শামসুল আরেফীন নব্বই দশকের প্রারম্ভে ছড়া ও কবিতা দিয়ে লেখালেখি শুরু করলেও এই দশকের মাঝামাঝি লোকগবেষণায় সম্পৃক্ত হন। তিনি সর্বপ্রথম আস্কর আলী পণ্ডিতের রচনা সংগ্রহে মনোনিবেশ করেন।
শামসুল আরেফীন পণ্ডিতের গানের সংস্পর্শে আসেন চন্দনাইশের গাছবাড়িয়া নিত্যানন্দ গৌরচন্দ্র বহুমুখি উচ্চ বিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালে। ১৯৯৫ সালের দিকে তিনি এই গান সংগ্রহ করার প্রয়োজনীয়তা অনুধাবন করেন।
চন্দনাইশের পার্শ্ববর্তী উপজেলা পটিয়া। আরেফীনের বাড়ি থেকে পণ্ডিতের নিবাসস্থল পটিয়ার শোভনদণ্ডি গ্রামের ব্যবধান ৫-৬ কিলোমিটার। আরেফীন বারবার ছুটে যান পণ্ডিতের বাড়িতে। তখন পণ্ডিতের নাতি ইছমাঈল ও ইসহাক জীবিত। কিন্তু তখন তারা কোন সহযোগিতা না করায় আরেফীন হতাশ হয়ে পড়েন।
অল্পকাল পরে আরেফীন সাহিত্যিক আহমদ ছফার একটি চিঠি পাঠ করেন, যেখানে চিঠির প্রাপকের উদ্দেশ্যে লেখা ছিল: আমি তোমাকে শোভনদণ্ডি গ্রামের আসকর আলী পণ্ডিতের গানগুলোর প্রতি একটু যত্নবান হওয়ার অনুরোধ করবো। ...আসকর আলী কতো বড়ো গীতিকার, মূল্যায়নের কোনো প্রয়াসই গ্রহণ করা হয়নি। আসকর আলীর সুরের এক বিশেষ মাদকতা এবং দাহিকা শক্তি আছে। এই জিনিস বাংলা গানের এক বিশেষ সম্পদ হিসেবে বিবেচিত হওয়ার যোগ্য। আমি তো তাকে সিলেটের হাসন রাজার মতো বড়ো একজন ভাবুক এবং গীতিকার মনে করি।
ছফার এই বক্তব্য পড়ে আরেফীন পণ্ডিতের বাড়ির পরিবর্তে চন্দনাইশ ও পটিয়ায় তার ভক্তদের সঙ্গে যোগাযোগ শুরু করেন। এবার তিনি সফল হলেন। পূর্ব চন্দনাইশের সিরাজুল ইসলাম খুইল্যা মিয়া থেকে পণ্ডিতের পঞ্চসতী প্যারজান, চন্দনাইশের হাজিপাড়ার ছফুরা খাতুন (স্বামী কাঞ্চন মিয়া) থেকে জ্ঞান চৌতিসা, পটিয়ার শোভনদণ্ডির মল্লপাড়ার মোহাম্মদ হোসেন থেকে বর্গসাস্ত্র বা মাত্রি-ভাষা, গীত বারমাস (গীত বারমাস ২য় ভাগ), নন্দবেহার: প্রথম ভাগ, চন্দনাইশের সাতবাড়িয়ার হাফেজ নগর দরবার শরীফের শহিদুল আনোয়ার থেকে হাফেজ বাহাদুর (গীত, বারমাস ও কবিতা: প্রথম ভাগ) প্রভৃতি গ্রন্থ উদ্ধার করতে সক্ষম হন। আরেফীনের পরিবারে রক্ষিত ছিল পণ্ডিতের গ্রন্থ নন্দবিলাস। এসব গ্রন্থের মধ্যে পঞ্চসতী প্যারজান ও জ্ঞান চৌতিসা হলো পুঁথি বা প্রণয়কাব্য, অন্যগুলো সঙ্গীতগ্রন্থ।
