ইদানিং বুকের ব্যথাটা বেশ বেড়েছে। শরীরে কোনো শক্তি পাই না।
দুই.
বিমান আসার সংকেত পাওয়ামাত্রই থানায় সাইরেন বেজে ওঠে। একেকটা বিমান উড়ে যায় আর চারদিকে আতঙ্কের বন্যা বয়ে যায়। এমন ভয়াবহ আওয়াজ করে একেকটা বিমান যায় যে, আমার কানে তালা লেগে যায়। বুক ধড়ফড় করতে করতে আমি অস্থির হয়ে তক্তপোষে গড়াগড়ি খাই। আম্মা হাতে পায়ে বুকে তেল মালিশ করে দিতে দিতে হাত ফুলিয়ে ফেলেন। মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলেন, একটু ঘুমা সোনা। একটু ঘুমানোর চেষ্টা কর। তখন হয়তো ক্লান্ত হয়ে আমার চোখটা একটু বুজে আসে। আর তখনই আবার একটা যুদ্ধবিমান উড়ে যায়। বুকের ভেতর এত কষ্ট নিয়ে মানুষ কী করে বেঁচে থাকে, জানি না। কিন্তু আমি বাঁচতে চাই। আমি আবার স্কুলে যেতে চাই। সরিষার ওপর, ধানের ওপর হাত বুলিয়ে হাঁটতে চাই। বন্ধুদের সঙ্গে ঘোরাঘুরি, ভৈরব নদীতে দল বেঁধে গোসল করতে চাই। আমি স্বাভাবিক সুস্থ জীবন চাই। যুদ্ধের আগে যেমন ছিলাম, তেমনি।
তিন.
আমার নাম বাবু। অবশ্য আমার আরেকটা আসল নাম আছে; হাবিব হোসেন। যুদ্ধের আগে আমি ক্লাস সিক্সে পড়তাম। এখন যুদ্ধ না থাকলে সেভেনে উঠতাম। জানি না, এ বীভৎস যুদ্ধ কখনও শেষ হবে কি-না। আমরা কখনও আর পড়ালেখা করার সুযোগ পাবো কি-না। আমরা আবার এই বাংকারের বন্দি জীবন বাদ দিয়ে আমাদের বাসায় গিয়ে থাকতে পারব কি-না। এদিকে, ডাক্তার বলেছেন, আমার না-কি জন্ম থেকেই হার্টে একটি ফুটো আছে। হার্টে কেন ফুটো থাকে কে জানে। যুদ্ধের আগে আব্বার বাগেরহাট থানায় পোস্টিং ছিল। ওখানে বাসার পাশেই ছিল বিশাল মাঠ। আগেই বলেছি, এখন আমরা আট ভাই। তবে আমাদের কিন্তু সবার বড় একটা বোন ছিল। নাম ছিল আয়েশা। সেই বোনটি মাত্র ১১ মাস বেঁচে ছিল। শুনেছি ওরও না-কি হার্টে ফুটো ছিল। এরপর হলো হাসান ভাই; আমাদের বড় ভাইজান। আমি দ্বিতীয়। এরপর আরও ছয়ভাই আছে আমাদের। ওদেরও কারও কারও হার্টে ফুটো আছে কি-না, অবশ্য এখনও জানা যায়নি। যুদ্ধের আগে আমরা বড় পাঁচভাই প্রতিদিন ফুটবল খেলতাম। আর ছোট তিনটা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখতো। প্রথম প্রথম কিছুক্ষণ খেললেই আমি হাঁপিয়ে যেতাম। তারপর শুরু হলো বুক ধড়ফড়ানি। এরপর মাঠে একদিন বেহুঁশ হয়ে গেলাম। আমাকে তাড়াতাড়ি ডাক্তারের কাছে নেওয়া হলো। অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে জানা গেলো, আয়েশা বুবুর মতো আমার বুকেও না-কি একটা ফুটো আছে। আমার ফুটবল খেলা বন্ধ হয়ে গেলো।
