শনিবার (১৪ সেপ্টেম্বর) রাজধানীর বাংলামোটরে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের বাতিঘরে ‘বই প্রকাশের গল্প’ শীর্ষক আয়োজনে তিনি এ কথা বলেন।
এর আগেও সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ও বাংলা সাহিত্যের রাজধানী হিসেবে কথা বলেছিলেন।
আয়োজনে পাঠকদের সঙ্গে বিভিন্ন বিষয়ে কথা বলেন দুই বাংলার জনপ্রিয় ঔপন্যাসিক সমরেশ মজুমদার। এতে জায়গা পায় পাঠকের আগ্রহের নানান দিক।
সমরেশ মজুমদার বলেন, হুমায়ূন আহমেদ বাংলা সাহিত্যের রাজধানী কলকাতা থেকে ঢাকায় নিয়ে এসেছেন। বাংলা সাহিত্যের রাজা-রানি চলে এসেছে ঢাকায়। বাংলা সাহিত্যের রাজধানী আগে কলকাতা ছিল, এটা আমি তিরিশ বছর আগের কথা বলছি।
‘কিন্তু গত তিরিশ বছরে আমরা নতুন কোনো সুনীল, শীর্ষেন্দু, প্রফুল্ল রায়কে পাইনি। সেই আসা শুরু হয়েছে হুমায়ূন আহমেদের হাত ধরে। তিনি খুব বিনয়ের সঙ্গে জায়গাটি দখল করে নিলেন। ’
নতুন যারা লেখালেখির জগতে আসছেন, তাদের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, উপদেশ দিয়ে লেখক হওয়া যায় না। নিজের ভেতরের উপলব্ধিটাই একজন লেখককে সত্যিকারের লেখক করে তুলতে পারে।
সমরেশ মজুমদার বলেন, উপদেশ দিয়ে লেখক হওয়া যায় না। মাকে যেমন কেউ উপদেশ দিয়ে মা বানাতে পারে না, তাকে সন্তানের প্রতি ভেতর থেকে মমতা জাগাতে হয়, লেখালেখিও ঠিক তেমনি। নিজের উপলব্ধিটাকে সুন্দর করে মেলে ধরে পারলেই তা সুন্দর লেখায় পরিণত হয়।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার সময়ে নিজের লেখালেখি সম্পর্কে তিনি বলেন, বানিয়ে বানিয়ে লিখতে পারি না। কি লিখবো, ঠিক হবে কী না, তাই সময় লাগে। বাংলাদেশের স্বাধীনতার সময়টাকে নিয়ে লিখছি। এমন বড় একটা বিষয় নিয়ে যেনতেন তো আর লেখা যায় না। রসদ যোগাড় করেছি, লিখবো।
‘তবে ভয় হয়। লিখলে আবার কি না কি হয়। মিথ্যে বা বানিয়ে তো লিখতে পারি না। সত্যিটাই লিখতে হবে। হুমায়ূনকেও (হুমায়ূন আহমেদ) অনেকবার বলেছিলাম- এ বিষয়ে লিখতে। সেও সম্ভবত কি না কি হবে ভেবেই লেখেনি। তবে আমাকে মাঝরাতে ফোন করে বলতো, আপনি তো লিখতে পারেন। এখন ভাবি এই কাজটা আরো ২০ বছর আগে করা উচিৎ ছিল। তাহলে এতোদিনে হয়ে যেত। ’
‘এখন হাতে সময় কমে এসেছে। তবুও আশা রেখেছি। সৎ থাকতে হবে, যা সত্য তাই লিখতে হবে, বানিয়ে লিখলে হবে না,’ যোগ করেন তিনি।
বরেণ্য কথাসাহিত্যিক প্রয়াত হুমায়ূন আহমেদের স্মৃতিচারণ করে তিনি বলেন, হুমায়ূনের সঙ্গে রাত ৩টার সময়ও আমার কথা হতো। ও দেশ পত্রিকার পুজো সংখায় লেখার জন্য অনেক আগ্রহী হয়ে থাকতো।
‘বাংলাদেশে যখন তার একটি উপন্যাসের জন্য প্রকাশকেরা ১০ লাখ টাকা নিয়ে ঘুরতো, তখন হুমায়ূন দেশ পত্রিকায় লিখে পেত মাত্র ৮০ হাজার টাকা। আমি জিজ্ঞেস করলে বলতো- দাদা, এখানে বড় বড় লেখকেরা লিখে গেছে। আমি সেখানে লিখছি। এর থেকে বড় প্রাপ্তি আর কী হতে পারে! আর ৮০ হাজার টাকা অনেক টাকা!’