জ্ঞান চৌতিসার অর্থ হলো জ্ঞানের স্তোত্র, জ্ঞান বিচারের পদ বা পয়ার, জ্ঞানের শ্লোক ইত্যাদি। এই পুঁথিতে প্রণয়কাহিনীর আশ্রয়ে মরমি বা আধ্যাত্মিক দর্শনের চর্চা করা হয়েছে। পঞ্চসতী প্যারজান নামটি শুনলে ধারণা জন্মে, পাঁচজন সতী এবং প্যারজান নাম্নী কোন এক নারীকে বুঝানো হয়েছে। কিন্তু এ ধারণা সঠিক নয়। পঞ্চসতী প্যারজান পুঁথিতে প্যারজানকেই পঞ্চসতী সাব্যস্ত করা হয়েছে। পুঁথিটি স্রেফ প্রণয়ভিত্তিক কাব্য। তা পাঠে প্রধানত, কাহিনী পাঠের সাধারণ স্বাদটুকুই পাওয়া যায়। এছাড়া পাওয়া যায় একটি গুরুত্বপূর্ণ জিনিসও। শাস্ত্রীয় কিছু বিষয়-আশয় বা রীতিনীতির উপস্থিতি। এতে প্রমাণিত হয়, পুঁথিটি প্রণয়ভিত্তিক কাব্য হলেও, সমাজ-বাস্তবতার সামান্য ছোঁয়াও তাতে বিদ্যমান।
আরেফীন পণ্ডিতের এসব রচনা নিয়ে চট্টগ্রামের বলাকা থেকে তিনটি গ্রন্থ প্রকাশ করেছেন: আস্কর আলী পণ্ডিত: একটি বিলুপ্ত অধ্যায়, আস্কর আলী পণ্ডিতের দুর্লভ পুঁথি জ্ঞান চৌতিসা ও পঞ্চসতী প্যারজান ও আস্কর আলী পণ্ডিত: ৮৬ বছর পর।
আস্কর আলী পণ্ডিত: একটি বিলুপ্ত অধ্যায় ও আস্কর আলী পণ্ডিত: ৮৬ বছর পর গ্রন্থদ্বয়ে পণ্ডিতের তিনশতাধিক গান-কবিতাসহ গবেষণাধর্মী আলোচনা স্থান পেয়েছে।
তিনি পটিয়ার শোভনদণ্ডির মল্লপাড়ার মোহাম্মদ হোসেন থেকে লোককবি মনিন্দ্র দাস (১৯০০-২০০০), মকবুল আহমদ পণ্ডিত ও ক্ষেমেশ চন্দ্র রক্ষিতের (১৮৪৭-১৯২২), পটিয়ার খরনা ফকিরপাড়ার হামিদ বখসু থেকে লোককবি সেকান্দর গাইনের (১৮৬০-১৯৪২), চন্দনাইশের মুরাদাবাদের নুরুচ্ছাফা, আবুল বশর ও পটিয়ার খরনার লালারখিলের ফজল ফকির থেকে লোককবি খায়েরজ্জমা পণ্ডিতের (১৮৭৬-১৯৫১), চন্দনাইশের বৈলতলির রুহুল আমিন থেকে লোককবি মোয়াজ্জমের (ঊনিশ শতকে জন্ম ও মৃত্যু), চন্দনাইশের উত্তর গাছবাড়িয়া বদুরপাড়ার আবুল কাসেম থেকে লোককবি মুন্সী আমিন শরীফ (১৮৯৮-১৯৬৬), আবুল খায়ের নক্সবন্দি (১৯০৮-১৯৭৩) ও আতর আলীর, চন্দনাইশের পশ্চিম এলাহাবাদের ছুফিয়া দরবার শরীফের শাহজাদা রেজাউল করিম থেকে লোককবি সাইদ মিয়া (১৮৮৯-১৯৬৬), আতিকউল্লা শাহ্ (১২৯০-১৩৫৫) ও আবদুল আজিজ পণ্ডিতের (১৮৯৭-১৯৯৫), চন্দনাইশের হারলা নিবাসী মাস্টার নুরুল আলম ও প্রাগুক্ত রেজাউল করিম থেকে লোককবি শাহ্ আবদুল জলিল সিকদারের (১৮৫৭-১৯৩৪), চন্দনাইশের দক্ষিণ গাছবাড়িয়া গ্রামের অছিয়র রহমান থেকে লোককবি মোরশেদ চাঁদ দরবেশ, আবদুল্লাহ বাঞ্জরামপুরী ও করিম শাহ, নোয়াখালীর হাতিয়া দ্বীপের চরকৈলাস গ্রামের বাসিন্দা নাজিম উদ্দিন থেকে লোককবি আব্দুর রশিদের (১৮৯৯-২০০১/২০০২, চন্দনাইশের শাহীন নুপুরের মাধ্যমে লোককবি আবদুল লতিফ শাহ্-র অনেক দুষ্প্রাপ্য রচনা উদ্ধার করতে সক্ষম হন।
