ঢাকা, মঙ্গলবার, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ২৪ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

শিল্প-সাহিত্য

কুমিল্লা: নজরুলের প্রেম-বিদ্রোহ-সৃষ্টির আলয়

ইমতিয়াজ আহমেদ জিতু, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২০৩৬ ঘণ্টা, মে ২৫, ২০১৯
কুমিল্লা: নজরুলের প্রেম-বিদ্রোহ-সৃষ্টির আলয়

কুমিল্লা: বাংলা সাহিত্যাকাশে ধূমকেতুর মতো আবির্ভূত হয়েছিলেন কাজী নজরুল ইসলাম। রবীন্দ্র-উত্তর বাংলা সাহিত্যে আধুনিকতার পথিকৃৎ মনে করা হয় তাকেই। কবিতা, গান ও উপন্যাসে লেখনীর মাধ্যমে তিনি সাম্প্রদায়িকতা, সামন্তবাদ, সাম্রাজ্যবাদ ও উপনিবেশবাদের বিরুদ্ধে ছিলেন সোচ্চার। সাহিত্য ও সংগীত এবং ব্রিটিশবিরোধী সংগ্রামের ‘ধূমকেতু’ নজরুলের বহু কীর্তির সাক্ষী উপমহাদেশের প্রাচীনতম নগর কুমিল্লা। বিশেষ করে কবির প্রেম, বিয়ে ও বিচ্ছেদসহ ব্যক্তিজীবনের দীর্ঘ দিনলিপির স্মৃতি জড়িয়ে রয়েছে কুমিল্লা ঘিরে। তাইতো যুগস্রষ্টা কবি নজরুলের সঙ্গে কুমিল্লার মাটি ও জনপদের বন্ধন চিরস্থায়ী। এখানকার মানুষও কবির স্মৃতিকে সযত্নে লালন করছেন পরম ভালবাসায়। 

কুমিল্লায় নজরুলের আগমন
বিদ্রোহের চেতনায় শাণিত অগ্নিপুরুষ নজরুল প্রথম বিশ্বযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন। তখন কুমিল্লার বাসিন্দা ক্যাপ্টেন আলী আকবর খাঁর সঙ্গে তার পরিচয় হয় এবং হৃদ্যতা গড়ে ওঠে।

পরে আলী আকবরের আমন্ত্রণে তার সঙ্গে ১৯২১ সালের ৩ এপ্রিল নজরুল কলকাতা থেকে চট্টগ্রাম মেইলে করে কুমিল্লায় আসেন। সে রাতে নজরুল ওঠেন কুমিল্লা শহরের কান্দিরপাড়ে তার সহপাঠী বন্ধু বীরেন্দ্র কুমার সেনের বাড়িতে। বীরেন্দ্রের মা বিজয়া সুন্দরীদেবীকে মা বলে সম্বোধন করতেন নজরুল। তখনই কুমিল্লার সঙ্গে সূচিত হয় নজরুলের এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়ের। সেবারসহ মোট পাঁচবার কুমিল্লায় এসেছিলেন নজরুল।

দৌলতপুরে নজরুল মঞ্চপ্রেমে নজরুল
নজরুলের প্রেমিক মনের প্রস্ফুটন ঘটে এই কুমিল্লায় এসে। কুমিল্লার নারীর মমত্ববোধ ও ভালবাসায় সিক্ত হয়েছিলেন তিনি। নজরুলের দাম্পত্য জীবনের বন্ধনও ঘটেছিল কুমিল্লাতে। এখানে দুই মহীয়সী নারীর পাণি গ্রহণের মাধ্যমে তার ঘটেছিল চিরায়ত নারীর সংযোগ।

৬ এপ্রিল নজরুলকে নিয়ে আলী আকবর খাঁ মুরাদনগরের বাঙ্গরা ইউনিয়নের দৌলতপুরে নিজ বাড়িতে যান। সেখানে আলী আকবরের ভাগনি সৈয়দা হকের সঙ্গে (কবি নাম দিয়েছিলেন নার্গিস আশার খানম) তার পরিচয় এবং প্রেম হয়। আলী আকবরের আয়োজনে ১৮ জুন দু’জনের বিয়ে সম্পন্ন হয়।
বাসর রাতে কবি নার্গিসকে একটি কবিতা উপহার দেন। তিনি লিখেছিলেন-
                              ‘ব্যর্থ মোদের গৌধূলী-লগন এই সেই জনমে নহে,
                                বাসর শয়নে হারায়ে তোমায় পেয়েছি চির বিরহের।
                                 কত সে লোকের কত নদী
                                 পারায়ে চলেছি মোর নিরবধি।
                                মোদের মাঝারে শত জনমে শত সে জলধি বহে,
                               বারে-বারে ডুবি, বারে-বারে উঠি জন্ম মৃত্যু দহে। ”