নিজের লেখা উপন্যাস ‘সাতকাহন’ নিয়ে তিনি বলেন, এই উপন্যাসে আমি অনেকটা বাঙালি মেয়েদের তুলে আনতে চেষ্টা করছি। তাদের দুঃখ, যন্ত্রণা, সংগ্রাম, প্রেম সমস্ত। তারা শতবাঁধা মুখ বুজে সহ্য করে। সেই জায়গাটা থেকেই বেরিয়ে আসার একটা প্রচেষ্টা সাতকাহন। আমি তা লিখলাম সত্য, তবে বাঙালি মেয়েরা আমার পাশে দাঁড়ালো না।
এসময় গল্পচ্ছলে নিজের লেখক হওয়ার গল্পও শোনান সমরেশ মজুমদার। বললেন, একবার একটা গল্প পত্রিকায় ছাপা হলে পত্রিকা অফিস থেকে আমাকে ১৫ টাকা দেওয়া হলো। আমারা বন্ধুরা মিলে সেই ১৫ টাকার চা খেলাম। এরপর বন্ধুরা আবার জাপটে ধরলো- গল্প লিখলে তো টাকা পাওয়া যায়! তখন আমাদের কিশোর কাল।
‘সেই চায়ের খরচের জন্য বন্ধুদের জোরাজুরিতে আরো একটা গল্প লিখলাম। সেটি থেকে পেলাম ২৫ টাকা। এভাবেই বন্ধুদের চায়ের বিল দেওয়ার ব্যবস্থা করতে করতে আমি যে কখন লেখক হয়ে গেলাম, তা আমি নিজেও জানি না। ’
লেখালেখিকে ‘যন্ত্রণা’ বলেও উল্লেখ করেন এই লেখক। তিনি বলেন, একবার রাস্তা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে একটা বই চোখে পড়লো। নাম ‘রাত তিনটেই তোমাতে আমাতে’। নিচে দেখি আবার আমার নাম লেখা! আমি তো অবাক। এই বই আমি কবে লিখলাম! পেছনে দেখি আমার ছবিও দেওয়া। অথচ বইটা কিনে হাতে নিয়ে দেখলাম তার একটা শব্দও আমার নয়।
পাইরেটেড বই বন্ধের অনুরোধ জানিয়ে সমরেশ মজুমদার বলেন, ওই যে বইটা, ওটা তো পাঠক পড়ে ভাববে আমারই লেখা। পাইরাইট যে হবে না তা নয়, তবে তাতে যেন মূল বইয়ের সঙ্গে পরিবর্তন না আসে, সেদিকটা দেখা উচিৎ।
বাংলাদেশের সিলেট অঞ্চলের চা চাষ এবং চা শ্রমিকদের নিয়েও লেখালেখির কাজ করেছেন বলে জানান বরেণ্য এই লেখক।
বিকেল থেকে সমরেশ মজুমদারের সঙ্গে বাতিঘরের এই আড্ডাজুড়ে ছিলো পাঠকের মুগ্ধতা। তারা নতুন করে চিনেছেন সমরেশ মজুমদারকে। ভালোবাসার এই স্মৃতি ধরে রাখতে অনেকেই আবার তার বইয়ের পাতায় আঁচড় কেটে নিয়েছেন লেখকের অমলিন অটোগ্রাফ।
অনুষ্ঠানে সমরেশ মজুমদারের লেখা নতুন বই ‘অপরিচিত জীবনযাপন’ এবং বাদল সৈয়দের লেখা ‘জন্ম জয়’ বই দুটোর মোড়ক উন্মোচন করা হয়। এর আগে অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য দেন বাতিঘরের কর্ণধার দীপঙ্কর দাশ।
বাংলাদেশ সময়: ২২৩১ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ১৪, ২০১৯
এইচএমএস/এমএ