শুক্রবার (২৬ জুলাই) বিকেলে রাজধানীর বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের বিশেষ মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত এ আয়োজনে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বিশিষ্ট কথাসাহিত্যিক ও দৈনিক কালের কণ্ঠ পত্রিকার সম্পাদক ইমদাদুল হক মিলন। বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন ‘দ্যা ওয়ান লাইট ফাউন্ডেশনে’র সভাপতি ড. আব্দুল কাদের।
সম্মাননায় ভূষিত অন্য লেখকরা হলেন ‘বাছাই কবিতা’ গ্রন্থের জন্য কবি ওবায়েদ আকাশ, ‘অখণ্ড বাংলার দ্বিতীয় দশকের কবিতা’ (সম্পাদিত) গ্রন্থের জন্য কবি অরবিন্দ চক্রবর্তী, ‘সুবাসিত শব্দের ঘুমঘোর’ কাব্যের জন্য মাহফুজ আল হোসেন, ‘ডোম’ কাব্যের জন্য গিরীশ গৈরিক, ‘উল্টোজলে কাটছি সাঁতার’ কাব্যের জন্য কুশল ভৌমিক, ‘ক্রোমাটিক’ কাব্যের জন্য নূর কাদের, প্যালিনড্রোম কবিতার গ্রন্থ ‘কথা থাক’ এর জন্য ফরিদ উদ্দিন, ‘ইরেজারে আঁকা ব্ল্যাক মিউজিক’ কাব্যের জন্য মীর রবি, অনুবাদ কবিতাগ্রন্থ ‘ধ্রুপদী উর্দু কবিতার জন্য জাভেদ হুসেন, ‘উনিশ মে’ উপন্যাসের জন্য সাইফুল ইসলাম, ‘জলঘুঙুর’ উপন্যাসের জন্য ম্যারিনা নাসরীন, ‘অমৃত অর্জন’ উপন্যাসের জন্য সোনালী ইসলাম, ‘বালক ও বুলেট’ উপন্যাসের জন্য আলী প্রয়াস, ‘করতালির দায়’ উপন্যাসের জন্য অমল রজক, ‘বাবার কেবলই রাত হয়ে যায়’ উপন্যাসের জন্য সাজ্জাদ খান, ‘আমাকে ধরিয়ে দিন’ উপন্যাসের জন্য কায়সুল মোমেন কাকন, ‘অতীত একটা ভীনদেশ’ গল্পগ্রন্থের জন্য মোজাফফর হোসেন, ‘কাহারো জীবনে নাহি সুখ’ অণুগল্পগ্রন্থের জন্য মাসুম মাহমুদ, ‘মাড়ভাতের গল্প’ গ্রন্থের জন্য মাহফুজ রিপন, ‘আইসিইউ বেড নম্বর নাইন’ গল্পগ্রন্থের জন্য মোক্তার হোসেন, ‘এলিয়েনের সঙ্গে আড্ডা’ গল্পগ্রন্থের জন্য রনি রেজা, আবৃত্তি কর্মশালা বিষয়ক সহায়ক গ্রন্থ ‘কাব্যকল্প’ এর জন্য আহমেদ শিপলু, শিক্ষা বিষয়ক বই ‘বিদেশে উচ্চশিক্ষা ও ভিসা তথ্য’ এর জন্য হাবিব তারেক এবং চিকিৎসা বিষয়ক গ্রন্থ ‘সুস্থতায় ব্যায়াম’ এর জন্য উম্মে শায়লা রুমকী।
প্রকাশনীর পক্ষ থেকে সম্মাননাপ্রাপ্ত সব লেখকের হাতে সম্মাননা স্মারক এবং বই তুলে দেন প্রধান অতিথি, বিশেষ অতিথি ও সভাপতি। অনুষ্ঠানের শুরুতেই স্বাগত বক্তব্য দেন বেহুলাবাংলা প্রকাশনীর প্রকাশক চন্দন চৌধুরী।