শামসুল আরেফীন এসব লোককবি ছাড়াও আরও অনেক লোককবিসহ মোট শতাধিক লোককবির বিলুপ্ত রচনা আবিষ্কার করেন। এসব লোককবির অধিকাংশদের রচনা ও তাদের সম্পর্কে আলোচনা নিয়ে তিনি চট্টগ্রামের বলাকা থেকে প্রকাশ করেছেন- বাঙলাদেশের লোককবি ও লোকসাহিত্য-১ম খণ্ড, বাঙলাদেশের লোককবি ও লোকসাহিত্য-২য়-৪র্থ খণ্ড, বাংলাদেশের বিস্মৃতপ্রায় লোকসঙ্গীত-১ম খণ্ড প্রভৃতি। লোককবি মনিন্দ্র দাসকে নিয়ে তিনি বলাকা থেকে প্রকাশ করেছেন কবিয়াল মনিন্দ্র দাস ও তাঁর দুষ্প্রাপ্য রচনা।
শামসুল আরেফীন আঠারো শতকের কবি আলী রজা ওরফে কানু ফকিরের (১৭৫৯-১৮৩৭) দুই শতাধিক গান এবং সৃষ্টিপত্তন নামে একটি পুঁথিও উদ্ধার করেন। চট্টগ্রামের আনোয়ারা থানার ওসখাইন গ্রামে জন্মগ্রহণকারী আলী রজা আঠারো শতকের শক্তিমান কবি। তিনি জীবদ্দশায় অনেক পুঁথি রচনা করেন। তার জ্ঞানসাগর-সহ এ পর্যন্ত ৩০টি গ্রন্থের নাম পাওয়া গেছে।
শামসুল আরেফীন আলী রজার অধিকাংশ বংশধরের কাছ থেকে তার রচনা উদ্ধারে কোন সহযোগিতা না পেলেও কোন কোন বংশধর ও আবুল বশর নামে আলী রজার একজন ভক্তের সহযোগিতায় প্রাগুক্ত রচনা অর্থাৎ দুই শতাধিক গান এবং সৃষ্টিপত্তন পুঁথি উদ্ধার করতে সক্ষম হয়েছেন। আবুল বশর চন্দনাইশের কাঞ্চননগর নগরপাড়া নিবাসী ছিলেন। শামসুল আরেফীন আলী রজা সম্পর্কে আলোচনা ও তার কিছু গান নিয়ে বলাকা থেকে প্রকাশ করেছেন আঠারো শতকের কবি আলী রজা ওরফে কানুফকির গ্রন্থটি।
আরেফীন লোককবি আবদুল গফুর হালীকে নিয়েও আলোচনা করেন, যা পরবর্তীতে বাংলাদেশের লোককবি ও লোকসাহিত্য-২য়-৪র্থ খণ্ড গ্রন্থে অন্তর্ভুক্ত হয়।
পুরস্কার: শামসুল আরেফীন লোকগবেষণার স্বীকৃতি স্বরূপ লাভ করেছেন আস্কর আলী পণ্ডিত পদক-২০১১, শুভেচ্ছা স্মারক : দরিয়ানগর কবিতামেলা-২০১২, চট্টগ্রাম নবকুঁড়ি পদক-২০১৫, আহমদ ছফা সম্মাননা-২০১৫ এবং আলী রজা সাহিত্য সম্মাননা-২০১৯।
লেখক : বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কারপ্রাপ্ত।
বাংলাদেশ সময়: ১৬৩০ ঘণ্টা, মে ২০, ২০১৯
এসি/টিসি