আমার ভাইয়েরা আমাকে খেলায় নেয় না। বন্ধুরাও নেয় না। শুয়ে-বসে দিন কাটতে লাগলো। একদিন চুপচাপ মাঠের এক কোনায় বসে খেলা দেখছি আর পাশে এসে বসলো বাঁধন ভাই। পরেরদিনও এলো। তবে খেলা শুরু হওয়ার আগে। খেলার মাঠের সবাইকে ডেকে তিনি নিয়ম করে দিলেন, খেলা শুরু হবে আমার কিকে। অর্থাৎ সবাই যে আমাকে খেলা থেকে একদম বাদ দিয়ে দিয়েছিল, সে নিয়ম আর চলবে না। আমি পুরো খেলা খেলবো না। কিন্তু খেলা শুরু হবে আমার কিক দিয়েই। খেলার মাঠে আবার আমার গুরুত্ব ফিরে এলো। আমি দেরি করে মাঠে গেলে সবাই অস্থির হয়ে যায়। আমি না গেলে ফার্স্ট কিক কে দেবে এসব নিয়ে গণ্ডগোল লেগে যায়। নিজের কাছে নিজের দাম বেড়ে যায়। মনমরা ভাবটা কেটে গিয়ে আবার সবকিছু ভালো লাগতে থাকে। আমরা সবাই বাঁধন ভাইয়ের ভক্ত হয়ে গেলাম। তবে আমার সঙ্গেই তার সবচেয়ে বেশি বন্ধুত্ব গড়ে উঠলো। আমার কাছে তিনি একজন আদর্শ মানুষ। আমার হিরো। বাঁধন ভাই ফকিরহাটেরই ছেলে। তবে ঢাকায় পড়ালেখা করেন। বয়স ১৮ বা ১৯ হবে। কী যে সুন্দর দেখতে বাঁধন ভাই! একেবারে যেন গ্রিক দেবতা। ধবধবে ফর্সা গায়ের রঙ। লম্বা একেবারে ছয় ফুট। বাবরি দেওয়া লম্বা কালো কোঁকড়ানো ঘন চুলগুলো সবসময় কাঁধের কাছে ঝুলে থাকে। উনি যখন আমাদের চারপাশে গোল করে বসিয়ে কাজী নজরুল ইসলামের, ‘চল চল চল। চল চল চল। ঊর্ধ্ব গগনে বাজে মাদল। নিম্নে উতলা ধরণী তল। অরুণ প্রাতের তরুণ দল। চলরে চলরে চল চল’ গেয়ে উঠতেন, আমরা সবাই মুগ্ধ নয়নে বাঁধন ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে থাকতাম। আর মাঝে মাঝে কী যে সুন্দর সুন্দর একেকটা কবিতা গমগমে গলায় আবৃত্তি করতেন, ভাবা যায় না।
চার.
যুদ্ধের আগে ক্লাস বন্ধ হলেই শুধু উনি বাড়িতে আসতেন। যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর বাড়িতে একেবারে ফিরে এলেন। শুনেছি, তার সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের খুব ভালো যোগাযোগ আছে। যুদ্ধ চলার সময়ে বাঁধন ভাইয়ের সঙ্গে আমার যোগাযোগ একদমই কমে গেলো। মাত্র এক বা দু’বারের জন্য তিনি শুধু আমাকে দেখতে এসেছিলেন। লুকিয়ে লুকিয়ে বাংকারে ঢুকেই তিনি আমাকে বুকের ভেতর জড়িয়ে ধরে বলতেন, দেখিস আমরা যুদ্ধে জিতবোই। তুই একদম চিন্তা করিস না। যুদ্ধ শেষ হলে তোকে ঢাকায় নিয়ে যাবো। অনেক বড় ডাক্তার দেখাবো। দেখিস তুই একেবারে ভালো হয়ে যাবি। আবার দৌঁড়াবি। আমার সঙ্গে ফুটবল খেলবি।
আমি বলতাম, তুমি আসো না কেন বাঁধন ভাই? তুমি কী মুক্তিযোদ্ধা হয়ে গেছ? আমাকে তোমাদের সঙ্গে নিবা? আমার তো কিছুই ভালো লাগে না। যুদ্ধ কী সত্যি শেষ হবে? বাঁধন ভাই বললেন, আমি যুদ্ধের কাজে ব্যস্ত আছি রে। তাই আসতে পারি না। আর তোদের বাসার দিকে তো রাজাকারদের নজর আছে। আসতে চাইলেও আসতে পারি না। তুই চিন্তা করিস না। যুদ্ধ শেষ হবেই। দেখিস আমরা স্বাধীন হবোই।
পাঁচ.