স্বাগত বক্তব্যে তিনি বলেন, আমরা চার বছরে চার শতাধিক বই প্রকাশ করেছি। সেই চার শতাধিক বইয়ের মধ্য থেকেই বাছাই করা হয়েছে এই ২৫টি বেস্ট সেলার বই। আমরা বিভিন্ন সময়ে দেখেছি যে লাইব্রেরিতে এখন বই বিক্রি কমে গেছে। কিন্তু বইমেলাতে যেহেতু সবার অংশগ্রহণ থাকে, তাই বইমেলা কেন্দ্র ধরে এ মেলায় বইগুলো কেমন বিক্রি হয়েছে, কোন বইগুলোকে পাঠক বেশি প্রাধান্য দিয়েছে, সেসব দিক মাথায় রেখেই নির্বাচন করা হয়েছে এ বইগুলো।
স্বাগত বক্তব্যের পর দর্শক হৃদয়ে দোলা দিয়ে যায় মিষ্টি কিছু কবিতা। এসময় নির্মলেন্দু গুণের ‘ক্ষেতমজুর’ কবিতাটি পাঠ করেন কবি কুশল ভৌমিক। স্বরচিত কবিতা পাঠ করেন কবি মাহফুজ আল হোসেন, মাহফুজ রিপন এবং আহমেদ শিবলু। কবিতার আসর শেষ হতেই গুণী লেখকদের হাতে তুলে দেওয়া হয় সম্মাননা স্মারক এবং শোনা হয় তাদের অনুভূতি ও লেখালেখির গল্প।
সম্মাননা পাওয়ার পর অনুভূতি প্রকাশ এবং লেখালেখির গল্প বলতে এসে বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কমের সম্পাদক ও কবি জুয়েল মাজহার বলেন, আমি লিখতে খুব ভালো পারি না এই বিশ্বাস আমার প্রবল। কিন্তু কবিতা লেখাকে এক ধরনের পাগলামি বা রোগ যদি বলি, তবে বলতে হয় এই রোগ আমি বহন করছি প্রায় চার দশক। বিষ্ণু দে’র একটা কবিতা পড়েছিলাম, সেখানে একটা নিষেধাজ্ঞা ছিল, তিনি কবিতা লিখতে না করেছেন তরুণদের। আমি কৈশরে নিরুদ্দেশ যাত্রা করেছিলাম এবং এই সময় আমার জীবনের একটা দীর্ঘ সময় পার হয়েছে পাহাড়ে ও স্টেশনে।
‘লজিং থেকেছি দীর্ঘকাল এবং ভবঘুরে হয়ে বিভিন্ন রকম পরিবেশে আমার জীবন কেটেছে। আমি এর মধ্য থেকেই কবিতাকে ভালোবেসেছিলাম কখন জানি না। তবে এখন মনে হচ্ছে কিছু প্রাপ্তি হয়তো যোগ হয়েছে আমার। এর পেছনে আমার বন্ধুদের অবদান আছে এবং আমার আগে মাইকেল মধুসূদন থেকে শুরু করে যারা লিখে গেছেন বিভিন্ন সময়ে বাংলা ভাষায়, যদিও আমার সে যোগ্যতা নেই, তবুও আমি এখন তাদের রিলে রেসের কাঠি বহন করছি। ’
তিনি বলেন, আমার ভ্রমণের তৃষ্ণা যেমন, তেমন ভাষার ভেতরও আমার ভ্রমণের তৃষ্ণা ছিল। সেজন্য বিশ্বের বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন ভাষার মধুরতা আমি চেখে দেখতে চেয়েছি নিজের ক্ষমতা অনুযায়ী। এজন্য কবিতা লেখার পাশাপাশি কিছু অনুবাদও করেছি। সেজন্য অল্পবিস্তর পড়াশোনাও করেছিলাম। এগুলোর সম্মিলিত ছাপ আমি আমার ভেতর লক্ষ্য করি। কবির কাজ হচ্ছে মৃত শব্দকেও জাগিয়ে তোলা। কবিতা ভাষার মধ্যে নতুন রক্ত সংবহন করে। ভাষা যখন মৃত হয়ে যায়, তখন কবিতাই সাহিত্যের একমাত্র ভাষা, যা ভাষাকে নতুন করে জীবনদান করে, জীয়নকাঠি ছোঁয়ায়।