কিন্তু বিয়ের রাতেই বাসর ঘর থেকে নজরুল বের হয়ে যান নার্গিসকে একা ফেলে। তুমুল বৃষ্টি উপেক্ষা করে ১১ মাইল পথ পায়ে হেঁটে মুরাদনগরের দৌলতপুর ছেড়ে কুমিল্লা শহরের কান্দিরপাড়ে বন্ধু বীরেন্দ্রর বাড়িতে। এরপর তিনি কখনো দৌলতপুরে ফিরে যাননি।  

কান্দিরপাড় এসে নজরুল তার মামা শ্বশুর আলী আকবর খাঁকে লেখা চিঠিতে বাবা শ্বশুর সম্বোধন করে লেখেন, ‘...আপনজনের কাছ থেকে পাওয়া অপ্রত্যাশিত এতহীন ঘৃণা অবহেলা আমার বুক ভেঙ্গে দিয়েছে। ’ নজরুলের অতি সংবেদনশীল মনের পরিচয় চিঠিতে পাওয়া গেলেও কেন তার মন ভেঙে যায় এটি উল্লেখ করা হয়নি পত্রের কোথাও।

তবে দৌলতপুর ত্যাগ করার সময় নজরুল লিখে গেছেন- ‘আমি চিরতরে দূরে চলে যাবো তবু আমারে দেবো না ভুলিতে’।

বিচ্ছেদ হলেও নজরুল ভোলেননি নার্গিসকে
প্রথম প্রেম প্রতিনিয়ত নজরুলের হৃদয়ে দোলা দিয়েছে। তার প্রমাণ বহন করে, দীর্ঘ ১৬ বছর পর ১৯৩৭ সালের ১ ফেব্রুয়ারি নজরুলের লেখা দীর্ঘ চিঠিতে। তার
প্রিয়তমা সাবেক স্ত্রী নার্গিস আশার খানমকে নজরুল চিঠিটিতে লিখেছিলেন -
‘আমার অন্তর্যামী জানেন, তোমার জন্য আমার হৃদয়ে কি গভীর ক্ষত, কি অসীম
বেদনা! কিন্তু সে বেদনার আগুনে আমিই পুড়েছি-তা দিয়ে তোমায় কোনদিন দগ্ধ
করতে চাইনি। তুমি এই আগুনের পরশমানিক না দিলে আমি ‘অগ্নিবীণা’ বাজাতে
পারতাম না- আমি ‘ধুমকেতু’র বিস্ময় নিয়ে উদিত হতে পারতাম না। ’

কান্দিরপাড়ের রমণী প্রমীলার সঙ্গে প্রেম ও বিয়ে
নার্গিসের সঙ্গে বিচ্ছেদের বিরহ কাটিয়ে নজরুল প্রেমে মজেন কান্দিরপাড়ের মেয়ে অর্থাৎ বীরেন্দ্রের জেঠাতো বোন আশালতা সেনগুপ্তা প্রমীলার। ১৯২৪ সালের ২৫ এপ্রিল প্রমীলার সঙ্গে বিয়ে হয় তার। যদিও মাতৃসম বিরজাসুন্দরী দেবী পর্যন্ত অখুশী হন। তবে প্রমীলাকে নিয়েই কেটেছিল নজরুলের দাম্পত্য জীবন।

রানি দিঘির পাড়ে নজরুল স্মৃতিফলককুমিল্লায় নজরুলের সাহিত্য ও সংগীত চর্চা
নজরুলের সাহিত্য বিস্ফোরণে কুমিল্লা মাটি ও মানুষের অনুপ্রেরণা অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছে। নজরুলের কুমিল্লায় আগমনই তার সাহিত্যচর্চা বিকাশের পথ অনেকটা উন্মুক্ত করে দেয়। নজরুল দৌলতপুরে ৭৩ দিন অবস্থানকালে লিখেছেন
১৬০টি গান ও ১২০টি কবিতা। এগুলো নজরুলকে প্রেমিক কবি হিসেবে পাঠক
দরবারে সুপরিচিত করেছে।