দিনদিন ফকিরহাটে রাজাকারদের ভয়াবহ প্রতাপ বাড়তে লাগলো। রজব আলী হয়েছেন রাজাকারদের কমান্ডার। যুদ্ধ শুরু হওয়ার পরপরই মুক্তিযোদ্ধারা একদিন রাতে থানায় আব্বার কাছে এসে মালখানা থেকে সব অস্ত্র নিয়ে গেলেন। সেই অস্ত্র দিয়ে তারা অ্যাম্বুস পেতে পাকবাহিনীর ওপর চোরাগোপ্তা হামলা করতে লাগলো। রজব আলী রাজাকার ধুরন্ধর লোক। তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে কী করে অস্ত্র পৌঁছালো, সে রহস্য উদ্ধার করে ফেললেন। হঠাৎ এক রাতে পাকসেনাদের সঙ্গে নিয়ে এসে আব্বাকে ধরে নিয়ে গেলেন। যশোর ক্যান্টনমেন্টের ফায়ারিং স্কোয়াডে আব্বাকে আরও অনেকের সঙ্গে চোখ বেঁধে গুলি করার জন্য দাঁড় করানো হলো। আব্বাকে ধরে নিয়ে যাওয়ার খবরটি দ্রুত ছড়িয়ে পড়লে আমার ছোট মামা, যিনি যশোর ক্যান্টনমেন্টের এক কর্নেলের মেয়েকে পড়াতেন, তিনি ছুটে গেলেন সেই কর্নেলের কাছে। অনেক অনুনয়-বিনয়ের পর আব্বাকে ফায়ারিং স্কোয়াডের গুলির মুখ থেকে সেই কর্নেল ফিরিয়ে আনলেন।
ছয়.
এরকম নানা ঘটনা-দুর্ঘটনার মধ্য দিয়ে সময় কাটতে লাগলো যুদ্ধের। এরইমধ্যে রাজাকার রজব আলীর অত্যাচার সব ধরনের সীমা-পরিসীমা অতিক্রম করেছে। সাঙ্গপাঙ্গ নিয়ে বদমাইশ রাজাকার প্রায় প্রতি রাতে থানায় এসে আব্বাকে হুমকি-ধামকি দিতে লাগলেন। আর মুক্তিযোদ্ধাদের খবর জানার জন্য চাপ দিতেন। বাধ্য হয়ে আব্বা থানায় ঢোকার একটি মাত্র রাস্তা রেখে চারদিকের মাটি কেটে খালের মতো করে দিলেন। যেন যেদিক দিয়ে ইচ্ছে থানায় ঢুকে পড়া না যায়। এতে রাজাকার রজব আলী আরও ক্ষেপে গিয়ে গ্রামের বাড়িতে বাড়িতে হানা দিয়ে মুক্তিযোদ্ধা সন্দেহ করে প্রতি রাতে লোকজন ধরে আনতে লাগলেন। এরপর খালের ওপরের পুলের সঙ্গে সারারাত হাত-পা-চোখ বেঁধে ফেলে রাখতে শুরু করলেন। আর ভোরবেলায় ফজরের নামাজ পড়ে এসেই একের পর এক মুক্তিযোদ্ধা ও তাদের সহকারীদের ধারালো দা দিয়ে জবাই করে খালে ভাসিয়ে দিতে লাগলেন। যেহেতু থানার পাশের খালের ওপরেই পুলটির অবস্থান, তাই আমরাও প্রায়ই ভোরে দাঁত মাজতে মাজতে পুলের কাছে হাঁটতে হাঁটতে চলে যাই। বেশ কয়েকদিন চোখের সামনেই দেখেছি, মুক্তিযোদ্ধাদের জবাই করে খালে ফেলে দিতে। আমি এসব দেখে চিল্লাচিল্লি করলে শয়তানটা আমাকে দা তুলে ভয় দেখাতেন। মানুষ জবাই করার আগে রজব আলী রাজাকার বলতেন, বাবারে, একটু চুপচাপ থাক। নড়াচড়া করিস না বাপ! নড়লে তুইও কষ্ট পাবি, আর আমাদেরও কাজটা করতে কষ্ট হবে। দুই-চার বার এসব ঘৃণ্য দৃশ্য দেখার পর আমি পুলের দিকে যাওয়াই বন্ধ করে দিলাম। কতদিন আর ভোরে উঠে খালের পাড়ে যাইনি মনে নেই। নভেম্বরের শুরুর দিকে, তখন গ্রামে আস্তে আস্তে বেশ শীত জাঁকিয়ে পড়ছে। এমনই এক রাতে আমার সারারাত ঘুম হলো না। যতসব ভূত-প্রেতের ভয়ঙ্কর ভয়ঙ্কর স্বপ্ন দেখে ছটফট করে কাটলো রাতটা। ভোরে আর থাকতে না পেরে হাঁটতে হাঁটতে পুলের পারে গেলাম। আমার পেছন