শনিবার (৭ সেপ্টেম্বর) বিকেল ৫টায় শাহবাগের কাঁটাবনে ‘কবিতা ক্যাফে’ রেস্তোরাঁয় অনুষ্ঠিত হয় এই আয়োজন। অনুষ্ঠানে লেখক মুম রহমানের সঞ্চালনায় আলোচনা করেন বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কমের সম্পাদক ও কবি জুয়েল মাজহার, কবি ফরিদ কবির, আয়শা ঝর্না, কবি ও সংবাদ কর্মী জাহানারা পারভীন, স্ট্যামফোর্ড ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশের ফিল্ম অ্যান্ড মিডিয়া বিভাগের শিক্ষক ও কবি সাকিরা পারভীন, কবি জুনান নাশিত এবং বিশিষ্ট সাংবাদিক ও কবি আফরোজা সোমা।
অনুষ্ঠানের শুরুতেই ‘ঐহিক বাংলাদেশ’র তিন বছর পূর্তি উপলক্ষে কেক কাটার মধ্য দিয়ে অনুষ্ঠানের শুভ সূচনা হয়। এরপর কবিতার শব্দের দীপ্ত উচ্চারণে সকলকে জানানো হয় শুভেচ্ছা। একে একে কবিতা পাঠ ও আলোচনায় মূখর হয় প্রাঙ্গণ।
প্রথমেই স্বরচিত কবিতা পাঠ করেন করেন আয়শা ঝর্ণা। এসময় তিনি আমেরিকান কবি ও লেখক সিলভিয়া প্লাথের বিভিন্ন লেখা এবং তার জীবনী তুলে ধরে বর্তমান সমাজে নারী লেখকদের অবস্থা নিয়ে আলোচনা করেন।
তিনি বলেন, শিল্প হতে হবে জেন্ডারের ঊর্ধ্বে থেকে। সেখানে কবি বা নারী কবি বলে আলাদাভাবে নারীকে পরিচয় দেওয়ার কিছু নেই। অনেক ছেলের তুলনায় এখন মেয়েরা অনেক ভালো লিখছেন। আমি একজন নারী এবং আমিতো অন্য সকলের মতো করেই লিখি। কিন্তু অন্যেরা যখন আমাকে সম্মোধন করে উনি একজন 'নারী লেখক' তখন আলাদা ভাবে ভাবতে হয়, আসলেই আমি একজন নারী, যেটা একটু অস্বস্তিকর ব্যাপার।
আয়েশা ঝর্ণার আলোচনার পর লিখিত প্রবন্ধ পাঠ করেন সাংবাদিক আফরোজা সোমা। তিনি বলেন, নারী কবি বা নারীদের মধ্যে ভালো লেখে আফরোজার সোমা। তার মানে কী, আমি কি ছেলেদের মধ্যে ভালো লিখিনা? আমি যখন এসএসসি-এইচএসসি বা ভার্সিটিতে ভালো রেজাল্ট করি, তখন তো বলা হয়নি নারীদের মধ্যে ভালো রেজাল্ট করেছি। নারীদের আলাদাভাবে বৈশিষ্ট্যকরণ হল কর্তৃত্ববাদী মানুষের প্রকাশ। সামগ্রিক অর্থে নারীরা এখনো নিষ্পেষিত। আমরা যদি পুরুষ কবিদের 'পুরুষ কবি' বলে আখ্যায়িত করি, তাহলে নিশ্চয় তারা সেটা সুন্দরভাবে নেবেন না।
এসময় তার লেখায় নারীদের ধর্মীয়, রাজনৈতিক, সমাজিক প্রেক্ষাপট ও অন্যান্য বিষয়গুলো উঠে আসে। তারপর কথা বলেন কবি ফরিদ কবির।
তিনি বলেন, শিক্ষা, অর্থনৈতিক, নৈতিক ক্ষেত্রে আমাদের চর্চা বাড়াতে হবে। আমাদের ঘর ও পরিবারের ভেতর থেকে নারীদের আলাদা এবং সমান মর্যাদার ব্যাপারটা নিশ্চিত করতে হবে। আমাদের সমাজটা পুরুষতান্ত্রিক। তাই অনেক ক্ষেত্রে নারীরা ক্ষমতার শীর্ষে থাকলেও তাদেরকে পুরুষের প্রতিবিম্ব হিসেবেই দেখা হয়।
আলোচনার এ পর্যায়ে মঞ্চে কবিতা পাঠ করেন কবি জুনান নাশিত, সাকিরা পারভিন ও জাহানারা পারভীন।
কবিতা পাঠের পর সাকিরা পারভীন বলেন, নারীদের সমান এ মর্যাদার জন্য আমাদের রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় পরিবর্তন আনা জরুরি। সেখানে এই সুপারিশমালা পৌঁছাতে হবে। সেই সঙ্গে পরিবর্তন আনতে হবে আমাদের মানসিকতার। আমরা পত্রিকার বিভিন্ন ঈদ বা পূজা সংখ্যায় দেখি পুরুষদের পঞ্চাশটি কবিতা ছাপা হয়। অথচ সেখানে নারীদের কবিতা থাকে মাত্র তিন থেকে চারটি। এই জায়গাটাতেও আমাদের সমান অধিকারের জন্য ভাবতে হবে।
