকের মুখ ভেসে উঠে চোখে। গহীন কবর সেঁচে চলেছে সে…। ’ (১৯)
হিমু’র ভাষা অতি সরল। জটিল ও যৌগিক বাক্য একেবারেই কম। কিছু কিছু জায়গায় ভৌত বিজ্ঞান ও জীববিজ্ঞানের পরিভাষা ব্যবহার হয়েছে। তবে ভাষা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সহজবোধ্য-
‘সুঁই সুতা হাতে কখনো কখনো মা শিল্পী হয়ে উঠেন। ইদানীং আমার দিকে তাঁর চোখ। আমার মা জানে না-হৃদয় রিপু করা চলে না। ’ (৮১)
পুরো কাব্যের মধ্যে একটি কবিতা চট্টগ্রামের ভাষায় লেখা। পাঠকদের কবিতাটি নিশ্চিতভাবে বাড়তি আনন্দ দেবে।
নন্দিতা প্রকাশন থেকে বের হয়েছে কাব্যগ্রন্থটি। প্রচ্ছদ করেছেন রাজীব দত্ত। মূল্য ১৬০ টাকা।
বাংলাদেশ সময়: ২১৫৩ ঘণ্টা, মার্চ ২০, ২০১৯
এমএ/