ব্রিটিশবিরোধী সংগ্রামে নজরুল
নজরুল ১৯২২ সালের ২২ সেপ্টেম্বর চতুর্থ দফায় কুমিল্লায় এসেছিলেন আত্মগোপনের জন্য। ধূমকেতু পত্রিকায় ‘আনন্দময়ীর আগমনে’ শীর্ষক একটি কবিতা প্রকাশের কারণে ব্রিটিশ সরকার তার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করলে এখানে চলে আসেন কবি। তবে ২০ নভেম্বর শহরের ঝাউতলা রাস্তা থেকে কবিকে গ্রেফতার করা হয়।  

ব্রিটিশ যুবরাজের আগমনের প্রতিবাদে নিজের বিখ্যাত কোরাস গান ‘জাগরণী’ কুমিল্লা শহরের পথে পথে ঘুরে ঘুরে গেয়েছিলেন নজরুল। গলায় হারমোনিয়াম বেঁধে তিনি উচ্চারণ করেছিলেন-
ভিক্ষা দাও,ভিক্ষা দাও! ফিরে চাও ওগো পুরবাসী,
সন্তান তারে উপবাসী, দাও মানবতা ভিক্ষা দাও!

প্রেম-বিয়ে-বিরহ, সাহিত্য-সংগীত এবং সংগ্রামের স্বর্ণযুগটি কুমিল্লায় পার করেছেন নজরুল। কুমিল্লার প্রাকৃতিক পরিবেশ ও মানুষের ভালোবাসায় নজরুল জীবনে পেয়েছেন পরিপূর্ণতা। আজো কুমিল্লার মাটি সযতনে আঁকড়ে রেখেছে তার অসংখ্য স্মৃতি।

নজরুল কুমিল্লায় থাকাকালে শহরের ঐতিহ্যবাহী ভিক্টোরিয়া কলেজ সংলগ্ন রানির দিঘির পশ্চিমপাড়ে কৃষ্ণ চূড়া গাছের নিচে বসে প্রতিদিন কলেজ পড়ুয়া তরুণদের নিয়ে কবিতা-গানের আসর জমাতেন, আড্ডা দিতেন। বর্তমানে স্থানটিতে একটি স্মৃতিফলক রয়েছে। নগরের ধর্ম সাগরের পশ্চিমপাড়ে বসেও নজরুল গান ও  কবিতা লিখতেন। তাই এই দিঘির উত্তর পাড়ে রানিরকুঠি সংলগ্ন স্থানে রয়েছে নজরুল স্মৃতি কেন্দ্র। এখানে রয়েছে ক্লাসরুম, সেমিনার হল, নজরুল আর্কাইভ, গেস্ট রুম ও পাঠাগারও।  

শহরের প্রাণকেন্দ্র কান্দিরপাড় থেকে ধর্মপুর অ্যাপ্রোচ রেলস্টেশন সড়কটির নামকরণ করা হয়েছে নজরুলের নামে ‘নজরুল অ্যাভিনিউ’। প্রমীলাদের বাড়ির পাশেই ছিলো বিশিষ্ট কংগ্রেস নেতা বসন্ত কুমার মজুমদারের বাড়ি। কবির সঙ্গে পরিচয় হয় বাগিচাগাঁওয়ের বিপ্লবী অতীন রায়ের। এ সড়ক সংলগ্ন বসন্ত স্মৃতি পাঠাগারে কবি আড্ডা দিতেন, কবিতা লিখতেন, এখানেও রয়েছে নজরুল ফলক। শহরের মহেশাঙ্গনও নজরুল স্মৃতিবিজড়িত।

তবে শহরের নানুয়ার দিঘীরপাড়ের সুলতান মাহমুদ মজুমদারের বাড়ি, নবাববাড়ি, কান্দিরপাড়ের নজরুলের ম্মৃতিচিহ্ন ফলকগুলোও অযত্নে,অবহেলায় নিশ্চিহ্ন হওয়ার পথে। রাজগঞ্জ বাজারে যেখানে নজরুল ব্রিটিশবিরোধী মিছিলে অংশ নিয়েছিলেন, সেখানকার স্মৃতিবিজড়িত ফলকটি এখন আর নেই। সাবেক স্ত্রী নার্গিসের বাড়ি দৌলতপুরে রয়েছে কবির চারটি স্মৃতিফলক।

বাংলাদেশ সময়: ১৬০৯ ঘণ্টা, মে ২৫, ২০১৯
এইচএ/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।