শনিবার (৩০ নভেম্বর) বিকেলে রাজধানীর কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার বেদীতে জাতীয় কবিতা পরিষদের আয়োজনে অনুষ্ঠিত হয় কবি রবিউল হুসাইনের নাগরিক স্মরণসভা।
এর আগে মঙ্গলবার (২৬ নভেম্বর) সকালে রাজধানীর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বিএসএমএমইউ) চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যু হয় কবি ও স্থপতি রবিউল হুসাইনের।
স্মরণসভায় ছায়ানটের সাধারণ সম্পাদক লাইসা আহমদ লিসার কণ্ঠে রবীন্দ্রসংগীত ‘সম্মুখে শান্তি পারাবার’ পরিবেশনার মধ্য দিয়ে শুরু হয় স্মরণসভা। এরপর কবি তারিক সুজাত পাঠ করেন প্রাবন্ধিক ও মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি মফিদুল হকের লেখা শোকপত্র।
এতে তিনি বলেন, তার (রবিউল হুসাইনের) সান্নিধ্য সবার জীবনের স্মরণীয় অভিজ্ঞতা, তার কাছে সহজিয়া মানুষ পেয়েছে নির্ভরতা। ইতিহাসের গভীরে প্রোথিত তার বাঙালি সত্তা, অন্যদিকে বাঙালির নবজাগরণে তিনি দৃঢ় প্রত্যয়ী। তিনি আমাদের প্রেরণা, মানবতা, স্বদেশপ্রেম ও সৃজনের দীক্ষাদাতা।
সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব নাসিরউদ্দীন ইউসুফ বলেন, মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী সংকটকালে সেনা শাসন, স্বৈরশাসনের সময়ে ছাত্র আন্দোলনে তিনি ছিলেন সোচ্চার। পরে জাতীয় কবিতা পরিষদের আন্দোলনে তিনি শক্তি যুগিয়েছেন। আমাদের প্রতিটি আন্দোলনে তিনি ছিলেন প্রেরণা। তার স্ত্রীর মৃত্যুর পর তাকে মাঝে মধ্যে নিঃসঙ্গ মনে হলেও কখনো দৃঢ় চেতনা ম্লান হতে দেখিনি। একজন কবি হিসেবে তার কবিতার শরীর ও ভাষা রীতি ছিল অন্য কবিদের থেকে আলাদা, যা তাকে স্বাতন্ত্র্য দিয়েছে। অনন্য এই মানুষটি নিভৃতচারী হলেও একজন আধুনিক মানুষ ছিলেন তিনি। আমরা চিরদিন এ দৃঢ়চেতা মানুষটিকে সাহসী মানুষ হিসেবে স্মরণ করবো।
কবি কামাল চৌধুরী বলেন, আমরা সবাই নিজের মধ্যে চেতনাবোধশূন্য নিয়ে আছি, কবি রবিউল হুসাইন তেমনি আরও এক শূন্যতা দিয়ে গেলেন। একজন ভালো মানুষ হিসেবে তিনি সবার সর্বোচ্চ সম্মান পেয়েছেন।
কবি মুহম্মদ নূরুল হুদা বলেন, কবি রবিউল হুসাইন ছিলেন অজাতশত্রু। তিনি নিজে কত বড় ছিলেন, তা তার আন্দাজেও ছিল না। বিনয়ই ছিল তার বড় অহঙ্কার। সৃজনকর্মে তিনি ছিলেন সতত চলমান। এখন যত দিন যাবে, ততই একজন সংস্কৃতিসেবী, শিল্পী, কবি হিসেবে তিনি আরও বেশি প্রস্ফুটিত হবেন।
চিত্রশিল্পী হাশেম খান বলেন, আমার সঙ্গে তার দীর্ঘ ৪০ বছরের সম্পর্ক। আমরা একসঙ্গে বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘর, ঢাকা নগর জাদুঘর, বাংলাদেশ ব্যাংকের টাকা জাদুঘরের কাজ করেছি। তিনি চিত্রকলা নিয়ে নিবিড়ভাবে পরীক্ষা করে মন্তব্য করতে পারতেন। শেষ বয়সে তিনি বলতেন, আমি চলে গেলে আমার নবীনদের কী হবে! তার মতো দেশপ্রেম আর প্রত্যয় নিয়ে আমাদের যুবকেরা এগিয়ে গেলে দেশের উন্নয়ন হতে খুব বেশি সময় লাগবে না।
রবিউল হুসাইনের যত অপ্রকাশিত লেখা রয়েছে, তা থেকে ১০টি গ্রন্থ প্রকাশ সম্ভব বলে জানান তার দীর্ঘদিনের সহচর বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক কবি হাবিবুল্লাহ সিরাজী। রবিউল হুসাইনের রচনাবলী প্রকাশ করতে সেসব অপ্রকাশিত লেখাগুলো বাংলা একাডেমিকে দিতে তিনি পরিবারের সদস্য ও মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরকে অনুরোধ করেন।
রবিউল হুসাইনের অপ্রকাশিত লেখাগুলো প্রকাশের কথা জানান নগর গবেষণা কেন্দ্রের চেয়ারম্যান অধ্যাপক নজরুল ইসলামও। তিনি বলেন, সৃষ্টি ও নির্মাণকে জোড়া লাগিয়ে তিনি গতিপথ বদলে দিয়ে তার মতো করে কাজ করতে চেয়েছিলেন। স্থাপত্যশিল্পের মধ্য দিয়ে তিনি কবিতা ও শিল্প চৈতন্যকে প্রসারিত করেছিলেন।
স্মরণসভায় কবিকে নিয়ে আরও স্মৃতিচারণ করেন কবির ছেলে জিসান হুসাইন রবিন, বোন বিউটি হুসাইন, ভাই তারিক হুসাইন, কবির ভাগ্নে অর্ণব হাসান, কবি কাজী রোজী, কেন্দ্রীয় কচি কাচার আসরের সহ-সভাপতি রওশন আরা ফিরোজ, বাংলাদেশ স্থপতি ইনস্টিটিউটের সভাপতি জালাল আহমেদ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ডা. কামরুল ইসলাম খান প্রমুখ।
সভায় সভাপতিত্ব করেন জাতীয় কবিতা পরিষদের সভাপতি মুহম্মদ সামাদ। সঞ্চালনা করেন সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সাধারণ সম্পাদক হাসান আরিফ। স্মরণসভার পরে কবি রবিউল হুসাইনের কবিতা এবং তাকে নিবেদিত কবিতা পাঠ করেন কবি ও আবৃত্তিশিল্পীরা।
বাংলাদেশ সময়: ২১৫৫ ঘণ্টা, নভেম্বর ৩০, ২০১৯
এইচএমএস/এইচএডি/