বই ভালোবাসা মানুষগুলোর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে তিনি বলেন, আমি আসলে নিজের জন্য লিখি এবং একদমই অন্যের কথা ভেবে লিখি না। আমার নিজের ভেতরের যে প্রণোদনা, রক্তের স্পন্দন, হৃদয় স্পন্দন থেকে লিখি এবং সেটি কোনো কারণে হয়তো অন্যকে স্পর্শ করে। আমার জীবনে এটি অনেক বড় প্রাপ্তি। এভাবে আমার কবিতা যাদের স্পর্শ করেছে, এই ব্যস্ত সময়ে এখনো যারা বই পড়েন আমি তাদের কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি।
আয়োজনে অন্য লেখকরাও মঞ্চে এসে তাদের অনুভূতি ব্যক্ত করেন। কথা বলেন নিজেদের বই প্রসঙ্গে, লেখার গল্প নিয়ে। তারপর কথা বলেন অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি ইমদাদুল হক মিলন।
তিনি বলেন, লেখকদের যে কোনো কিছুতে অংশগ্রহণ করতে পারলে আমার ভালো লাগে। আজকের এই সন্ধ্যাটা আরও জনপ্রিয় কারণ এখানে ২৫ জন জনপ্রিয় বইয়ের লেখক রয়েছেন। সম্প্রতি এই প্রকাশনা মুক্তিযুদ্ধের উপর ৭১টি উপন্যাস প্রকাশ করেছে যা সত্যিই প্রশংসনীয়। আজ যারা সম্মাননা পেলেন, যাদের বইগুলো বেস্ট সেলার হয়েছে, অবশ্যই ভালো। কিন্তু এটা ভালো হয়েছে বলে ওরকম দ্বিতীয় বই আর লেখার প্রয়োজন নেই। এরপরের বইটি অন্যরকম করে লিখুন। রিপিটেশন যেন লেখায় না হয়। এটি আপনাদের অগ্রজ হিসেবে আপনাদের কাছে আমার অনুরোধ। আপনারা লেখাকে ভালোবাসুন, আপনার নিজের অজান্তেই একটি ভালো লেখা হয়ে যেতে পারে। কেননা ভালোবাসলে সব হয়।
এসময় তিনি বাংলা সাহিত্যের বিভিন্ন বই নিয়ে আলোচনা ও নিজের লেখা নিয়ে স্মৃতিচারণ করেন। একই সঙ্গে আমাদের প্রকাশনা যখন এক ধরনের হুমকির মুখে, তখন এই সাহস নিয়ে এগিয়ে যাওয়ার জন্য বেহুলাবাংলা প্রকাশককে ধন্যবাদ জানান।
বিশেষ অতিথির বক্তব্যে ড. আব্দুল কাদের বলেন, জীবনে সবচেয়ে বড় জিনিস হচ্ছে মূল্যায়ন করা। বই লেখার মাধ্যমে আজ যারা স্বীকৃতি পেলেন, তারা মূল্যায়িত। তাদের অভিনন্দন।
সবশেষে সভাপতির বক্তব্যে কবি আলমগীর রেজা চৌধুরী বলেন, যারা আজ সম্মাননা পেলেন, সাহিত্যে তাদের দায় বেড়ে গেলো। আপনারা শিল্পের স্বার্থে, কবিতার স্বার্থে, উপন্যাসের স্বার্থে এই দায় বহন করবেন বলেই আমরা আশা করি।
বাংলাদেশ সময়: ০০০১ ঘণ্টা, জুলাই ২৭, ২০১৯
এইচএমএস/এএ