ঢাকা, শুক্রবার, ৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২২ নভেম্বর ২০২৪, ২০ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

শিল্প-সাহিত্য

কথামালা আর সুর-ছন্দের শুভেন্দু মাইতিতে বিমোহিত রাজশাহী

শরীফ সুমন, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৪৫৩ ঘণ্টা, আগস্ট ১, ২০১৯
কথামালা আর সুর-ছন্দের শুভেন্দু মাইতিতে বিমোহিত রাজশাহী সঙ্গীতজ্ঞ শুভেন্দু মাইতি

রাজশাহী: শ্রাবণের দুপুর থেকে আকাশ রৌদ্রোজ্জল থাকলেও শেষ অবধি বৃষ্টি ঝরলো রাজশাহী শিল্পকলা একাডেমি মিলনায়তনে। সে বৃষ্টি সুর আর ছন্দের। আর সে বৃষ্টির মেঘ হলো শেকড়ে পা রেখে বাংলাকে সারা পৃথিবীতে মেলে ধরতে চাওয়া প্রখ্যাত সঙ্গীতজ্ঞ শুভেন্দু মাইতি।

বুধবার (৩১ জুলাই) সন্ধ্যায় ভরাট কণ্ঠের অনবদ্য কথামালা আর সুর দিয়ে সবাইকে বিমোহিত করলেন ওপার বাংলার বিখ্যাত লোকসঙ্গীত ও গণসঙ্গীতের এই শিল্পী। গুরু ভক্তি, প্রেম, বিদ্রোহ, বিরহ, রম্য আর প্রেরণার গান শুনিয়ে সবাইকে করলেন বশীভূত।

সন্ধ্যায় আয়োজন শুরু হওয়ার পর থেকেই মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে সবাই কেবল তার প্রবচন শুনেছে। এসময় ৭৫ বছর বয়সেও কথা ও সুর দিয়ে টগবগে তরুণের মত জীবন যুদ্ধ চালানো দৃঢ়তার গল্পই দর্শক-শ্রোতাদের শুনিয়ে গেছেন তিনি।

লোকগানের কাণ্ডারি শুভেন্দু মাইতিকে নিয়ে ‘গল্পে গানে শুভেন্দু মাইতির সঙ্গে বাংলা গানের পরম্পরা’ শীর্ষক অনুষ্ঠানের আয়োজন করে কৃষ্টি ফাউন্ডেশন। বিকেল থেকে রাজশাহী জেলা শিল্পকলা একাডেমিতে এ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। অনুষ্ঠানে দু’টি অধিবেশনের প্রথম অধিবেশন বিকেল ৪টা থেকে শুরু হয়ে চলে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত। এ সময় সঙ্গীতগুরু শুভেন্দু মাইতি সঙ্গীতপ্রেমীদের সঙ্গে সঙ্গীতের বিভিন্ন দিক ও কলা-কৌশল নিয়ে আলোচনা করেন।

দ্বিতীয় অধিবেশন সন্ধ্যা ৭টা থেকে শুরু হয়ে চলে রাত সাড়ে ৯টা পর্যন্ত। এ পর্বের শুরুতেই রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষক শহীদ মীর আব্দুল কাইয়ুমের সহধর্মিণী মাসতুরা খানম বরেণ্য এই সঙ্গীতগুরুকে উত্তরীয় পরিয়ে সম্মানিত করেন। এরপর শুভেন্দু মাইতির সাথে 'স্বপ্ন দেখার সাহস কর, স্বপ্ন ছাড়া মানুষ বাঁচে নাকি' গানটি সমবেতভাবে পরিবেশন করে দর্শকরাই বুঝিয়ে দেন সঙ্গীতের প্রতি তাদের অনুরাগ-ভালোবাসার কথা।

গান শেষে শুভেন্দু মাইতি বাংলা গানের বিশালতার দিকে ইঙ্গিত দিয়ে বলেন, ‘মাত্র কয়েক ঘণ্টার মধ্যে বাংলা গানের ইতিহাস তুলে ধরা সম্ভব নয়। ইতিহাস বলতে গেলে দু’তিনদিন লেগে যাবে। আমি চেষ্টা করবো বাংলা গানের ধারগুলোর সংযোগ ঘটাতে’। এই যোগকর্মের প্রথমেই তিনি কণ্ঠে আনেন ‘গুরু তোরে কি ধন দিলো চিনলি না মনা’ গানটি। এরপর কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতার কয়েকটি লাইন পাঠ করে বাংলা গানে কবিগুরুর অবদানকে স্মরণ করেন তিনি। গানগল্প ও আলোচনার মধ্য দিয়ে একে একে গেয়ে শোনান ‘রজনী এখনো বাকি, নাইবা ঘুমালে প্রিয়’, ‘ভয় কি মরণে’, ‘এ গিটার খোঁজ রাখে কয়জনা’র মতো হৃদয়ে শিহরণ জাগানিয়া গানগুলো।