এসময় তিনি নারীদের অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হওয়ার প্রতিও গুরুত্বারোপ করেন। তবে শুধু অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হলেই সমস্যার সমাধান হবে না বলে মন্তব্য করেন জাহানারা পারভীন।
তিনি বলেন, স্বাবলম্বী মেয়ে হলেই অনেক সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে এমনটা নয়। নারী হিসেবে এগুলো যেন তুচ্ছ। আমার দীর্ঘ কর্ম জীবনে আমি কখনো শুনিনি আমি একজন নারী রিপোর্টার বা নারী শিক্ষক। কিন্তু যখন লিখতে গেলাম তখন আমাকে শুনতে হয় আমি একজন নারী কবি।
জুনান নাশিত বলেন, একজন নারী হিসেবে আমাদের অতিরিক্ত কাজ করে বোঝাতে হয় যে আমরা কাজটার যোগ্য। অথচ একজন পুরুষের ক্ষেত্রে তা নয়। মেইনস্ট্রিম কখনোই একজন নারী লেখক কে লেখক হিসেবে যেন মেনে নিতে চায় না। এ বিষয়ে তাই আরও আলোচনার প্রয়োজন আছে। আর সে আলোচনা শুরু থেকেই মূল্যায়িত হতে হবে আমাদের প্রতিটি ঘর থেকে।
অনুষ্ঠানের এ পর্যায়ে কথা বলেন বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কমে'র সম্পাদক ও কবি জুয়েল মাজহার। এসময় তিনি কবি বা নারী কবি, লেখক বা নারী লেখক হিসেবে আলাদা আখ্যায়নকে পরিচয়ের খণ্ডন করা হিসেবে উল্লেখ করেন এবং নারীদের সৃজনশীলতা ক্ষেত্র-বিশেষে পুরুষের থেকেও বেশি বলে উল্লেখ করেন।
তিনি বলেন, কবি বা নারী কবি হিসেবে আখ্যায়িত করে পরিচয় খণ্ডিত করা পুরুষের পেশি-শক্তির প্রাবল্য, সৃজনশীলতা বা মেধার প্রাবল্য নয়। নারী যখন উচ্চ পর্যায়ে পৌঁছে যায়, তখন পুরুষতান্ত্রিক সমাজ তাকে নিজেদের প্রাবল্যে রাখার জন্য আলাদাভাবে আখ্যায়ন করেন। যার বড় উদাহরণ ফরাসি বিপ্লবের কালজয়ী নারী জোয়ান অব আর্ক। দীর্ঘ ১০০ বছর ইংরেজদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেও যখন ফরাসিরা স্বাধীনতা লাভ করতে পারেনি, তখন এই নারী তার নেতৃত্ব দিয়ে বিজয় ছিনিয়ে এনেছিলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তার মৃত্যু হয়েছে নির্মমভাবে আগুনে পুড়ে।
কবি জুয়েল মাজহার বলেন, নারীদের সৃজনশীলতা কোনো অংশেই পুরুষের থেকে কম নয়। আমরা যেসব পুরুষেরা লেখালেখি করি, তাদের সৃজনশীলতার শুরু হয় আমাদের মা, নানি বা দাদির ছড়া, ঘুম পাড়ানোর গান বা গল্প বলা দিয়ে। তাই নারীদের কাছে আমাদের প্রাপ্তি অনেক। কিন্তু এই পরিচয় খণ্ডিত করা সুস্থতার লক্ষণ নয়।
তিনি বলেন, মানবজাতির সবথেকে বড় রোগের নাম পুরুষতন্ত্র। আমরা নিজেরা যদি না বদলাই, তবে রাষ্ট্র-সমাজ-শিক্ষক কেউই বদলাবে না। তাই সবার আগে আমাদের সমান অধিকারের চর্চাটা করতে হবে আমাদের ঘর থেকে। নারীদের আলাদা মর্যাদা দিয়ে।
অনুষ্ঠানে আরও উপস্থিত ছিলেন কবি ও লেখক মেঘ অদিতি, সুমী সিকানদার, তুষার দাশ, আবদুর রাজ্জাক, হাসান রোবায়েত, ফারহানা রহমান, মণিকা চক্রবর্তী, নুরেন দুরদানী প্রমুখ।
বাংলাদেশ সময়: ০০৫৩ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ০৮, ২০১৯
এইচএমএস/এসআইএস