বাংলা বর্ষপঞ্জিকা মতে, বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৯১৩ সালে গীতাঞ্জলির জন্য সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পান। এর ছয়বছর পরে অর্থাৎ ১৯১৯ সালের ৫ নভেম্বর কবিগুরু সিলেট সফর করেছিলেন।
কবিগুরুর এই সিলেট সফরের পেছনে সিলেটের সাহিত্য ও সংস্কৃতিমনা মানুষের আগ্রহ ছিল প্রচুর। শতবর্ষ পরেও সেই আগ্রহে কমতি নেই বিন্দুমাত্রও। সিলেটে কবির আসার ক্ষণটি স্মরণীয়-বরণীয় করে রাখতে ‘শতবর্ষ স্মরণোৎসব’র ব্যাপক আয়োজন করা হয়েছে সিলেটজুড়ে।
সিলেট সফরকালে ৫ ও ৭ নভেম্বর বন্দরবাজারের ব্রাহ্মমন্দিরে গিয়েছিলেন রবি ঠাকুর। সিলেটের ব্রাহ্মসমাজের আয়োজনে ৫ নভেম্বর (মঙ্গলবার) স্মরণোৎসব থাকছে। শতবর্ষ আগে ভারতের শিলংও যান কবি। ওই সময় সিলেট সফরের আমন্ত্রণ জানিয়ে বারবার তারবার্তা পাঠালেও তিনি তাতে সাড়া দেননি।
এর কারণ হিসেবে তৎকালীন সময়ের দুর্গম যাতায়াত ব্যবস্থা ও অপ্রতুলতার কথা বলা হয়েছিল। তখন সিলেট আসামের অংশ। আরো বিপত্তি ছিলো সিলেট একটা সীমান্ত শহর। তেমন যাতায়াত ব্যবস্থাও ছিল না।
ভারতের মেঘালয় রাজ্য ও খাসিয়া জৈন্তা পাহাড়, দক্ষিণে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্য এবং পূর্বে আসামের করিমগঞ্জ ও কাছাড় জেলা। এখন যোগাযোগ থাকলেও তখন যাতায়াত ব্যবস্থা ছিল দুর্গম। শিলং থেকে সিলেট যাতায়াত চাট্টিখানি কথা ছিল না।
পরে কবিগুরু তার বার্তা সিলেট মহিলা সমিতি এবং আঞ্জুমানে ইসলামিয়া ও আরও কয়েকটি সংগঠন তারবার্তা পাঠিয়ে সিলেট অঞ্চলের জনমানুষের আকাঙ্ক্ষার বিষয়টি বিবেচনায় আনার বিনীত অনুরোধ জানান। অবশ্য শেষ পর্যন্ত তিনি সম্মতি দিলেন এবং ১৯১৯ সালের নভেম্বরে গৌহাটি ফিরে সেখান থেকে ট্রেনে লামডিং বদরপুর এবং করিমগঞ্জ হয়ে ৪ নভেম্বর রাতে কুলাউড়া জংশন পৌঁছান। কবিকে বরণ করে নিয়ে আসতে সিলেট থেকে একটি অগ্রবর্তী দল আসামের বদরপুর পর্যন্ত যায়।
সফরে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে ছিলেন কবির একমাত্র ছেলে রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও পুত্রবধূ প্রতিমা দেবী। কিন্তু রাতে ট্রেন না চলায় কুলাউড়ায় থেকে পরদিন ট্রেনে ছকাপন, বরমচাল, ভাটেরা ও ফেঞ্চুগঞ্জ হয়ে সিলেটে পৌঁছান।
সিলেট শহরে তাকে সংবর্ধনা দেওয়ার উদ্দেশ্যে গঠন করা হয়েছিল অভ্যর্থনা পরিষদ। সেই পরিষদের সভাপতি মনোনীত হয়েছিলেন শিক্ষাবিদ ও রাজনীতিক খান বাহাদুর আবদুল মজিদ। লোকে তাকে কাপ্তান মিয়া বলে ডাকতেন। পরবর্তীতে তিনি আসাম প্রাদেশিক পরিষদের শিক্ষামন্ত্রী হয়েছিলেন।
৫ নভেম্বর সফরসঙ্গীসহ কবিগুরু ট্রেনে সিলেট রেলস্টেশনে পৌঁছান। তাকে বর্ণাঢ্য সংবর্ধনা দিতে খান বাহাদুর সৈয়দ আবদুল মজিদ, রায়বাহাদুর সুখময় চৌধুরী, তৎকালীন ভাইসরয়ের কাউন্সিল অব স্টেটসের সদস্য মৌলভি আবদুল করিম ছাড়াও রায়বাহাদুর প্রমোদ চন্দ্র দত্ত ও সিলেট মহিলা সমাজের পক্ষে উপস্থিত ছিলেন নলিনী বালা চৌধুরী।
ওই সময় সিলেটের প্রখ্যাত পরিবারগুলোর ভেতরে মজুমদার বাড়ি, কাজী বাড়ি, দস্তিদার বাড়ি ছাড়াও এহিয়া পরিবারের সদস্যরা স্টেশনে উপস্থিত থেকে কবিকে বরণ করেছিলেন। রেলস্টেশনে উপস্থিত হয়েছিলেন বিভিন্ন স্কুল ও কলেজের ছাত্র-শিক্ষকেরাও।