পেছন ভাইজানও গেল। এমনিতেই আমি অত্যন্ত দুর্বলচিত্তের মানুষ। এর ওপর এমন একটি ভয়াবহ দৃশ্য এ জীবনে দেখতে হবে কখনও ভাবিনি। অন্ধকার ছেদ করে পূব আকাশে মাত্র ভোরের আলো ফুটে উঠছে। আবছা আলোয় দেখলাম হাত-পা বাঁধা অবস্থায় বাঁধন ভাইকে শোয়াচ্ছেন রজব আলী রাজাকার। আর পুলের রেলিংয়ের সঙ্গে দা-টা ধার দিচ্ছেন। এই দৃশ্য দেখেই আমি যা বোঝার বুঝে গেলাম। সঙ্গে সঙ্গে চিৎকার করে বাঁধন ভাই, বাঁধন ভাই বলতে বলতে কাঁদতে কাঁদতে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে লাগলাম।
বড় ভাইজান আমাকে জাপটে ধরলেন, যেন বাঁধন ভাইয়ের কাছে যেতে না পারি। এদিকে, রজব আলী রাজাকার দা উঁচিয়ে কয়েকবার আমাদের ভয় দেখিয়ে বাঁধন ভাইয়ের চুলের মুঠি ধরে গলায় দায়ের পোঁচ দিতেই আমার সারা শরীরে খিঁচুনি উঠে গেল। তারপর আর কিছু মনে নেই। পরে শুনেছি, আমি ফিট হয়ে পড়ে গিয়েছিলাম। আর তারপর থেকেই আমার সেই যে বুকের ব্যথাটা উঠল, সেটা সারতে সারতে যুদ্ধই শেষ হয়ে গেল।
সাত.
যুদ্ধের পর রজব আলী রাজাকার নিখোঁজ হয়ে গেলেন। দিনরাত গ্রামের মানুষ আর মুক্তিযোদ্ধারা এক হয়ে তাকে খুঁজতে লাগলো। শেষমেশ তাকে খানজাহান আলী দর্গার দিঘির পাড়ের জঙ্গল থেকে উদ্ধার করে গ্রামে নিয়ে আসা হলো। অনেক চিন্তাভাবনার পর সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো গ্রামের মানুষই তার বিচার করবে। থানার পাশেই স্কুল, তারপরেই বিশাল মাঠ। চারদিকে টিনের বেড়া দিয়ে মাঠের মাঝখানে মাটির গর্ত করে ওই রাজাকারকে পুঁতে ফেলা হলো। সারাদেহ মাটির নিচে, শুধু মাথাটা ওপর থেকে দেখা যায়। টিনের বেড়ার মাঠে ঢোকার পথে এক পয়সা দিয়ে টিকিট কাটার ব্যবস্থা করা হলো। শয়ে শয়ে মানুষ এক পয়সা দিয়ে টিকিট কেটে একটি ইটের টুকরো রজব আলী রাজাকারের মাথায় ছুড়ে মারতে লাগলো। কিন্তু আমি কিছুতেই এক পয়সা দিয়ে একটি ছোট ইটের টুকরো মারতে রাজি হলাম না। পরেরদিন সকালে আম্মার কাছ থেকে ১০ পয়সার একটি কয়েন নিয়ে গিয়ে আমি একটি পুরো ইট দুহাতে করে রজব আলীর মাথার কাছে এগিয়ে গেলাম। আগেরদিন সারাদিন ধরে ইট মারা হয়েছে। চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে কাত হয়ে থাকা রক্তাক্ত মাথা নিয়ে রাজাকার রজব আলী হয়তো বহু আগেই মারা গেছেন। কিন্তু আমার তো সেদিকে বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই। আমি ওর মাথার কাছে গিয়ে ইটটি দিয়ে ওর থেঁতলানো মাথাটাকে বাড়ি মারতে মারতে আরও থেঁতলে দিতে থাকলাম। মাথা ফেটে ঘিলু বের হয়ে ছিটকে ছিটকে আমার সার্টে, প্যান্টে, সারা শরীরে-হাতেমুখে মেখে যেতে লাগলো। কিন্তু আমি ততক্ষণে উন্মাদ হয়ে গেছি। শুধু মনে আছে চিৎকার করে করে কেঁদেছিলাম আর বলেছিলাম, তুই আমার বাঁধন ভাইকে জবাই করেছিস। তুই মর মর মর!
বাংলাদেশ সময়: ২০০৩ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ২৩, ২০১৯
টিএ