শুভেন্দু মাইতি বলেন, ‘প্রেম বিষয়টি তুমি-আমি, এভাবে দু’টো মানুষের মধ্যে আবদ্ধ ছিল। ১৯৪০ সালের পর থেকে পুরো পৃথিবী জুড়ে ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে আন্দোলন জোরদার হয়। বাংলা আধুনিক গানেও এর প্রভাব পড়ে। তখন থেকে গানে শুধু প্রেমের সেতুবন্ধন নয়, বরং সুখ-দুঃখ, বঞ্চনা, আন্দোলন, বিদ্রোহ এসবেরও প্রতিফলন শুরু হয়’। মর্মবাণী শেষ করেই তিনি কণ্ঠে আনেন সত্য চৌধুরীর ‘পরাধীন দেশে প্রেম অভিশপ্ত, মুক্তির পথে কত বাধা, কত রক্ত’ গানটি!

এরপর আবারো সুরের মূর্ছনায় ডুবিয়ে লোকসঙ্গীতের এই গুরু একে একে গেয়ে শোনান ‘চিরদিন কারো কখনো যায় না সমান’, ‘পাপ পূণ্যের কথা আমি কারে বা শুধাই’, ‘খাঁচার ভিতর অচিনপাখি কেমনে আসে যায়’, ‘বকুল ফুল বকুল ফুল সোনা দিয়া হাত কেন বান্ধায়লি’র মত হৃদয় হরণ করা গানগুলো। এসময় শুভেন্দু মাইতি স্মৃতিচারণ করে ভাদু গানের সুর তোলেন ‘এখন হামার লাতি চার কেলাসে পড়ে’ গানে।

আয়োজনের এ পর্যায়ে মঞ্চে আসেন শুভেন্দুর মেয়ে তানিয়া মাইতি। তাকে পাশে নিয়ে শুভেন্দু মাইতি বলেন, ‘আমার ছেলে-মেয়ে গান শেখেনি। গান গাইলে আবার বাবার মতো ছন্নছাড়া হয়ে যাবে! তারা কে কোন ক্লাসে পড়ে সেটাও আমার মনে থাকে না’। তখন বাবার কথার মাঝে তানিয়া মাইতি বলেন, ‘আমি যখন ক্লাস সেভেনে পড়তাম, বাবাকে কেউ জিজ্ঞেস করলে বাবা বলতেন, ক্লাস ফাইভে পড়ে!’ বাবা-মেয়ের এমন খুনশুটিতেই আনন্দের দোলা উঠে দর্শক সারিতে থাকা সঙ্গীতপ্রেমীদের মধ্যে।

তানিয়া মাইতি বলেন, ‘আমি যে গানটি গাইবো- গানটি আমার দাদার (ভাই) লেখা। এই গানটি গেয়েই দাদা প্রথমবার বৌদিকে প্রেমের প্রস্তাব দিয়েছিলে। শেষ পর্যন্ত বিয়েতে পূর্ণতা পায়। তাই আমরা একে প্রপোজ সং বলে আখ্যা দিয়েছি। ' বলতে বলতে আলতো রাঙা হয় তার মুখ। সে মুখে গান আসে- ‘আমি চাই তোকে চাই, ভালোবাসি তাই’।

প্রপোজ সং শেষ হওয়ার পর মঞ্চে আসেন শুভেন্দু মাইতির স্ত্রী আবৃতি শিল্পী শিবানী মাইতি। একে একে তিনটি কবিতা কণ্ঠে আউড়ে বাহবা কুড়ান তিনি। আর সে বাহবার সাথে ভালোলাগা আর ভালোবাসার রেশ মিশিয়ে উপস্থিত দর্শকদের ধন্যবাদ দিয়ে অনুষ্ঠান শেষ করেন শুভেন্দু মাইতি।

কৃষ্টি ফাউন্ডেশনের এ আয়োজনে এসময় অন্যদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন কৃষ্টি ফাউন্ডেশনের সাধারণ সম্পাদক এনায়েত কবীর ও অনুষ্ঠানের প্রধান সমন্বয়ক সুপ্রভা জুই। অনুষ্ঠানটির মিডিয়া পার্টনার অনলাইন নিউজপোর্টাল বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম।

বাংলাদেশ সময়: ০০৫০ ঘণ্টা, আগস্ট ০১, ২০১৯
এসএস/এইচএমএস/জেডএস

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।