তখন পর্যন্ত সুরমা নদীর ওপর কিন ব্রিজ হয়নি। একটি সুসজ্জিত বজরায় করে সফরসঙ্গীসহ কবিকে চাঁদনিঘাটে আনা হয়। ওই সময় চাঁদনিঘাটকেও সুসজ্জিত করা হয়েছিল। সেই চাঁদনীঘাটকে আবারো সুসজ্জিত করা হচ্ছে কবির আগমনের শতবর্ষে।
সিলেট সফরকালে মুরারিচাঁদ কলেজের বাংলা ও সংস্কৃতির অধ্যাপক নলিনী মোহন শাস্ত্রীর আমন্ত্রণে তার বাড়িতে পদচারণা ঘটে কবির। শহরের উপকণ্ঠে মাসিমপুর মণিপুরী পল্লিতে গিয়েছিলেন তিনি।
মণিপুরী সংস্কৃতি তাকে এতটাই প্রভাবিত করেছিল যে, তিনি পরবর্তীতে শান্তিনিকেতনে এর প্রতিফলন ঘটিয়েছিলেন পাঠ্যতালিকায় মণিপুরী নৃত্যের প্রবর্তন করে।
সিলেটের ঐতিহ্যবাহী বিদ্যাপীঠ মুরারিচাঁদ কলেজের ছাত্র-শিক্ষকদের উদ্যোগে আয়োজিত সংবর্ধনা সভায় যোগদান প্রাক্কালে কবিগুরুকে বহনকারী ঘোড়ার গাড়ির ঘোড়া দুটি ছাড়িয়ে দিয়ে তারা নিজেরাই গাড়িটিকে টেনে নিয়ে যান পুরো পথজুড়ে।
সুদীর্ঘ ৬৫ বছর আসামের একটি প্রদেশে পরিণত করে রাখায় সিলেট অঞ্চলের মানুষের চেতনায় যে প্রচণ্ড কষ্টের জন্ম হয়েছিল, কবিগুরু মনপ্রাণ দিয়ে তা অনুভব করেছিলেন। বিষয়টা আর সেই কারণেই সফরকালীন সময়ে তিনি লিখেছিলেন সুন্দরী শ্রীভূমি।
২০১৯ সালের ৫ নভেম্বর সিলেটে রবীন্দ্রনাথের আগমনের শতবর্ষ পূর্তি উপলক্ষে কবির লেখা সুন্দরী শ্রীভূমি কবিতার একটি মনোজ্ঞ ম্যুরাল উন্মোচন করা হবে।
মঙ্গলবার (০৫ নবেম্বর) বিকেল সাড়ে ৩টায় কবিগুরুর ম্যুরাল উন্মোচনের মাধ্যমে উৎসবের উদ্বোধন করবেন সিলেটে রবীন্দ্রনাথ: শতবর্ষ স্মরণোৎসব উদযাপন পর্ষদের আহ্বায়ক ও সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিত।
বিকেল ৪টায় শুরু হবে সিলেটের অর্ধসহস্রারাধিক শিল্পীর পরিবেশনায় নৃত্য, আবৃত্তি ও সঙ্গীতানুষ্ঠান। এছাড়া থাকবে একক পরিবেশনাও।
পরদিন ৬ নভেম্বর, বুধবার মাছিমপুর, এমসি কলেজ ও চৌহাট্টা সিংহবাড়িতে পৃথকভাবে অনুষ্ঠানমালার আয়োজন করা হয়েছে। সিংহবাড়িতে দিনব্যাপী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি থাকবেন পরিকল্পনামন্ত্রী এমএ মান্নান।
৭ ও ৮ নভেম্বর বিকেল ৪টা থেকে দু’দিন অনুষ্ঠান হবে সিলেট জেলা স্টেডিয়ামে। ৭ নভেম্বর অনুষ্ঠানে থাকবে হাসান আরিফ, রুপা চক্রবর্তী, ভারতের ড. পূবালী দেবনাথ, শুভপ্রসাদ নন্দী মজুমদার, জয়িতা চক্রবর্তী, সাহেব চট্টোপাধ্যায়সহ খ্যাতিমান শিল্পীদের আবৃত্তি ও গান পরিবেশনা।
৮ নভেম্বর অনুষ্ঠানে থাকবে বাংলাদেশের আসাদুজ্জামান নূর, রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা, লাইসা আহমেদ লিসা, ড. অনুপম কুমার পাল, ড. অসীম দত্ত এবং ভারতের মেধা বন্দ্যোপাধ্যায়, পদ্মশ্রী পূর্ণদাস বাউল ও অগ্নিভ বন্দ্যোপাধ্যায়সহ খ্যাতিমান শিল্পীর আবৃত্তি ও গান পরিবেশনা।
সমাপণী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি থাকবেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন। আর বিশেষ অতিথি হিসেবে পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান ও সংস্কৃতি বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী কে এম খালিদ উপস্থিত থাকবেন।
বাংলাদেশ সময়: ০৯০৭ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ০৫, ২০১৯
এনইউ/এমএ